সাড়ে সাত দশক কেটেছে, দেশভাগ নামক সেই ভয়াবহতা নিয়ে রাজনীতিকরা এখনও যথাসাধ্য রাজনীতি করছেন। দেখেশুনে মনে পড়ে, কুড়ি বছর আগে দেশভাগের হিংসার ইতিহাস লিখতে গিয়ে ইতিহাসবিদ জ্ঞান পান্ডের সতর্কীকরণ: রাজনীতি যে ভাবে এ দেশে সমাজ আর সমাজস্থ মানুষকে পাল্টাচ্ছে, তাতে ক্রমশই হিংসার একটা গভীরতর ও ব্যাপকতর পরিমণ্ডল তৈরি হয়ে উঠছে। হিংসা বিষয়টি আগের চেয়ে বেশি ‘স্ট্রাকচারড’ বা গাঠনিক হচ্ছে, তার গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি হচ্ছে— কেননা এখন সেই হিংসার পিছনে থাকছে রাষ্ট্রিক কিংবা সামাজিক ভাবে স্বীকৃতি কাঠামোগুলি নিজেরাই।
জ্ঞান পান্ডে দেখিয়েছিলেন, কেমন করে নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা এক দিকে আগের কমিউনিটি বা কৌম-কে ভেঙে ব্যক্তিকে ‘অ্যাটমাইজ়’ বা এককে পরিণত করছে, আবার একই সঙ্গে ব্যক্তির উপর নিজের এমন এক দমনমূলক সম্পর্ক তৈরি করছে যাতে ব্যক্তি আবার ঘুরেফিরে কৌম, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের দ্বারস্থ হয় আশ্রয়, প্রতিকার বা প্রতিবাদের তাগিদে। আর এই পুরো বৃত্তাকার প্রক্রিয়াটার মধ্যে মিশে থাকছে দ্বন্দ্ব আর হিংসা। এই ‘উন্নততর’ হিংসার সঙ্গে সঙ্গত করতে অবশ্যই থাকছে উন্নততর প্রযুক্তি। সব মিলিয়ে, "...this [political climate] has allowed genocidal murder and violence on an unprecendented scale."
আলোচ্য বইটির উপশিরোনাম ‘ম্যাপিং দ্য ডেডলি ফল্ট লাইনস উইদিন ইন্ডিয়ান সোসাইটি’ দেখে এই গোড়ার কথাটা মনে পড়ল। নীরা চান্দোক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক, তিনি বিষয়টিকে সরাসরি রাষ্ট্রিক জায়গা থেকেই ধরতে চেয়েছেন। প্রথম বাক্যেই উঠে এসেছে ‘উই দ্য পিপল অব ইন্ডিয়া’র কথা। কী ভাবে ব্যক্তিনাগরিকের মধ্যে তৈরি হয় হিংসার ‘ট্রিগার’ বা ফুলকি? কী ভাবে তৈরি হয় ‘আদার’ বা অপর-এর ধারণা, যার উপর হিংসা ভর করে দাঁড়ায়? কী ভাবে ‘কালেকটিভ সাইকি’ বা গণমানসে তৈরি হয় একটা ভাবাদর্শ যা সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রবাহ বইয়ে দেয়?
দ্য ভায়োলেন্স ইন আওয়ার বোনস: ম্যাপিং দ্য ডেডলি ফল্ট লাইনস উইদিন ইন্ডিয়ান সোসাইটি
নীরা চান্দোক
৬৯৯.০০
আলেফ
মজার কথা, ভারতকে বাইরের দুনিয়া যাঁদের জন্য এক ডাকে চেনে, তাঁদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু হিংসার বিরোধিতা করেই বিখ্যাত। যেমন, গৌতম বুদ্ধ, অশোক, মহাত্মা গাঁধী। এমনকি আমাদের মহাভারতও শেষ পর্যন্ত হিংসার অসারতার কথা বলেই মহা-কাব্য। অথচ ভারতের ইতিহাস, বিশেষত সাম্প্রতিক ইতিহাস, বলে দেয় এই দেশের পরতে পরতে হিংসা রীতিমতো স্থায়ী, প্রোথিত, অলঙ্ঘ্য। ভারতের পার্টিশন থেকে চান্দোকের আলোচনা শুরু। তার পর সাম্প্রদায়িক হিংসার পরবর্তী ধারা। পরবর্তী অধ্যায়, জাত-ভিত্তিক হিংসার ধারা। তার পর কাশ্মীর, এবং উত্তর-পূর্ব ভারত। আর সব শেষে, মাওবাদী আন্দোলন। এই বিন্যাসে তিনি ধরতে চেয়েছেন স্বাধীন দেশের মজ্জাগত হিংসার চরিত্রটি।
এতগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কি নতুন আলো ফেলল অধ্যায়গুলি? দেশভাগ সম্পর্কে নতুন কিছু পাওয়া গেল না এই বইতে, দুর্ভাগ্য। কী ভাবে স্মৃতিতে ধরা ছিল সেই সময়ের হিংসাপর্ব, সাহিত্যে বিধৃত ছিল সেই অকল্পনীয় আর অকথনীয়, তার পর কী ভাবে ইতিহাস তা বার করে আনল ক্রমে, এবং কী ভাবে ভারতীয় মানসভূমিতে চিরকালীন স্থান করে নিল হিন্দু-মুসলিম হিংসার চিত্রপট— জানা কথাগুলিই গুছিয়ে বলেছেন চান্দোক। ধর্ম দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা বোঝা যায় না, রাষ্ট্রযন্ত্রের কৃৎকৌশলের পথেই বুঝতে হয় তাকে: এই গুরুতর কথাটা অবশ্য যত বার বলা যায় ততই ভাল। দেশভাগের বাস্তব ও স্বাধীন