হাসান আজিজুল হকের লেখা যাঁরা পড়েছেন তাঁরাই জানেন তাঁর গল্প-উপন্যাসের একটা প্রধান ভরকেন্দ্র হল মনন। এর ফলে অনেক সময়ই লেখককে খুব নিষ্ঠুর মনে হয়, আবেগ-থরথর পাঠকের কাছে তিনি দূরবর্তীই থেকে যান। তাঁর মননচর্চার স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ নিদর্শন অসংখ্য প্রবন্ধে ছড়ানো, তাদের বিষয়ও বিচিত্র। চন্দন আনোয়ার নানা বইয়ে ছড়ানো সেই সব লেখা থেকে বাছাই করে পঞ্চাশটি প্রবন্ধ সাজিয়ে দিয়েছেন এই গ্রন্থে। চন্দনের হাসান-চর্চা বহুবিদিত, সম্পাদক হিসেবে তাঁর যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। শুরুতে তাঁর দীর্ঘ লেখাটি হাসানের লেখক-সত্তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ। চন্দন বিষয়-বৈচিত্রের দিকে খেয়াল রেখেছেন, ফলে বইটি হাসানের প্রাবন্ধিক-সত্তার প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে।
হাসানের ভাবনা ও ধ্যানধারণা প্রবল ভাবেই মানবিক ও ইহলৌকিক। তাঁর আলোচনার পদ্ধতি যুক্তিবিন্যস্ত, অনুমানকে তা সিদ্ধান্ত বলে মনে করে না, করাতেও চায় না। আপ্তবাক্যকে চূড়ান্ত বলে মেনে নেওয়া নেই, মনন ও বোধিই তাঁর প্রবন্ধের দিশারি। আত্মসচেতন ব্যক্তি হিসেবেই তিনি শিল্প ও সমাজসচেতনও। তাঁর প্রবন্ধের বিষয় তাই শিল্প সাহিত্য সাহিত্যিক থেকে রাষ্ট্র সমাজ রাজনীতি সবই। এই বইয়ে সম্পাদক অবশ্য কোনও শ্রেণি-অভিজ্ঞান তৈরি করে লেখাগুলি সাজাননি, ফলে লেখার ক্রম একটু অবিন্যস্ত মনে হতে পারে।
পঞ্চাশটি প্রবন্ধ: হাসান আজিজুল হক
সম্পাদনা: চন্দন আনোয়ার
৮০০.০০
একুশ শতক
একটি লেখা আছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে। এ লেখায় হাসান বার বার বলেছেন তিনি কবিতা বোঝেন না, কেবল ভাল লাগা মন্দ লাগাই তাঁর অনুভব। সে কথার সূত্রেই তিনি ত্রিশের দশকের কবিদের কবিতাকে মনে করেন বেশ ধোপদুরস্ত, যেন পদ্মাসনে না বসে পড়াই যাবে না। শক্তির কবিতাকে তাঁর মনে হয়েছিল সহজ ভাষায় বলা। আসলে এ লেখা কবিতা নয়, কবিকে নিয়ে। শক্তির সঙ্গে তাঁর খুব যে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল তা-ও নয়, কিছুটা দূর থেকেই এক ভালবাসা তৈরি হয়েছিল। এ রকম লেখা একটিই, এ ছাড়া সাহিত্য বা শিল্প বিষয়ে এখানে আছে উনিশটি লেখা, এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে আছে সাতটি, নজরুলকে নিয়ে একটিই। আর আছে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কয়েকটি লেখা। পাশাপাশি আছে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে দু’টি লেখা, বাংলাদেশ নিয়েও কয়েকটি। মার্ক্স ও এঙ্গেলস-এর ভাবনার বিচার আছে একটি লেখায়। ‘মার্কস ও এঙ্গেলস: তাঁদের নারীবাদী তত্ত্ব বিষয়ে দু-একটি