Book Review

কাজের সূত্রে যে মেয়েরা জড়িয়ে ছিলেন বঙ্গজীবনে

বিভিন্ন পেশায় যুক্ত প্রায় ভুলতে বসা মেয়েদের সঙ্গে সমাজের নানা স্তরের সংযোগকে বর্ণনা করে লেখা বইটি বড় সুখপাঠ্য। লেখার ভাঁজে জুড়ে দেওয়া হয়েছে সাহিত্যের নানা মণিমুক্তোও।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:২৩

মায়েরা ও মেয়েরা

Advertisement

সোমা সেন

২০০.০০

শৈলী প্রকাশনী

“কচি কচি হাতে আলতা পরাতুম বলে গিন্নিরা খুব ভালবাসতেন। আমর হাত খুব ঠান্ডা ছিল তো। যাদের হাত গরম, তাদের হাতে আলতা পরে সুখ নেই— বলত তোমার দিদি শাশুড়ি।” কথাগুলি লেখিকাকে বলেছিলেন বিনিপিসি, যিনি বিশেষ তিথি, উৎসবের দিনে সকালবেলা আলতার জীর্ণ ঝাঁপিটি কাপড়ে মুড়ে হাজির হতেন বাড়ি বাড়ি। আর সেই বিনিপিসি, গিরিবালা, মালিনী, কাঁথাবুড়িদের গল্প জুড়ে জুড়ে লেখিকা লিখে ফেলেছেন একখানা বই। বিভিন্ন পেশায় যুক্ত প্রায় ভুলতে বসা মেয়েদের সঙ্গে সমাজের নানা স্তরের সংযোগকে বর্ণনা করে লেখা বইটি বড় সুখপাঠ্য। লেখার ভাঁজে জুড়ে দেওয়া হয়েছে সাহিত্যের নানা মণিমুক্তোও। বিনিপিসি যেমন আলতা পরাতেন, গিরিবালা তেমনই ছিলেন ধাত্রীমা। তাঁরা শুধু দুগ্ধধাত্রীই ছিলেন না, প্রসবে সহায়তা করা, ক্ষেত্রবিশেষে প্রসবও করানো ছিল তাঁদের কাজ। কিন্তু সম্মান জুটত না বিশেষ। আবার অসহায়, দরিদ্র ব্রাহ্মণ কন্যাদের হাতে বাড়ির রান্নাঘরটি ছেড়ে দিলেও সংসারের রাশ টেনে ধরতেন বাড়ির গিন্নিমাই। চারটে কাপড় পেতে নিপুণ হাতে সেলাই করে কাঁথা তৈরি করে দেওয়া মেয়ে-বৌরাও কি যোগ্য মূল্য পেতেন তাঁদের পরিশ্রমের? অথচ, অন্দরমহলে তাঁদের অবাধ যাতায়াত, অবসরকালীন গল্পগাছায় তাঁদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতোই। কিন্তু কোথাও যেন সেই উপস্থিতিটি আলাদা করে কখনও অনুভূত হয়নি। বইটির ছত্রে ছত্রে তাঁদের সেই সসঙ্কোচ, মলিন চেহারাটি করুণ সুরে ধরা পড়েছে।

ঝাল লজেন

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

৪৫০.০০

আনন্দ

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী কলম ধরেছেন তাঁর ছেলেবেলার স্মৃতির ঝাঁপি খুলে। দুই অসমান পর্বে বিভক্ত এই ‘আত্মজীবনী’তে নানা বিষয়, আশি-নব্বইয়ের দশকে এই বাংলায় যাঁদের ছোটবেলা কেটেছে, বইটির বিষয়সূচি দেখে তাঁদের স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ার সম্ভাবনা বিলক্ষণ। ‘রবিবার’, ‘লোডশেডিং’, ‘টেলিভিশন’, ‘কৃশানু’ শব্দগুলো সেই প্রজন্মের কাছে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ বহন করে। প্রথম পর্বে মোট ২২টি, দ্বিতীয় পর্বে ১১টা আর সব শেষে ‘শেষটুকু: ঝাল লজেন’ নামের উপসংহার নিয়ে সাজানো এই ব্যক্তিগত স্মৃতিকথন এক পড়ায় সাঙ্গ করে মনে হয়, আরও কত কিছু বলার, শোনার ছিল। বইয়ে ছড়িয়ে আছে লেখকের ব্যক্তিজীবনের নানা তথ্যও: ছোটবেলা কেটেছে বাটানগরের ‘পাশের ছোট্ট মফস্‌সল নুঙ্গীতে’, প্রথম পর্বের সব ক’টি লেখাতেই ছেলেবেলার স্মৃতি। তার পর ‘নতুন বাড়ি, পুরনো শহর’, পর্ব, কলকাতায় কাটানো কৈশোর। ‘দূরে কোথাও’-তে কর্নাটকের এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের গল্প, ‘লেখালেখি ও কলেজ স্ট্রিট’-এ ইংরেজি অনার্স তথা সাহিত্যে চলে আসার কথা। এই সব নিয়েই জীবনের এই ‘ঝাল লজেন’।

