পুস্তক পরিচয় ১

দেশভাগের ছয় দশক পরেও সন্দেহ ঘোচেনি

স লমন খুরশিদ এক বিদগ্ধ রাজনীতিক। বস্তুত, ইদানীং কালের রাজনীতিকদের মধ্যে তাঁর মতো শিক্ষিত ব্যক্তি বেশি নেই। একই সঙ্গে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্বও পালন করেছেন। নিজেকে তিনি কেবল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন বলে মনে করেন না, বরং একজন পূর্ণাঙ্গ ভারতীয় নাগরিক বলেই গণ্য করেন। তিনি চান, মুসলিম তথা অন্য সংখ্যালঘুরাও তাঁদের সংখ্যালঘুত্বের কারণে যেন ‘মরমে মরে’ না থাকেন, গুটিয়ে না থাকেন, বরং নিজেদের ব্যাপ্ত করেন জাতীয় জীবনের মূল ধারায়।

Advertisement
গৌতম রায়
শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০১

স লমন খুরশিদ এক বিদগ্ধ রাজনীতিক। বস্তুত, ইদানীং কালের রাজনীতিকদের মধ্যে তাঁর মতো শিক্ষিত ব্যক্তি বেশি নেই। একই সঙ্গে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্বও পালন করেছেন। নিজেকে তিনি কেবল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন বলে মনে করেন না, বরং একজন পূর্ণাঙ্গ ভারতীয় নাগরিক বলেই গণ্য করেন। তিনি চান, মুসলিম তথা অন্য সংখ্যালঘুরাও তাঁদের সংখ্যালঘুত্বের কারণে যেন ‘মরমে মরে’ না থাকেন, গুটিয়ে না থাকেন, বরং নিজেদের ব্যাপ্ত করেন জাতীয় জীবনের মূল ধারায়। এমন একজন শিক্ষিত মুসলিম যখন নিজ সম্প্রদায়ের হতাশা, বিড়ম্বনা ও পশ্চাৎপদতার কথা তুলে ধরেন, তখন তা মরমি আলেখ্য হতে বাধ্য। অ্যাট হোম ইন ইন্ডিয়া: দ্য মুসলিম সাগা তেমনই এক রচনা।

অ্যাট হোম ইন ইন্ডিয়া: দ্য মুসলিম সাগা,
সলমন খুরশিদ। হে হাউস ইন্ডিয়া, ৬৯৯.০০

Advertisement

ঘুরে-ফিরে যে কথাটা এই বইতে খুরশিদ বলার চেষ্টা করেছেন, তা হল, দেশভাগের পর যে বিপুলসংখ্যক মুসলমান পাকিস্তানের হাতছানি উপেক্ষা করে এ দেশে রয়ে গেলেন (অবিভক্ত ভারতের মাত্র এক তৃতীয়াংশ মুসলমানই সে সময় পাকিস্তানকে বেছে নেন), ভারতই তাঁদের স্বদেশ। ভারতকেই তাঁরা ইসলামের ভূমি (দারুল ইসলাম) বলে মনে করেন। অনেক পরিবার এ সময় খণ্ডিত হয়ে যায়। এক ভাইয়ের পরিবার পাকিস্তানে চলে যায়, অন্য ভাই সপরিবার ভারতে থেকে যান। কখনও দুই যমজ ভাইয়ের একজন পাকিস্তানে, অন্য জন ভারতে থেকে যান। তাই পাকিস্তান এক হিসাবে ভারতীয় মুসলিমদের এক অংশের দ্বিতীয় স্বদেশও বটে, যেখানে তাঁর ভাই-ভাতিজা কিংবা বাপ-বেরাদর রয়ে গেছেন। তাঁদের জন্য, তাঁদের সঙ্গে কটা দিন একত্রে কাটানোর জন্য তাঁদের প্রাণ কাঁদে। তাঁরা ভারতে এলে ছাড়তে মন চায় না। এই স্বাভাবিক সৌভ্রাত্র্যকে অন্য চোখে দেখা হবে কেন? কেন সব মুসলমানকে ‘পাকিস্তানের সম্ভাব্য চর’ ধরে নিয়ে তাঁদের সন্দেহভাজনদের তালিকায় রাখা হবে এবং সমাজ সেই অনুযায়ী তাঁদের সঙ্গে আচরণ করবে?