মন্তব্য’ শীর্ষক লেখাকে মন্তব্য বললেও লেখক বেশ খুঁটিয়েই আলোচনা করেছেন। নারীবাদী তত্ত্বের ইতিহাস মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ‘মার্কসীয় তত্ত্বই বোধহয় তুলনামূলক ভাবে সমস্যাটিকে বুঝতে’ বেশি সহায়ক হতে পারে। আলোচনার সূত্র ধরেই এসেছে সিমোন দ্য বোভোয়ার দ্য সেকেন্ড সেক্স-এর বৈপ্লবিক ভূমিকার কথাও। এই আলোচনাকে তিনি কেবল জ্ঞানচর্চায় আটকে রাখতে চাননি, প্রবন্ধের শেষে বাংলাদেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে মার্কস-এঙ্গেলসের বক্তব্যকে সমস্যা সমাধানের সহায়ক হিসেবেই ভাবতে চেয়েছেন।
হাসানের প্রবন্ধের জোর এইখানেই। কখনওই তিনি তাঁর সময় ও স্বদেশকে বিস্মৃত হন না, তার সঙ্গে মিলিয়েই দেখতে চান সব কিছুকেই। নজরুলকে নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি তাঁর জন্মস্থানের ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্যের আলোচনা করতে দ্বিধা বোধ করেন না, তার পাশেই প্রশ্ন তোলেন বাঙালি সংস্কৃতির স্বরূপ নিয়ে, তার জটিলতা নিয়ে। অথচ এই সমস্ত বহুমুখিনতা সত্ত্বেও তাঁর লেখা এগিয়ে চলে তরতর করে, তাত্ত্বিক প্রতর্কও তিনি সাজিয়ে নিতে পারেন গল্প বলার ঢঙে।
কী ভাবে রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে চান তিনি তার একটা ইঙ্গিত আছে ‘গ্রামের কথকতা: রবীন্দ্রনাথ’-এ। রবীন্দ্রনাথের গ্রাম দেখার প্রক্রিয়াটি তিনি বুঝতে চেয়েছেন এই ভাবে: “আমি দেখতে চেষ্টা করি তার গল্পগুলোর দিক থেকে।” স্রষ্টাকে তার সৃষ্টির দিক থেকে বিচার করতে চান তিনি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ, এবং আধুনিক, কেননা বাংলা ভাষা আর উপমহাদেশের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে “রবীন্দ্রনাথ এখনও চিন্তায়, ভাবনায় সবচাইতে প্রাণরস কবি, রাজনৈতিকভাবে সবচাইতে সচেতন কবি।” শেষের কথাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ— রবীন্দ্রনাথ ও হাসান দু’জনকেই বোঝার পক্ষে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস— এই তিন জনকে নিয়ে লেখা এখানে সঙ্কলিত। মানিকের ভাষারীতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক বাস্তববাদ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন, মনে করিয়ে দিয়েছেন বাস্তবের কোনও একমাত্রিক চেহারা হয় না। পাঠক হয়তো একমত হবেন না, তবু মানিকের প্রতি সমস্ত শ্রদ্ধা অটুট রেখেই তিনি মানিকের ফুরিয়ে যাওয়া ও তাঁর শেষ দিকের লেখায় ভাষারীতির দৈন্যকে চিহ্নিত করেন। বাংলা সাহিত্যে ভাবালুতার আধিক্যের বিপরীতে ইলিয়াসের লেখার তীব্র ঝাঁঝ বা কটু স্বাদের কথা মনে করিয়ে দেন হাসান, সেই সঙ্গে মনে করান সেই ঝাঁঝ বা কটুত্বে