ভারতে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও হিংসার বাস্তব, পর পর দু’টি অধ্যায়ের যোগসূত্রটি এইখানেই। আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে হিংসার যোগটি বলতে গিয়ে চান্দোক যে ভাবে মহাত্মা গাঁধীর সাবরমতী আশ্রমের স্থান নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে আসেন, তা এক কথায়— অনবদ্য। গুজরাতের এই অঞ্চলটি ঐতিহ্যগত ভাবে বস্ত্রবয়নের কেন্দ্র, প্রাচীন যুগেও তাঁতি সমাজের বাস এখানে, যে সমাজের মধ্যে ধর্ম-জাত-গোষ্ঠী সব মিলেমিশে একটা ‘গিল্ড’-এর অস্তিত্ব ছিল। এই যে প্রাক্-আধুনিক কৌম, এর মধ্যেই নিশ্চিন্ত লেগেছিল গাঁধীর, হিংসার উৎস যে দ্বন্দ্বাত্মক ‘অপর’ত্ব বা ‘আদারনেস’, তাকে অনেক দূরবর্তী বলে মনে হয়েছিল তাঁর, তাই অহিংসার আরাধনার এখান থেকেই শুরু। ২০০২ সালের গুজরাত হিংসা কি তবে তাঁর সেই ভাবনার শিকড়কেই ভুল প্রমাণ করল? নাকি ইতিমধ্যে পাল্টে গিয়েছিল সমাজের গতিবিধি? চান্দোকের আলোচনার মধ্যে বেরিয়ে আসে, একুশ শতকে কী ভয়ানক ভূমিকা পালন করেছিল সেখানকার নিষ্ক্রিয় নাগরিক সমাজ, যার মধ্যে এই ঐতিহ্যের শিকড় চারিয়ে থাকার কথা।
জাত-সমাজের হিংসার ক্ষেত্রেও ঘুরে আসতে হয় নাগরিক সমাজের ব্যর্থতাতেই। এবং একে ইন্ধন দিতে নিয়ত প্রস্তুত নিষ্ক্রিয় আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা এবং বিচারের মঞ্চ। হিংসা তো কেবল হত্যা বা ধর্ষণ নয়: অবিচার, অবমাননা, প্রান্তিকীকরণ, সবই এর বিবিধ প্রকরণ। কে না জানে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির স্তরে স্তরে কী ভাবে এই হিংসা বিধৃত। পরোক্ষে, এমনকি প্রত্যক্ষেও, তা সাহস জুগিয়ে যায় সমাজের অভ্যন্তরের হিংসাত্মক ভাবনা ও কাজকর্মকে। আনন্দ তেলতুম্বডের কথা তুলে আনেন চান্দোক এই প্রসঙ্গে: কেন তাঁর মতো চিন্তক শাসক প্রতিষ্ঠানের শত্রু হয়ে যান। শেষ অবধি গাঁধীর বিপরীতে আম্বেডকরের পাশে এসেই দাঁড়ান চান্দোক: দলিতের প্রতি হিংসাকে কেবল সামাজিক সমস্যা বলে দেখা ভুল হবে, এটা একটা রাজনৈতিক সমস্যা। যে ভাবে ভারতীয় রাজনীতিতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হল তাদের হাতে, যারা "a hostile majority, which believes in the denial of liberty and equal opportunity to the minority"— অর্থাৎ যারা হিংসার কোনও শেষ ঘটাতে অক্ষম তো বটেই, অতি অনিচ্ছুকও।
কাশ্মীর, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং জনজাতি-অধ্যুষিত মাওবাদী অঞ্চল, পরবর্তী প্রতিটি অধ্যায়েই এই ক্ষমতা-দর্পণের প্রত্যক্ষ ছায়া। ‘সংখ্যালঘু’, কিংবা সংখ্যালঘুর পর্যায়ে উপনীত জনগোষ্ঠীর অবদমনের কাহিনি। এইখানে খুব দক্ষতার সঙ্গে ফ্রানজ় ফ্যাননকে নিয়ে আসেন চান্দোক। ফ্যাননই তো প্রথম এত স্পষ্ট ভাবে বলেছিলেন, উপনিবেশ-শক্তির দেখাদেখি ঔপনিবেশিক সমাজ কী ভাবে হিংসাকে নতুন করে ধারণ করে, তার বাহক হয়ে উঠে নিজের ক্ষমতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা চায়: ভায়োলেন্স কী ভাবে উপনিবেশের মানুষকে আত্মমর্যাদা দিতে পারে, কী ভাবে তাদের ‘ম্যানহুড’কে হিংসার পথে পুনঃপ্রতিষ্ঠা এনে দেয়। তিনি বলেছিলেন পোস্ট-কলোনিয়াল আফ্রিকার কথাই। কিন্তু প্রেক্ষিতভেদেও যে কত সত্য উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ও সমাজের এই চরিত্রচিত্রণ, ভেবে চমকে উঠতে হয়।
একটাই খুঁতখুঁতানি। ভারতের মতো দেশে গণতন্ত্রের সঙ্গে এই হিংসা-কাঠামোর সংযোগ গভীর, একই ‘স্পেস’ তারা এক সঙ্গে অধিকার করে থাকে, একাধিক বার এই উল্লেখ আছে এই বইতে। কিন্তু কেন এমন হয়, তার তেমন ব্যাখ্যা নেই। যে সব দিশা ইতিমধ্যেই জ্ঞান পান্ডে, আশিস নন্দী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সুদীপ্ত কবিরাজের মতো চিন্তকরা দিয়েছেন, তার আলোচনা নেই। থাকা জরুরি ছিল।