পুস্তক পরিচয় ২

আলোর বৃত্তের পরিবর্তে কবিতার বৃত্তে

বিভিন্ন স্বাদের কবিতার বই। আফতাব ও গোলাপচারা-র কবি সুনন্দ অধিকারী (কোরক, ৫০.০০)। চার ফর্মার বইয়ে কবিতাগুলির ধরতাই চমৎকার। যেমন, ‘সাধনা’— ‘মাধব দত্ত বড় বোকা।/ মাধব দত্ত বড় চালাক।/ অন্ধকার পেরিয়ে তবে/ নেমে আসে নক্ষত্রের রাত...’।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৬ ০০:০০

বিভিন্ন স্বাদের কবিতার বই। আফতাব ও গোলাপচারা-র কবি সুনন্দ অধিকারী (কোরক, ৫০.০০)। চার ফর্মার বইয়ে কবিতাগুলির ধরতাই চমৎকার। যেমন, ‘সাধনা’— ‘মাধব দত্ত বড় বোকা।/ মাধব দত্ত বড় চালাক।/ অন্ধকার পেরিয়ে তবে/ নেমে আসে নক্ষত্রের রাত...’। অথবা, ‘অনেক অনেক মানুষ/ একসঙ্গে হাঁটলে/ একটা মিছিল।’ কবিতার নাম ‘একা ও অনেক’। ‘যুদ্ধ’ কবিতার প্রথম অংশ— ‘যোদ্ধা/ সে তুমি যত বড়ই হও/ প্রথম ও শেষ যুদ্ধ তোমার/ সঙ্গে নিজের’। স্মার্ট টকটকে লাইন। বাক্যবিন্যাস। আরও উল্লেখ করা যেতে পারে— ‘আমি সেই কবি।/ একটা লাইনও যার পড়ে দ্যাখেনি/ কোনোদিন কেউ’। সুনন্দর কবিতার ‘ম্যাজিক’ কবিতার শুরুর দিকেই। এগোতে থাকলেই তা যেন বাণী দেওয়ার প্রবণতা নেয়।

পানপাত্রের পাখি জ্যোতিপ্রকাশ ঘোষের প্রথম বই (সহজপাঠ, ১০০.০০)। কবিতা সাজানো হয়েছে পৃষ্ঠার নীচের দিক থেকে। তবে গোলাপকে যে নামে ডাক, সে গোলাপই। কবিদের প্রথম বইয়ের কবিতার এক অনন্য স্বাদ থাকে, যা এ বইয়েরও ছত্রে ছত্রে। খুব শান্ত, নিরুচ্চার কিন্তু চমৎকার ইমেজারি। যেমন ‘মুর্শিদাবাদ: ১’-এর কয়েকটি লাইন— ‘এ মুহূর্ত শান্ত নখহীন বিদ্যুৎ/ আজ আমরা পরস্পরকে শুভরাত্রি বলে দিতে পারি/ কলকাতা সুখী হোক/ সুখী হোক বিদেশিরা এমন প্রবাসে।’ অথবা ‘কলকাতা’ কবিতায় ‘২৯ তারিখে পেঁপে গাছের ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে/ দেখা সূর্যকে মনে পড়ে। যদিও সূর্য আজ আমার কাঁধে/ চেপে হাজির টেলিফোন বিলের টাকা জমা দেবার লাইনে।’ এ বইয়ের পাঠ শেষে এক শব্দহীন অনুভূতি হয়। মনে হয়, জ্যোতিপ্রকাশ অনেকের মাঝে এক একলা থাকার কবি।

Advertisement

‘শ্রাবণ দেখা যায়,/ শ্যামলপর্ব পেরিয়ে যাওয়ার পর/ শ্রাবণের শ্রাবণতাটুকু দেখা যায় শুধু’— এ রকমই কণ্ঠস্বর বা লিখনভঙ্গি স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্তর। ৬৪ পাতার কাব্যগ্রন্থ, পেপারব্যাক, বইটির চারটি পর্বে ভাগ। ‘সামান্যকে জানার ইচ্ছে’, ‘বেড়াল, এরকম একটি ধারণা’, ‘পিতার জন্ম হয়’, ‘হে আকাশ রেবতীভূষণ’। সব নামই চূড়ান্ত লিরিকাল। অবশ্য বইয়ের নামও পিতার জন্ম হয় (মনফকিরা, ৭০.০০)। প্রায় প্রতিটি কবিতারই ধরতাই চমৎকার। যেমন ৪/৬ কবিতাটি— ‘যেটুকু ভ্রমণ আজ, ডালিয়াকলোনি ছুঁয়ে, ফিরে আসে অবাক স্মরণ/ অজন্তা গাছের নিচে, জীবন ফুরিয়ে যায়, এমনই লিখেছে যারা’। অক্ষরবৃত্তের স্বাদু ব্যবহার। স্বর্ণেন্দু জানেন কবিতায় কী ভাবে কথা বলতে হয়। তিনি যে বাংলা কবিতার পূর্বজদের সার্থক উত্তরসূরি, তার স্বাক্ষর এই তিনটি লাইনে— ‘বেড়াল, এরকম একটি ধারণা/ সারাসকাল হয়ে সারাবিকাল/ ধারণাটি ঘুরেফিরে আসে’।