অসত্য কিছু নেই, এটাও মানুষের জীবনেরই অংশ। সমকালীন ও বন্ধু এক সাহিত্যিকের লেখায় যা তাঁর ত্রুটি মনে হয়েছে সেটা বলতে কোনও দ্বিধা করেননি লেখক। মার্কেসকে তিনি দেখেছেন লাটিন আমেরিকার ইতিহাসের কথক হিসেবে, সেই মহাদেশের বাস্তবতা কেন আমাদের চেনা বাস্তবতা বা ইউরোপীয় বাস্তবতা থেকে আলাদা হয়ে যায়, সেই বিশ্লেষণের শেষে তিনি মার্কেসে পৌঁছন— এ ছাড়া মার্কেসকে বোঝা সম্ভব নয়।
ভাষা বা সাহিত্য ছাড়াও সামগ্রিক ভাবে সংস্কৃতি নিয়েই চিন্তাভাবনা আছে কয়েকটি লেখায়, সে ভাবনা কখনও তিক্ত হতাশায় ভরা, যেমন ‘বাঙালি সংস্কৃতির কী হবে’-তে। সংস্কৃতির চিহ্ন বলতে যা বোঝায় তার অনেক কিছুই প্রতীকী হয়ে দাঁড়িয়েছে— যেমন পয়লা বৈশাখে পান্তা খাওয়া, অট্টালিকার সামনে দোচালা বানানো। এর সঙ্গে জীবনের যোগ নেই। যা লুপ্ত হয়ে গিয়েছে তাকে ফিরিয়ে আনার কথা বলেন না তিনি, কিন্তু বলেন ‘জীবনের চিরন্তনতা ও সৃষ্টিশীলতা প্রকাশে আয়ুষ্মান’ যা তার থেকে ‘বর্তমানের নিভন্ত প্রদীপগুলি’ জ্বালিয়ে নেওয়ার কথা। ‘বাঙালি সংস্কৃতি: গ্রহনবর্জনের সংকট’ প্রবন্ধে সঙ্কটকে তিনি বুঝতে চেয়েছেন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। ধর্ম ও মৌলবাদের টানে সংস্কৃতির কী হাল দাঁড়িয়েছে সেটাই তাঁর ভাবনার বিষয়। এরই জের ধরে আসে ‘সংস্কৃতির ভাগবাঁটোয়ারা’ লেখাটি। দীর্ঘ উত্তরাধিকার বহন করেও সমকালের বদলে-যাওয়া পরিস্থিতিতে অতীতের সঙ্গে বিচ্ছেদের কথাও মনে রাখতে চেয়েছেন তিনি। ‘সংস্কৃতি কী আছে তোমার পেটিকায়’ প্রবন্ধে তাঁর স্বরে কিছু ক্রোধের আভাস। সংস্কৃতি বলতেই যে ভাসা-ভাসা কথা বলা হয় তাকে নস্যাৎ করে দিয়ে লেখক মনে করিয়ে দেন হাজার বছরের নানা পর্যায়ের নানা স্তরের জাগতিক জীবন বিন্যাস খুঁটিয়ে না দেখলে’ কবিতা সঙ্গীত পোশাক খাবার কোনও কিছুই বোঝা যায় না। খণ্ডকালের পরিধিতে সংস্কৃতিকে বাঁধতে যাওয়ায় তাঁর প্রবল আপত্তি।
ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি, যা নিয়েই লিখুন, সেখানে দেশ সমাজ ও রাষ্ট্র আসবেই, তিনিই নিয়ে আসেন। তাঁর সব লেখাতেই এদের আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টি থাকে। দেশ বা রাষ্ট্র প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য অন্য প্রসঙ্গের মতোই ঋজু ও তীক্ষ্ণ। প্রবল শক্তিধরের সমালোচনা করতেও কোনও দ্বিধাই করেননি। এমন নির্মোহ নিরাবেগ তাঁর লিখনভঙ্গি, যুক্তির স্তরগুলি সংহত। নিজে সিদ্ধান্তে পৌঁছন, কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার কোনও চেষ্টাই নেই।
ঋজু গদ্যের আপাত-সারল্যের অন্তরালে থেকে-যাওয়া যুক্তির তীক্ষ্ণতা আর কথোপকথনের টান-টান ভঙ্গি হাসানের প্রবন্ধকে গরীয়ান করে তুলেছে।