পুস্তক পরিচয়

অভিনব অশ্বচরিত

বাঙালির দৈনন্দিন জীবনসংস্কৃতি ঘোড়াকেন্দ্রিক না হলেও ঘোড়ার দাপুটে চলনে আমাদের মুগ্ধতা ভর করে। আবার জঙ্গলমহলের গ্রাম-গ্রামান্তরে লৌকিক দেবতার থানে পোড়ামাটির উৎসর্গের ঘোড়া নজরে পড়বেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৭ ০০:০৯
আদিম: মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকার প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহাচিত্রে ঘোড়ার রূপায়ণ

আদিম: মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকার প্রাগৈতিহাসিক যুগের গুহাচিত্রে ঘোড়ার রূপায়ণ

অশ্বনামা: সংস্কৃতির ঘোড়া

লেখক: আদিত্য মুখোপাধ্যায়

Advertisement

মূল্য: ৩০০.০০

পরিবেশক: আনন্দ পাবলিশার্স

‘টানাটানি আর ধকলেতে হায়/ ধুক ধুক করে প্রাণ,/ মানবজীবন, খোঁড়া করে প্রভু/ ঘোড়া কর ভগবান।’ কৌতুক মিশিয়ে আনন্দগোপাল সেনগুপ্ত ‘সচিত্র ভারত’ পত্রিকায় তাঁর বিখ্যাত কবিতাটি পাঠিয়েছিলেন। ঘোড়ার প্রসঙ্গে এমন কত কাব্য গল্প উপন্যাস চলচ্চিত্রে মিশে আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে জীবনানন্দ দাশ ঘোড়ার উপমা কবিতায় এনেছেন। গতি, শক্তি আর যুদ্ধের বাহনে ইতিহাসের ঘোড়া স্বপ্ন-ভুবনের প্রাণী।

বাঙালির দৈনন্দিন জীবনসংস্কৃতি ঘোড়াকেন্দ্রিক না হলেও ঘোড়ার দাপুটে চলনে আমাদের মুগ্ধতা ভর করে। আবার জঙ্গলমহলের গ্রাম-গ্রামান্তরে লৌকিক দেবতার থানে পোড়ামাটির উৎসর্গের ঘোড়া নজরে পড়বেই। বাংলার নানা স্থানে পিরের মাজারেও তা দেখা যায়। আর সে সব এলাকার কুম্ভকার পল্লিতে গেলে দেখা যায় ঘোড়ারই কত আকার, গঠন-বৈচিত্র্য আর শিল্পঘরানা। কোনও কোনও জায়গায় আবার বাস্তবিকই ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন দীর্ঘকালের। অঞ্চলভেদে লৌকিক জীবনে উৎসর্গের জন্য ব্যবহার্য বস্তু এক দিকে যেমন, তেমনই ঘোড়ার রাজকীয় চলনের খুরের শব্দে সচকিত হতেই হয়। আছে কত অশ্বারোহীর রূপকথা। তাই বইটির প্রচ্ছদলিপি দেখে প্রাথমিক ভাবে ধন্দ হয়েছিল যে আখ্যানই বুঝি এর বিষয়ভিত্তি। নামপত্রে ‘সংস্কৃতির ঘোড়া’র কথায় অবশ্য অন্য অশ্বচরিতের অভিনব প্রকাশ হল।