১৯৪০ সালে ভারতের সকল উলেমার সংগঠন জমিয়ত-উল-উলেমায়ে হিন্দ মুসলিম লিগের লাহৌর প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ঘোষণা করে: ‘রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক ভাবে অবিভক্ত ভারতের প্রতিটি কোণ মুসলমানের ঘরবাড়ি। প্রতিটি মুসলিম একজন ভারতীয়। তাই অন্য ভারতীয়ের সঙ্গে মুসলমানদের সমান দায়িত্ব রয়েছে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ত্যাগ স্বীকার করার।’ এঁরা দেশ-ভাগ তথা মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র বাসভূমির দাবিতে কর্ণপাত করেননি, কায়েদ-এ-আজম-এর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে ভারতকে নিজেদের স্বদেশ শিরোধার্য করেছেন। আজও অথচ দেশের ১৪ কোটি মুসলমানকে সতত দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিতে হয়। কোনও হিন্দুকে কখনও তার দেশভক্তি নিয়ে প্রশ্ন করা হয় না। কিন্তু প্রতিটি মুসলমানই যেন একজন সম্ভাব্য মিরজাফর, যে তলে-তলে পাকিস্তানের চরবৃত্তি করছে। এই কাল্পনিক সন্দেহ ও তা থেকে উদ্ভূত বিদ্বেষই মুসলিম সংখ্যালঘুদের ভারতে ‘অপর’ করে রেখেছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নামে ভিওয়ান্দি, মোরাদাবাদ, মেরঠ, ভাগলপুর কিংবা গুজরাতে যে সংখ্যালঘু-নিধন ঘটে, তার পটভূমিও প্রস্তুত রাখে এই সন্দেহ। দেশভাগের ছয় দশক পরেও এই সন্দেহ ঘুচল না। ভারতে থেকে যাওয়া মুসলমানরা ভারত ছেড়ে চলে যাওয়া মুসলমানদের থেকে কোনও আলাদা আচরণ পেল না। মুখে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও ভিতরে-ভিতরে যে ভারত হিন্দুরাষ্ট্রই হয়ে উঠেছে, সংখ্যালঘুর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

মুসলমানরা জাতীয় রাজনীতির মূল স্রোত থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলেছে, তারা ভারতীয়তায় লীন হতে আগ্রহী নয়— এমন একটা পরিকল্পিত অপপ্রচারও চালানো হয়। অথচ ১৪ কোটি মুসলমান নিজেদের কোনও প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা পর্যন্ত করেননি। এ দেশে বর্ণহিন্দুদের রাজনৈতিক সংগঠন আছে (বিজেপি)। হিন্দুত্ববাদী প্রাদেশিকতার সংগঠন আছে (শিব সেনা)। অনগ্রসরদের বিভিন্ন জাতের, যেমন যাদব, কুর্মি, দলিত, মহাদলিতেরও নিজ-নিজ সংগঠন আছে। কিন্তু মুসলিমদের তেমন কোনও সংগঠন নেই। মুসলিমরা আলাদা করে নিজেদের সংগঠন গড়ার চেষ্টাও করেননি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে তাঁদের ভোট ভাগ হয়ে গেছে। কোথাও তাঁরা কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছেন, কোথাও বা বামপন্থীদের, অন্য কোথাও আঞ্চলিক বা জাতপাতভিত্তিক কোনও সংগঠনকে। অর্থাৎ সর্ব অর্থেই তাঁরা নিজেদের স্বতন্ত্র সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে রাজনৈতিক মেরুকরণ থেকে সচেতন ভাবে তফাতে রেখেছেন। অথচ কী আশ্চর্য, তাঁদেরই ভোট-ব্যাংক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, তাঁরা মোল্লা-মৌলবিদের কথায় ভোট দেন বলে প্রচার করা হয়েছে (যদিও জামা মসজিদের ইমাম সৈয়দ আবদুল্লা বুখারির প্রকাশ্য ফরমান অগ্রাহ্য করে দিল্লির চাঁদনি চকের মুসলমানরাও তাঁর পছন্দের দল বা প্রার্থীদের ভোট দেননি)। সলমন খুরশিদ অবশ্য চান এক সর্বভারতীয় মুসলিম নেতৃত্বের উত্থান। সব মুসলিমের কাছে গ্রহণযোগ্য, আবদুল কালাম আজাদ কিংবা রফি আহমেদ কিদোয়াই-এর মতো কোনও নেতা, যিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের অভাব-অভিযোগ, প্রত্যাশা, আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরতে পারবেন, রাষ্ট্রের সঙ্গে নিজ সম্প্রদায়ের হয়ে দরকষাকষি করতে পারবেন তাঁদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে এবং তাঁদের প্রতি ঘটে চলা বৈষম্য ও বঞ্চনার অবসান ঘটাতে। খুরশিদের মতে ভারতীয় মুসলমানরা সে দিক দিয়ে দেখলে এক কান্ডারিহীন তরণীর মতো এ-ঘাটে ও-ঘাটে ঘুরে মরছেন।