নির্বাচিত গল্প

সুদর্শন সেনশর্মা

৩৯৯.০০

পত্রভারতী

যে কোনও কথাসাহিত্যিকের দায় একটা থেকেই যায়— ব্যক্তিক বা সামূহিকের আত্ম-অভিজ্ঞান আবিষ্কারের। সেই দায়ে সময় বা ইতিহাসের ছাপ মিলবে কি না, তাও অনেকটাই নির্ভর করে ওই সংশ্লিষ্ট কথাকারেরই উপর। সুদর্শন সেনশর্মা তেমনই এক জন আখ্যানকার, যিনি স্বধর্ম পালনের প্রয়াসে সতত রত। গল্পলেখক হিসেবে ইতিমধ্যেই তাঁর বেশ কিছু বই প্রকাশিত, সে সব থেকেই একগুচ্ছ বাছাই গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে তাঁর এই নির্বাচিত গল্পের সঙ্কলনটি।

তবে গোড়াতেই জানিয়েছেন তিনি: “নির্বাচিত গল্প বেছে দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়।” আরও অসহজ তাঁর স্বধর্ম পালনের চেষ্টা। কারণ বাস্তবের যথাযথ রূপ দেওয়ার প্রশ্নে সাহিত্যের অসুবিধা হয় সবচেয়ে বেশি, কেবলমাত্র অভিজ্ঞতা কোনও শিল্পভাষ তৈরি করতে পারে না। লেখক সেই বিষয়ে সতর্ক বলেই তাঁর লিখনপদ্ধতিতে একটা কৌণিক দূরত্ব বেছে নেন— কোন দিক থেকে দেখলে বা কোন দিকটি পাঠকের কাছে ছবির মতো মেলে ধরলে অভিজ্ঞতাও শিল্পরূপ অর্জন করতে পারে, নির্ণীত বস্তু বা ব্যক্তি শিল্পিত মাত্রায় পাঠককে ছুঁতে পারে, সেই কৌশলটি তাঁর জানা। জানেন বলেই তাঁর গল্পগুলিতে নির্মোহ মেদহীন গদ্যের বাতাবরণ থাকে, নিষ্ঠুর পর্যবেক্ষণ থাকে, প্রচ্ছন্ন বিবেক থাকে, কিন্তু ভোঁতা আবেগ বা ‘ক্লিশে’ প্রতিবাদ থাকে না। অথচ পড়তে-পড়তেই টের পাওয়া যায়, কাহিনিমূলের বিস্তারে সামাজিক অসঙ্গতি প্রায় নিয়তির আকার নিচ্ছে ব্যক্তি বা সমষ্টির জীবনে। তাঁর গদ্যের মতোই আকর্ষণীয় তাঁর গল্পগুলির নামও: ‘অন্ত্যেষ্টি অনন্ত্যেষ্টি’, ‘চিত্রকরের ডানহাত’, ‘আতারানী সর্দার’, ‘খেজুর গাছ খালের বক এবং একটি নেড়ামাথা’, ‘ঠাকুরদালানের স্মৃতি কিংবা হরিচরণ নট্ট’, ‘প্রজ্ঞার স্বর’, ‘ইতিহাসের উত্তরপুরুষ’ ইত্যাদি।

আরও পড়ুন
Advertisement