বিপুল চক্রবর্তীর জল পড়ি পাতা পড়ি-ও পেপারব্যাক (মনফকিরা, ৭০.০০) ৬৪ পাতার কাব্যগ্রন্থ। শুরুতেই বলেছেন— ‘তরুণ কবিদের জন্য—/ তোমরা এসেছ/ শস্যের মাঠে যেন বা নতুন ধান/ তোমরা এসেছ/ বটের ঝুরিতে নেমে আসে আশমান।’ বইটাকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন— ‘জন্ম আমার’ ও ‘তোমার প্রাণের সমর্থনে’। ‘কবে সহজ চাইব’ কবিতায় বিপুল লিখছেন— ‘কবে সহজ চাইব আমি তোমার চোখে/ কোন্ সে দূর, অচিনপুর— কোন্ আলোকে/ দেখব চেয়ে তোমার ওই বক্ষপুটে/ প্রাণ-সরোবর পদ্ম হয়ে উঠল ফুটে’। ছন্দ চমৎকার। কিন্তু আলোকে বা বক্ষপুটের মতো শব্দ এই ২০১৬-য় বাংলা কবিতায় ব্যবহার করার আগে আর একটু মুনশিয়ানার প্রয়োজন। প্রায় সমস্ত কবিতাই ছন্দোবদ্ধ। ‘তোমার জন্য’ কবিতার ধরতাই চমৎকার— ‘আমাকে ঘিরেছে উনিশের প্রেম-ভাবনা/ অফিসে আজকে যাইনি, অফিসে যাব না।’ তবে কবিতাকে জীবনের অংশ করতে হলে তাঁর অনেকটা পথ বাকি।

রক্তাক্ত ’৭২ থেকে প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূত্রপাত। ‘ক্লেদজ কুসুম’ নামে চমৎকার লিট্‌ল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন। ১৭৬ পাতার বইয়ের ভূমিকায় তিনি সত্তরের বন্ধুদের সঙ্গে সখ্য ও দূরত্বের কথা বলেছেন। ‘শঙ্খলাগা রোদে’ কবিতায়— ‘বন্ধুদের মুখগুলো যদি একটু ভেসে ওঠে/ রোদের মতন/ আহ্লাদ গড়িয়ে এক নদী হ’য়ে বয়ে যায় যে দেশের ঘরে,/ সে দেশের নামটাই কবিতার নাম।’ এক নস্টালজিক আকূতি তাঁর মধ্যে কাজ করে। ‘গোঁসাই বাগানে’ কবিতায় লিখছেন— ‘যাকে পড়াই হ’লনা আজো, সে হঠাৎ সামনে দাঁড়িয়ে/ বলে উঠল: আমি কিন্তু ঐ সব করে দিতে পারি/ আমি কুড়ুল কোদাল বেলচা ভোজালি বন্দুক করে দিতে পারি’। প্রণবকুমার বরাবরই কবিতার দলাদলি থেকে দূরে থাকা এক জন মানবতাবাদী কবি। শঙ্খলাগা রোদে (পাঠক, ১৫০.০০) পাঠকের স্বীকৃতি পাবে নিশ্চয়ই।

প্রাণেশ সরকারও সত্তরের আর এক কবি। আমি আবার কথা বলছি কাব্যগ্রন্থটি নতুন করে প্রকাশিত হল (আর্ট অরবিট, ৮০.০০)। ৪৩ পাতার বইয়ে কবিতাগুলি গদ্যের ফর্মে লেখা। পরপর লাইনগুলো যেন একে অন্যের সঙ্গে বোনা হয়ে থাকে। ‘কালাশনিকভ’ কবিতাটি চমৎকার, যেমন চমৎকার তার পাশের কবিতা ‘লাশ’। ‘গান’ কবিতাটিও অন্য রকম উচ্চারণে লেখা। ‘আমি আবার কথা বলছি’ নাম্নী কবিতাটি একেবারেই প্রাণেশের নিজস্ব উচ্চারণ। প্রাণেশ সত্তরের সেই কবিদের এক জন, যাঁরা আলোর বৃত্তের পরিবর্তে কবিতার বৃত্তে থাকতে চেয়েছেন। কবিতার বৃত্তেই আছেন।

অন্য কোনো সূত্রপাতে গৌতম সরকারের (দিবারাত্রির কাব্য, ১৬০.০০) ১১২ পাতার কাব্যগ্রন্থ। ভূমিকাটির প্রয়োজন বোঝা গেল না। ‘নিয়ম’ কবিতাটি এই রকম— ‘আরও একটা সকাল গড়িয়ে গড়িয়ে/ গেল দুপুরের দিকে।/ নিজস্ব নিয়মে।’ খুব শান্ত, নিচু, নির্ভার একটা স্বর। যেন বা গৌতম নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলছেন। যেমন ‘প্রস্তাব’ কবিতায়— ‘ধরো ঝেঁপে বৃষ্টি আসবার/ আগেই আমরা এসে পড়লাম/ পাতাল জাদুঘরে...’। ছোট ছোট কবিতার মধ্যে অনেক কথা বলা অথবা ছোট কবিতার মধ্যে চিত্রকল্প এঁকে দেওয়া গৌতমের কবিতায় প্রধান মুনশিয়ানা।

কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তের কবিতা সংগ্রহ (পাঠক, ১৫০.০০) সম্পাদনা করেছেন সুমিতা চক্রবর্তী। ১৯১ পাতার বড় বই। সম্পাদকের ছোট্ট নিবেদনের পরে তাঁর ‘কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত: মানুষ ও কবি’— নামে একটি বড় গদ্য রয়েছে। চল্লিশ দশকের এই কবির প্রথম বই স্বপ্ন-কামনা-র ভূমিকা লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। কিরণশঙ্কর ছিলেন বামপন্থী মানসিকতার। নতুন করে তাঁর কবিতা নিয়ে বলার কিছু নেই। সুমিতা চক্রবর্তী যে কাজটি করেছেন, তা পরিশ্রমের ও অভিনন্দনযোগ্য।

আরও পড়ুন
Advertisement