ভারতীয় সংবিধান যে ধর্মনিরপেক্ষতার সাধনা করতে বলে, তা বৈচিত্রর মধ্যে ঐক্যের সাধনা, বহুত্বের সাধনা, অভিন্নতা বা একত্বের সাধনা নয়, বহু ধর্ম ও সংস্কৃতিকে খর্ব করার সাধনা নয়। অথচ যাবতীয় জাতীয় প্রতীক, আচার, ভঙ্গিমা কেবল একটিই ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। এই অবস্থায় মুসলিম তরুণদের শিক্ষিত অংশ যে জঙ্গিপনার দিকে ঝুঁকতে পারে, সেই আশঙ্কা থেকেই যায়। মুজফ্ফরনগরের দাঙ্গার পর মরিয়া মুসলিম তরুণদের মধ্যে এমন মনোভাব জাগা অসম্ভব নয় যে, সরকার যখন আমাদের রক্ষা করতে আগ্রহী নয়, তখন নিজেদের রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। যখন সারা বিশ্বে রাজনৈতিক ইসলামের জেহাদি প্রকরণ সশস্ত্র প্রতিরোধ এমনকী আগ্রাসী আক্রমণাত্মক সমরাভিযানে রূপান্তরিত হচ্ছে, তখনও ভারতীয় মুসলমানরা সেই প্রবণতার শরিক হচ্ছেন না। তালিবান নেতা মোল্লা ওমর, আল-কায়দার শীর্ষ নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি কিংবা ইরাক-সিরিয়ার ইসলামি রাষ্ট্রবাদী খলিফা আবু বরকত আল-বাগদাদির জেহাদে যোগদানের আহ্বানে ভারতীয় মুসলমানরা পাত্তাই দেননি। কিন্তু তাই বলে কি এটা ধরে নেওয়া যায় যে, ক্রমশ কোণঠাসা করে চললেও, তাঁদের ব্যক্তিগত আইনের অলঙ্ঘনীয়তা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রবর্তনের নামে খর্ব করলে কিংবা তাঁদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা খণ্ডন করার চেষ্টা হলেও তাঁরা মুখ বুজে তা সহ্য করে যাবেন?

সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার আগে থেকেও জানা ছিল যে, হায়দরাবাদের দরিদ্র মুসলিম পরিবারগুলি স্রেফ দারিদ্রের কারণেই তাদের অনূঢ়া কন্যাদের আরবের বৃদ্ধ, পঙ্গু, অসুস্থ কিন্তু ধনাঢ্য শেখদের সঙ্গে ‘নিকাহ্’ করিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। দারিদ্র এবং শিক্ষাহীনতা সম্প্রদায়কে যে অনগ্রসরতার অতল গহ্বরে ঠেলে দিয়েছে, তা থেকে উত্তরণের কোনও কর্মসূচি রাষ্ট্রের নেই, বিজেপি শাসিত রাষ্ট্রের হয়তো তা থাকার কথাও নয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু মুসলিম ব্যক্তি ও সংগঠন অবশ্য নিজেরাই এগিয়ে এসেছেন। দিল্লির চৌধুরী আরিফ, বেঙ্গালুরুর আল-আমিন এডুকেশনাল সোসাইটি, কালিকটের অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল সোসাইটি, চেন্নাইয়ের মুসলিম ইকনমিক ফোরাম, উত্তর ভারতে হামদর্দ এডুকেশন ট্রাস্ট, দাউদি বোহরা ও আগা খানের অনুগামীদের নিজস্ব সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলি মুসলিম তরুণদের শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। কিন্তু এ সবই সমুদ্রে জলবিন্দুর মতো। সরকারি স্তরে ব্যাপক কর্মসূচি ছাড়া এই বিপুল সংখ্যক জনসাধারণের উন্নয়ন সম্ভব নয়।

সলমন খুরশিদ বিভিন্ন সময় জুড়ে বইটি লিখেছেন। ১৯৮৭ সালে বইটির দ্বিতীয় অংশটি রচিত হয়। কিন্তু সেই থেকে আজ অবধি মুসলিমদের অবস্থা, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, সংখ্যালঘুদের প্রতি রাষ্ট্রের মনোভাব ও আচরণে বিশেষ কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। তাই অনায়াসে তিনি ওই প্রাসঙ্গিক অংশটিকে বইয়ের অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছেন। তাঁর এই বই মুসলিমদের চেয়েও হিন্দু এবং ধর্মনিরপেক্ষ পাঠকদের বেশি করে পড়া দরকার।

আরও পড়ুন
Advertisement