Book Review

যেন একাকীর কবিতা-সঙ্কল্প

অবাক হয়ে যেতে হয় এই দু’ধরনের কবিতার পাশেই এ সংগ্রহে অবস্থান করছে ক্ষুদ্রাকার, সংহত কাব্যবাচন।

Advertisement
জয় গোস্বামী
শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:৩২
—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

হিন্দোল ভট্টাচার্যের শ্রেষ্ঠ কবিতা হাতে এল। ১৯৯৫ থেকে লিখে চলেছেন এই কবি, ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রেখে। সাতাশ বছরের কবিতা থেকে বেছে নিয়ে তৈরি হয়েছে এই সংগ্রহ। একটি কবিতার মধ্যেও নিজেকে পাঠকের চোখে ধরানোর জন্য কোনও ব্যস্ততা অথবা চমকের আয়োজন নেই। যেন এক কবি একলাই চিঠির পর চিঠি লিখে চলেছেন ও তাদের উড়িয়ে দিচ্ছেন দিগন্তের দিকে। সেই দিগন্ত, যা ছুঁয়ে দিচ্ছে আবহমান সময়ধারাকে।

Advertisement

একাকী চিঠির কথা বললাম তো? অথচ এ সঙ্কলনে গৃহীত চোদ্দোটি কাব্যগ্রন্থের পথে ভ্রমণ করার সময় আমার চোখে পড়ল এই একাকিত্বের মধ্যে এসে কী ভাবে ঢুকে পড়ছে সমাজস্রোত, ঢুকে পড়ছে ‘মধ্যবিত্ত’ নামের কবিতায় এই লাইন: “আমার ভিতরে শুয়ে থাকে অসহায় সার্কাসের খাঁচার জন্তুর কান্না।” পরক্ষণে ‘প্রেম’ নামক কবিতা সমাপ্ত হচ্ছে এই উচ্চারণে: “পেটের ধান্দায় আমি আত্মহত্যা করতে পারি রোজ।”

শ্রেষ্ঠ কবিতা

হিন্দোল ভট্টাচার্য

৩৩০.০০

দে’জ়

হ্যাঁ, একাকী চিঠি-ই, কিন্তু তা মাত্রই একার কথা নয়। সকলের কথা। যে-কথা বলবার জন্য এ সঙ্কলনে এক দিকে আছে জগৎগৌরীকাব্য নামক গ্রন্থের একগুচ্ছ চতুর্দশপদী, যা সনেট-নিয়ম বাধ্যতামূলক ভাবে অনুসরণ করেও কবিতা হিসাবে তর্কাতীত ভাবে উত্তীর্ণ— অন্য দিকে তার পাশেই পাই ‘কবরনামা’ ও ‘বিবাহ’ নামক ছন্দোমুক্ত গদ্যস্পন্দে প্রবাহিতকবিতা, যাদের মধ্যে দীর্ঘ কবিতার চরিত্রধর্ম বেগবান।

অবাক হয়ে যেতে হয় এই দু’ধরনের কবিতার পাশেই এ সংগ্রহে অবস্থান করছে ক্ষুদ্রাকার, সংহত কাব্যবাচন। ‘মানবজমিন’ কবিতা জানাচ্ছে: “পা রাখার জায়গা নেই, গ্রামশহর জ্বলছে দেখ, আকাশে মোহর/সে তার ছোবল থেকে তুলে দিচ্ছে বিষ হাতে হাতে/ গাছের কঙ্কালগুলি দিগন্তে সাজানো”। ‘প্রহরী’ কবিতায় শুনি: “এ জীবন কেটে গেল ভুল ভগবানে/তবে কি বৈরাগী হওয়া ভালো ছিল পাড়ায় পাড়ায়?” আর ‘নবান্ন’ কবিতা কী বলে? “রাস্তার উপরে লাশ/ লাশের উপরে রাস্তা/ শ্বাস ও কষ্টের মধ্যে জমে যাচ্ছে খিদের হাইফেন/ অকালবোধন।”

এই কবি, হিন্দোল ভট্টাচার্য, তাঁর প্রধান বাহন করেছেন অক্ষরবৃত্ত ছন্দকেই। এর ফলে তাঁর কবিতা ঘনত্ব পেয়েছে। কিন্তু যখন স্বরবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্ত হাতে নিয়েছেন, সেখানেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাঁর স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। অথচ কোথাও ছন্দ-মিলের ব্যবহারকে কবিতার চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি প্রধান করে তোলেননি। দৃষ্টান্ত হিসাবে দু’টি কবিতার নাম করছি, একটি ‘দশাশ্বমেধ’, অন্যটি ‘ধ্বনি’। ‘দশাশ্বমেধ’ কবিতায় তিনি মিল রেখেছেন, কিন্তু তা ধরা পড়ে কেবল দ্বিতীয় পাঠে। আর ‘ধ্বনি’ কবিতা থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন অন্ত্যানুপ্রাস। সে কবিতা চলেছে কিন্তু দু’লাইনের স্তবক-একক মান্য করেই।

‘ধ্বনি’-র ঠিক আগের দু’টি কবিতাও ভুলতে পারা যায় না। তাদের নাম ‘গীতগোবিন্দ’ ও ‘খামার’। সনেটচর্চায় সিদ্ধিলাভ করলেই এ রকম কবিতা লেখা সম্ভব। পাশাপাশি দেখি, একটি কবিতার আরম্ভে রয়েছে এমন বাক্য: “এই পথ থেকে সমস্ত রাস্তার শুরু, এই যে সৈকত এখানে চৈতন্যদেব ভেসে পড়তেন”— এ কবিতা যেন আমাদের জন্মান্তরের সঙ্কেত দেয়। বুঝতে পারি, একাগ্র মনে একটি মোমবাতিকে নিজের রাত্রিঘরে জ্বালিয়ে রাখার কবিতা-সঙ্কল্প এ সংগ্রহে ধরা আছে।

আরও পড়ুন
Advertisement