পুস্তক পরিচয় ২: বাংলাদেশের বই

সব্যসাচী লেখকের অদম্য লড়াই

সাহিত্যের সব শাখায় সৈয়দ শামসুল হক-এর অবাধ বিচরণ ছিল। কবিতায় এমন শৈলী ও স্বকীয় এক ভাষা তিনি নির্মাণ করেন, যা বিষয়ে ও প্রকরণে অনন্য। ছন্দ ও বাক্‌প্রতিমা নিয়ে তাঁর নিত্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল।

Advertisement
আবুল হাসনাত
শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
মহান সতীর্থ/ শামসুর রাহমান। সৈয়দ শামসুল হক। চৈতন্য প্রকাশনী, ১৮০.০০

মহান সতীর্থ/ শামসুর রাহমান। সৈয়দ শামসুল হক। চৈতন্য প্রকাশনী, ১৮০.০০

সাহিত্যের সব শাখায় সৈয়দ শামসুল হক-এর অবাধ বিচরণ ছিল। কবিতায় এমন শৈলী ও স্বকীয় এক ভাষা তিনি নির্মাণ করেন, যা বিষয়ে ও প্রকরণে অনন্য। ছন্দ ও বাক্‌প্রতিমা নিয়ে তাঁর নিত্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল। সাহিত্যের কলাম হৃৎকলমের টানে এক সময় খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। তাঁর নাটকে মানবজীবনের জটিল গ্রন্থি মোচন, কখনও মুক্তিযুদ্ধ, ঐতিহ্য কিংবা মানবমনের গহন আবর্ত। প্রেমের কবিতার সমৃদ্ধ ভুবনে যে আবেগ, আকুতি ও ভাবনার জন্ম দিতেন, তা ছিল নব্য-ভাবনায় সমৃদ্ধ। এই সৃজনে দেশপ্রেম ও সমকালীন জীবনযন্ত্রণাও মুখ্য হয়ে উঠত। ১৯৭৫-উত্তর অভিজ্ঞতার বহুস্তর সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে সৈয়দ শামসুল হক ছোটগল্পের ক্ষেত্রে নবীন মানসিকতার যে বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছিলেন, তা হয়ে উঠেছিল এ দেশের ছোটগল্পের ভুবনে নবীন এক যাত্রা। আর উপন্যাসে তিনি মানবজীবনের বিস্তৃত অনুষঙ্গকে বিরাট ও ব্যাপক ক্যানভাসে রূপায়িত করেন।

সৈয়দ শামসুল হকের আরেক কীর্তি শেক্সপিয়রের বাংলা অনুবাদ। এ ছাড়া তিনি যে-ক’টি মৌলিক নাটক রচনা করেছেন, তার অধিকাংশই মঞ্চসফল।

Advertisement

সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম রংপুরের কুড়িগ্রামে। তাঁর লেখায় কুড়িগ্রামের পরিবেশ, জলেশ্বরী নদী ও মানুষের বেঁচে থাকার আর্তি ও সংগ্রাম নানা দিক নিয়ে প্রতিফলিত।

ফেব্রুয়ারি বইমেলায় প্রকাশিত সৈয়দ শামসুল হক রচিত তিনটি গ্রন্থ সম্পর্কে আজ আমরা সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করব। ১৯৪৭-উত্তর পঞ্চাশের দশকে কয়েকজন নবীন যুবা সাহিত্যের ভাষা নির্মাণে এবং বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে চল্লিশের উত্তরাধিকার বহন করলেও রাষ্ট্রীয় আদর্শের বিপরীতে বাংলা ভাষার প্রবহমানতাকে ধারণ করে আধুনিক সাহিত্যশৈলীর পথ ও নবীন বোধ সৃষ্টি করেন।