ঘোড়া নিয়ে চরাচরের আঙিনা এখানে সুবিস্তীর্ণ। অতীতকথা আর যুদ্ধের দামামা মিশে আছে ঘোড়ার সঙ্গে। লোকায়ত জগৎ আর রাজঐতিহ্যের কেতা সময়কে পিছনে টেনে নিয়ে যায়। রানা প্রতাপ, রানি লক্ষ্মীবাই, শিবাজি বা নেতাজি সুভাষের অশ্বারোহী ভঙ্গি যেমন দেশ কাল সমাজের চিহ্ন বহন করে। রাজা-বাদশা, সম্রাট, স্বাধীনতা যোদ্ধার আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে রূপকল্পের ঘোড়া, মহাকাব্যের ঘোড়া, মহাকালের সময়কেও ছুঁয়েছে। তুর্কি মোগল ইংরেজ আমলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঘোড়ার দীপ্ত ভূমিকা। প্রাচীন কালের সূত্র ধরে বর্গি হাঙ্গামা থেকে মধ্যযুগের পথে আধুনিকের সাম্রাজ্য ইতিহাস ও ধর্মীয় বাতাবরণের কথা ঘোড়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এখানে আছে অশ্বচরিতের সার্বিক বর্ণনায় ভারত-ইতিহাসের ইসলাম ও সুফি-পির সংস্কৃতির প্রেক্ষাপট আলোচনা। লৌকিক দেবদেবীর মানত উপাদানের লোকশিল্পে, লোকনৃত্যে ঘোড়ানাচের প্রসঙ্গও আলোচনার বিষয়ে এসেছে। হজরত মহম্মদ ও তাঁর ঘোড়া ‘দুলদুল’-এর কথা যেমন আছে, পাশাপাশি এই বইয়ে প্রাচীন কালের অশ্বমেধ যজ্ঞের চমৎকার বর্ণনা আছে। ইতিহাসের কথায় ঘোড়ার আলোচনা বিশ্বজনীন ও দেশীয় প্রেক্ষাপটে হলেও বইটিতে লোকায়ত প্রেক্ষিত চর্চা মূলত এ বাংলাতেই সীমায়িত।

এই বহুবিস্তারী অশ্ব আলোচনায় পক্ষীরাজ ঘোড়া থেকে রেসের ঘোড়া সবই আছে। উৎসাহী গবেষক ইতিহাসের বই ঘেঁটেছেন, রাজঐতিহ্যের কথার মধ্যে পুথি-পাঁচালি-পদাবলিতে ঘোড়ার প্রসঙ্গ খুঁজেছেন, গ্রাম-পর্যটনে ঘোড়ার রূপ সন্ধান করেছেন। আর বইয়ে এ সব বৃত্তান্ত লেখক সরল মনোগ্রাহী বয়ানে শুনিয়েছেন। উপাদান মজুত থাকা সত্ত্বেও আদিত্য লেখাটা লোকসংস্কৃতির ছাত্রবন্ধু পাঠক্রমের ছকবন্দি বিষয় করেননি— এ জন্য তিনি ধন্যবাদার্হ। বিষ্ণুপুরের বালুচরি শাড়িতে ঘোড়ার মোটিফ, রথের কাঠামোয় কাঠের ঘোড়া, পোড়ামাটি ও ডোকরাশিল্পের গৃহসজ্জার ঘোড়া, ধর্মঠাকুরের কাঠের ঘোড়া, বীরস্তম্ভের পাথুরে ঘোড়ার কথা বলতে বলতে আলমোড়া-কুমায়ুনের পাহাড় আর পাইনের গহীন পথের ঘোড়ার সন্ধান দিয়েছেন লেখক। ঘোড়ার গতির রেশ বইটি পড়তে পড়তে থেকেই যায়। তবে, বর্ণনার কোনও কোনও অংশে সময়কাল ও ঘটনাক্রম মিলেমিশে লাগামছাড়া ঘোড়ার মতো হয়েছে। এই চলমান আলোচনায় মেদিনীপুর জেলার কথা নানা প্রসঙ্গে উল্লেখিত হয়েছে। মেদিনীপুর জেলা ভাগ হয়ে হয়ে বর্তমানে তিনটি জেলা। এখন তো মেদিনীপুর নামে কোনও জেলাই নেই!

আলো-আঁধারির গুহার দেওয়ালে সেই কোন আদ্যিকালের চিত্র দেখতে দেখতে চমকিত হয়েছিলাম। মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকার পাথুরে দেওয়ালে হাজার হাজার বছর আগের মানুষের আঁকা ঘোড়ার ছবি দেখলে বিস্ময়ে চোখ জুড়িয়ে যায়। ঘোড়ার রূপকল্প সেই আদিম সময়েও সজীব ছিল। আবার মকবুল ফিদা হুসেন তাঁর ঘোড়ার শৈল্পিক চিত্রে মহার্ঘ তুলিটান দিয়েছেন আধুনিক কালে। ঘোড়া নিয়ে ঘটনার ঘনঘটা আবহমানের। সে সব ‘ঘোড়ার মুখের কথা’ আরও বাকি থেকে গেল। এ সত্ত্বেও, আদিত্য মুখোপাধ্যায়ের এই চর্চা নিঃসন্দেহে স্বতন্ত্র অন্বেষণের দিশা দেখাবে।

দীপঙ্কর ঘোষ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement