চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

বাস্তবকেও ছাড়িয়ে যায় গভীর গহন রহস্য

সম্প্রতি মায়া আর্ট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত উৎপল সরকারের আলোকচিত্র প্রদর্শনীটি দেখলেন মৃণাল ঘোষবহু মানুষ বহু দিন থেকে ভেবে এসেছেন, আলোকচিত্রের কাজ প্রাথমিকভাবে দৃশ্যমান বাস্তবের কাছে দায়বদ্ধ থাকা। সেই দায়ের একটা উদ্দেশ্য সত্যের উন্মোচন। ক্রমে এটা বোঝা গেছে সত্য শুধু বাস্তবের আপাত-আবরণের মধ্যেই থাকে না। তাকে খুঁজতে হয় বাস্তবের গহন অন্তরেও

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৫ ০০:০১

বহু মানুষ বহু দিন থেকে ভেবে এসেছেন, আলোকচিত্রের কাজ প্রাথমিকভাবে দৃশ্যমান বাস্তবের কাছে দায়বদ্ধ থাকা। সেই দায়ের একটা উদ্দেশ্য সত্যের উন্মোচন। ক্রমে এটা বোঝা গেছে সত্য শুধু বাস্তবের আপাত-আবরণের মধ্যেই থাকে না। তাকে খুঁজতে হয় বাস্তবের গহন অন্তরেও। এই বোধ থেকে চিত্রকলা প্রথম থেকেই ভাঙনের পথ ধরেছিল। আলোকচিত্রকেও সে পথেই যেতে হল খানিকটা পথ-পরিক্রমার পর। আজ চিত্র আলোকচিত্র হয়ে উঠেছে একই পথের পথিক। আপাত-অবিকৃত বাস্তবের ভিতরেও যেমন তারা সত্যের সন্ধান করে, তেমনি স্বচ্ছন্দে চলে বিমূর্তায়নের পথেও। চিত্রকলা প্রথম থেকেই বুঝেছিল, আপাতভাবে যা বাস্তব রূপে প্রতিভাত হয়, তার অনড় কোনও অস্তিত্ব নেই। তা অনেকটাই আপেক্ষিক। ব্যক্তিভেদে তার স্বরূপ বিভিন্ন হতে পারে। আলোকচিত্রের তা বুঝতে খুব দেরি হয়নি। আলোকচিত্র যখন প্রকৃতির স্বাভাবিক রূপের কাছেই দায়বদ্ধ থাকতে চেয়েছে, তখনও দেখা গেছে সেই স্বাভাবিকের ভিতরই রয়ে গেছে কত অন্তর্গূঢ় রহস্য। জীবন সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছে শিল্পের মায়ায়।

উৎপল সরকার মায়া আর্ট স্পেসে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তাঁর আলেকচিত্রের প্রদর্শনীতে সেই কাজটিই করেছেন নিবিড় নিষ্ঠায়। ৩২টি আলোকচিত্র নিয়ে আয়োজিত তাঁর প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘বন্যজীবন এবং বন্যপ্রান্তিক জীবন’ ‘ওয়াইল্ড-লাইফ অ্যান্ড ওয়াইল্ড সাইড অব লাইফ’)। উৎপল একজন আলোকচিত্র-সাংবাদিক। ক্রীড়া-সাংবাদিকতায় তাঁর বিশেষ খ্যাতি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যেতে হয় তাঁকে। সেখানে তিনি প্রকৃতি, অরণ্য ও অরণ্যের অজস্র পশুপাখির চলমান জীবনের অনেক বিরল মুহূর্তের ছবিও তোলেন। একেই তিনি বলেছেন ‘ওয়াইল্ড-লাইফ’।

Advertisement

বাস্তব থেকেই উদ্ভাসিত হয় বাস্তবাতীত গহন রহস্যের অনুষঙ্গ। একটি ছবির কথা উল্লেখ করা যায়। ছবিটি কেনিয়া-র মাসাইমারার অন্তর্গত নাইবাসা হ্রদের। হ্রদের প্রান্তবর্তী পথ ধরে ছুটে চলেছে কয়েকটি জেব্রা। জলের উপর তাদের চলমান পায়ের ছায়া। তাদের শরীরের ডোরা দাগগুলি পশ্চাৎপটের বিস্তীর্ণ জলরাশির ছন্দিত নীলিমার উপর এক জঙ্গম সংঘাতের আলোড়ন তোলে। পিছনের স্পন্দিত জলরাশির উপর সারিবদ্ধভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে অজস্র পাখি। সামনে ছুটন্ত জেব্রা, দূরে তরঙ্গায়িত জলে পাখির প্রতীকে ছড়ানো আকাশের বিস্তার- এই দৃশ্যের বাস্তবতাই আপাত-বাস্তব অতিক্রান্ত অলৌকিক এক সৌন্দর্য উদ্ভাসিত করে। বাস্তবকে এরকম পরাবাস্তবে তুলে দেওয়াই আজ আলোকচিত্রের অনিবার্য দায়। উৎপল অনেক ছবিতেই এই কাজটি করেছেন।

কেনিয়ারই মাসাইমারা অরণ্য থেকে তোলা আর একটি ছবি। শিরোনাম ‘মায়ের ভালবাসা’। একটি সিংহী তার শাবককে নিয়ে বসে আছে। শিশুটি মায়ের কোলে। দু’জনে দু’জনের দিকে নিবিড় ভাবে তাকিয়ে। মা ও শিশুর পারস্পরিক সম্পর্ক। শিল্পীর মানবিক দৃষ্টিকোণের অসামান্য প্রকাশ এই ছবি। এই ভালবাসা যেমন প্রাকৃতিক অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তেমনি হিংসাও। প্রাণীদের ক্ষেত্রে জীবনধারণের সঙ্গেই সম্পৃত্ত এই হিংসা। কেনিয়ারই নাইবাসা হ্রদের বিস্তীর্ণ জলরাশির উপর একটি ঈগল উড়ন্ত অবস্থায় একটি মাছ তুলে নিয়েছে। জলের উপর ভাসছে কচুরিপানা। পিছনে জঙ্গল। অজস্র ফুলের সমারোহ সেখানে। স্বাভাবিকের ভিতরই স্পন্দিত হচ্ছে সত্যের নিবিড় স্পন্দন। তানজানিয়ার অরণ্য থেকে তোলা ছবির শিরোনাম ‘জাস্ট অ্যানাদার ডে ইন অফিস’। একটি সিংহ বন্য-শূকরের গলার নলি কামড়ে ধরেছে। এক দিকে জীবন, আর এক দিকে মৃত্যু। সমস্ত প্রকৃতি জুড়ে এই দ্বান্দ্বিকতা।

মানুষ ও প্রাণিকুলের মধ্যেও রয়েছে ভালবাসার বন্ধন। রাজস্থানে মরুভূমির রৌদ্রোজ্জ্বল শুষ্কতায় কুটিরের সামনে বসে আছে একটি উট। সামনে লাঠি হাতে একটি মেয়ে। ভূমির উপর দীর্ঘ ছায়া পড়েছে তার। পিছনে মাঠ। রিক্ততার সৌন্দর্যের মধ্যে উটের সঙ্গে মেয়েটির উপস্থাপনা যেন রাজস্থানের এক গ্রামীণ সুরের স্পন্দন তোলে। বেজিং-এ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে যুবক-যুবতী। মেয়েটি কাঠিতে জড়ানো যে খাবার খাচ্ছে তাকে সরীসৃপজাতীয় কোনও প্রাণী মনে হয়। বাস্তব ও সত্য দুটোই যে কত বিচিত্র—বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তারই কিছু নিদর্শন উপস্থাপিত করেছেন শিল্পী।

আরও পড়ুন
Advertisement