পঞ্চাশের দশক থেকে কবিতাচর্চা ও সাধনার মধ্য দিয়ে শামসুর রাহমান কেমন করে হয়ে উঠলেন এক জন আধুনিক কবি, তা বন্ধু ও সহযাত্রী হিসেবে সৈয়দ শামসুল হক খুব কাছ থেকে দেখেছেন। প্রত্যক্ষণে শামসুর রাহমানের সাহিত্যরুচি ও সিদ্ধি ও উত্তরণ আলোচিত হয়েছে। মহান সতীর্থ/ শামসুর রাহমান গ্রন্থে এই কবির সৃজন ও ব্যক্তিস্বরূপ আলোচিত হলেও পঞ্চাশের দশকে নব্য যুবাদের সাহিত্যরুচি, জীবনবোধ ও শিল্পে অঙ্গীকারের কথা আছে। মাত্র ৮০ পৃষ্ঠার বইটি পাঠ করলে যে-কোনও পাঠকই উপলব্ধি করবেন যে, তাঁদের পথ কোনও ভাবেই মসৃণ ছিল না। তিরিশ ও চল্লিশের সমকালীন বাংলা ও ইংরেজি বই ছিল তখন দুর্লভ। তবু তাঁরা এই সব বইপত্র নানা ভাবে সংগ্রহ করতেন। পঠন-পাঠনের ফলে তাঁদের মানস গঠিত হয়েছিল। বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকা তাঁদের কত ভাবেই না উদ্দীপিত করেছিল। আর সাহিত্যের ভুবনে বিচরণ করবার ফলে পরিবারে তাঁরা নানা ভাবে হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন। জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে-র প্রভাব বিভিন্ন পর্যায়ে এড়িয়ে শামসুর রাহমান কোন পরিপ্রেক্ষিতজ্ঞানে ও অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের এক জন প্রধান কবি হয়ে উঠলেন, এই গ্রন্থটি পাঠ করলে তা জানা যায়।

দোয়েল নামে মেয়েটি
সৈয়দ শামসুল হক। প্রথমা প্রকাশন, ২০০.০০

দ্বিতীয় বইটি মিশ্র গদ্য (স্টুডেন্ট ওয়েজ, ৩০০.০০)। এই বইটিকে এক কথায় প্রবন্ধের বই বলা যায় না। সাহিত্য ভাবনা, নাটকের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, স্মৃতি ও নানাজনের মূল্যায়ন ও প্রত্যক্ষণ সম্পর্কে মিশ্র এক ভুবনে প্রবেশ করি আমরা। প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে কিছু স্মৃতি, দ্বিতীয় অধ্যায়ে তাঁর রচিত কয়েকটি নাটকের প্রযোজনা ও নাট্যভাবনা নিয়ে প্রসঙ্গ ও তাঁর বিতর্কিত ও বহুল পঠিত উপন্যাস খেলা রাম খেলে যা-র জন্মকথা নিয়ে কিছু স্মৃতি, তৃতীয় অধ্যায়ে সমকালীন কয়েকজনকে নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত অনুভব, এ ছাড়া নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে আলোচনা ও পরবর্তী অধ্যায়ে নজরুল ইসলাম ও অরুণ মিত্রের মূল্যায়ন ও শেষ অধ্যায়ে ছোটগল্পের প্রকরণ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা। এই বইটিতে বিচ্ছিন্ন ভাবে তাঁর সাহিত্যভাবনা প্রকাশ পেয়েছে। তৃতীয় বই দোয়েল নামে মেয়েটি-তে আমরা দেখতে পাই এ দেশের নবীন যুবাদের সঙ্গে একটি মেয়ের সম্পর্কের এক নব্য ভুবন। সঙ্গে উঠে এসেছে নবীনদের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা। কবি শামসুর রাহমান চরিত্র হিসেবে উপস্থিত এখানে। ঘটনা থেকে ঘটনায় ছুটে ফেরা। সৈয়দ শামসুল হকের এই উপন্যাসে পাওয়া যাবে এই সময়ের একদল তরুণের উচ্ছ্বাস। সমকালীন বাংলাদেশের ভিন্ন জগতের তরুণ-তরুণীর এক উচ্ছল জীবনছবি হয়ে উঠেছে এ উপন্যাস। ক্ষীণকায় হলেও উপন্যাসটিতে যে আবেগ ও তাড়নার দেখা পাই আমরা, তাতে এক শ্রেণির তারুণ্যের অভিমুখীনতা ও প্রবণতাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়েও সব্যসাচী এই লেখক লড়াই করেছেন। হাসপাতালেও সহায়তা-অনুলিখনে গল্প, কবিতা ও শেক্সপিয়র অনুবাদ করেছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মনোবল হারাননি তিনি।

আরও পড়ুন
Advertisement