Book Review

কে ভূমিপুত্র, অভিবাসী কে, কে-ই বা বহিরাগত

দেশভাগ-উত্তর অভিবাসনের ঘটনাটির রাজনীতিকরণ দিয়ে পুরনো ‘জাতি’-আবেগ জ্বালিয়ে তোলা হল বার বার।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:২৭
—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

অসমের বাংলা ও বাঙালি সঙ্কট ইতিমধ্যেই বহু আলোচনার বিষয়। তবে সাম্প্রতিক কালে বিজেপি সরকারের নাগরিকত্ব বিল ও তৎসংক্রান্ত বিতর্ক যে ভাবে বিষয়টিকে অত্যন্ত জরুরি করে তুলেছে, মানবাধিকার হনন ও দেশহীনতার আতঙ্ক তৈরি করেছে, তা স্বাভাবিক ভাবেই এই পুরনো সঙ্কটকে অন্য এক মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। সেই প্রসঙ্গেই বইটি খুব জরুরি। অসম ও সন্নিহিত অঞ্চলে বাঙালি বসতির ঐতিহ্যময় ইতিহাসের রূপরেখা তো এতে বিধৃত বটেই, তার সঙ্গে কেন ও কী ভাবে স্বাধীন ভারতের অসম প্রদেশে বহুসংস্কৃতির আদর্শ থেকে সরে এসে একজাতীয়/একভাষী আদর্শকে প্রধান করে তোলার চেষ্টা হল, নাগরিকপঞ্জি নবায়নের মধ্যে কী ভাবে বিধৃত রইল সেই নবোত্থিত আদর্শ— তার বিশ্লেষণ করেছেন লেখক।

Advertisement

সাধারণত অসমবাসী বাঙালির ইতিহাসে তেমন ভাবে ধরা পড়ে না জাতিগঠনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বময়তার এই বৃহত্তর প্রেক্ষিতটি। অথচ সেই প্রেক্ষিত মনে রাখলে অনেক সহজে বোঝা যায়, আজকের হিন্দুত্ববাদ-অভিষিক্ত ভারতের একটি বড় প্রণোদনা কী ভাবে এই অঞ্চলে অনেক দিন ধরে তৈরি হয়ে উঠেছিল।

অভিবাসন, নাগরিকতা ও আসাম: প্রাক্-উপনিবেশকাল থেকে নাগরিকপঞ্জি নবায়ন সব্যসাচী রায়

৩৩০.০০

বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন

দেশভাগের পরে স্বভাবতই অসমের বাঙালিকে আরও বেশি করে জাতীয়তার এই পরিবর্তনশীল ধারণাটির মোকাবিলা করতে হল। দেশভাগ-উত্তর অভিবাসনের ঘটনাটির রাজনীতিকরণ দিয়ে পুরনো ‘জাতি’-আবেগ জ্বালিয়ে তোলা হল বার বার। এর মধ্যে অবশ্যই রইল পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের অন্তর্গত সিলেট অঞ্চলের সঙ্গে অসমের কাছাড়ের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ছায়া। কাকে বলে ভূমিপুত্র, কে-ই বা অভিবাসী, কিংবা বহিরাগত— সবই অর্থহীনতায় পর্যবসিত হয়ে দাঁড়াল। আসলে অসমকে একটি সমসত্ত্ব প্রদেশ হিসাবে তৈরি করার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল দেশভাগের ঘটনার অভিঘাতেই।

একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক পটভূমিতে সমস্যাগুলিকে তাদের গুরুত্ব অনুযায়ী একে একে এনে যে ইতিহাস এই বইয়ে আলোচিত, তা অনেক ধোঁয়া দূর করে। কেবল দেশভাগ, নাগরিকতা ও আঞ্চলিক সত্তারাজনীতির পড়ুয়াদের কাছে নয়, বৃহত্তর পাঠকবর্গের কাছেও এই বই জরুরি হওয়ার কথা।

ঋতু অবসান: মেয়েদের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা

সম্পা: বাসবী চক্রবর্তী

৩০০.০০

কারিগর

মেয়েদের ঋতুস্রাবের অতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি আমাদের সমাজে যেন অপাঙ‌্‌ক্তেয় ঘটনা। দীর্ঘ দিনই এর সঙ্গে শুচিতার প্রশ্নটি ঘনিষ্ঠ ভাবে জুড়ে ছিল। আজও ঋতুস্রাবের শুরুর দিনটি থেকে শেষ দিন অবধি প্রতিটি পর্যায় ঘিরে মেয়েদের শারীরিক এবং মানসিক ওঠাপড়া, আনন্দ, বিষাদকে মনের গভীর অন্দরে পুঁতে রাখাই যেন এক অলিখিত নিয়ম। এই নিয়ে কথা কইতেও মানা। বিশেষত ঋতুবন্ধের সময়ে নানা পরিবর্তনকে একলা যুঝে চলা, এবং মানসিক ভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়াই এখনও এক বিরাট সংখ্যক মেয়েদের ভবিতব্য। সেই অবসাদও যে এই পর্বের নানা পরিবর্তন-সঞ্জাত, সেই জ্ঞানটুকুই বা থাকে ক’জনের? যেমন থাকে না এই দিনগুলিতে পাশে থাকার, হাত ধরার আশ্বাসটুকুও, অনেক ক্ষেত্রেই। ঋতু-অবসান নিয়ে ভাবনা-চিন্তাগুলোও তাই এখনও অনেকাংশেই অন্ধকারে ঢাকা। সেই ধূলিধূসর ভাবনা-জগতে খানিক ব্যতিক্রমী হাওয়া নিয়ে আসে বাসবী চক্রবর্তী সম্পাদিত ঋতু অবসান: মেয়েদের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা বইটি।

একখানা আস্ত বই শুধুমাত্র ঋতুবন্ধের উপর— ভাবনাটিই যথেষ্ট সাহসী। তারই ছাপ রয়েছে লেখাগুলির মধ্যেও। সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিষ্ঠিত এগারো জন নারী তাঁদের প্রবন্ধগুলিতে সাবলীল ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন ঋতুবন্ধের সময়টিকে। শুধুমাত্র এই সংক্রান্ত কিছু নিষ্প্রাণ তথ্য পরিবেশনের মধ্য দিয়েই নয়, বরং এই পর্যায়কে তাঁরা ব্যাখ্যা করেছেন নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, শারীরবৃত্তীয়, মনস্তত্ত্বের আঙ্গিকে, আবার সম্প্রদায়গত দৃষ্টিকোণ থেকেও। শেষের সঙ্কেতটি তাঁদের বিষণ্ণ, অবসাদগ্রস্ত করে তোলেনি, বরং অনেকেই ঋতুবন্ধের ঘটনাটিকে দেখেছেন ‘মুক্তি’ হিসাবে। প্রৌঢ়ত্বের আগমনবার্তা নয়, বরং নতুন ভাবে বেঁচে ওঠার সুযোগ হিসাবে।

কুমকুম সরকারের প্রবন্ধে উল্লিখিত হয়েছে ভারতের ‘দি ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল অ্যান্ড ইকনমিক রেঞ্জ’-এর সমীক্ষার একটি তথ্য— সারা পৃথিবী জুড়ে যেখানে মেয়েদের রজ নিবৃত্তির স্বাভাবিক বয়স ৪৫-৫৫ বছর, ভারতে প্রায় ৪ শতাংশ মেয়ের মাত্র ২৯-৩৪ বছর বয়সেই রজ নিবৃত্তি হয়। সংখ্যাটি উপেক্ষার বিষয় নয়। অথচ, এ বিষয়ে তেমন সচেতনতা কই? সচেতনতা না থাকার পিছনেও সেই গোপন করার অভিপ্রায়টিই দায়ী। সুতরাং, এমন আরও দৃপ্ত লেখা, এবং খোলাখুলি আলোচনা প্রয়োজন। এই বিষয়ে সচেতনতা বিস্তারে এমন আরও বইয়ের উপস্থিতি প্রয়োজন।

আরও পড়ুন
Advertisement