ত্রাতা: বিদ্যাসাগর ও বঙ্গবিধবারা, বাহাদুর চিত্রকরের আঁকা পটচিত্রে। ছবি সৌজন্য: চালচিত্র অ্যাকাডেমি।
দেশমাতৃকার সধবা, সালঙ্কারা উজ্জ্বল দেবীমূর্তি ছিল ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রাণস্পন্দন। কিন্তু সমসময়ে দেশের আরও একটি দেবীমূর্তি জনমানসে জায়গা করে নিচ্ছিল— দশমহাবিদ্যার সপ্তম রূপ ধূমাবতী। তাঁর পরনে মলিন শ্বেত বসন, রুক্ষ চুল, অপুষ্ট, পরিশ্রান্ত দেহ। সধবা দেবীমূর্তির প্রাচুর্যের তুলনায়, ধূমাবতী রূপের ভারাক্রান্ত কঠোরতা সমাজে সধবা-বিধবা বৈপরীত্যকেও উদ্ঘাটিত করে। জাতীয়তাবাদী ভাষ্যে অমঙ্গল ও অপবিত্রতার সঙ্কেত থেকে দেশের দুরবস্থার মূর্ত প্রতীক ধূমাবতী, সমাজে বিধবার এই রূপান্তরকেই চিত্রিত করে। জাতীয়তাবাদী কল্পনায় বিধবার কৃচ্ছ্রসাধনা, আত্মসংযম ও ত্যাগ তাঁকে যেন এক পূর্ণ সত্যাগ্রহীর মর্যাদা প্রদান করে। ঐশিকা চক্রবর্তীর বইয়ের প্রচ্ছদে ধূমাবতীর ছবিটি তাই তাৎপর্যপূর্ণ। ঔপনিবেশিক বাংলায়, বিশেষত ১৮৫০-১৯২০ সময়পর্বে, হিন্দু নারীর সত্তা নির্মাণ ও নারীত্বের জাতীয়তাবাদী প্রতর্ক— এই বৃহত্তর প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে ঐশিকার বইটি বিধবা-সমস্যা ও বৈধব্যের বিভিন্ন ভাষ্যের একটি সুবিবেচনাপূর্ণ গবেষণাভিত্তিক পুনর্মূল্যায়ন।
প্রাচ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক জ্ঞান-প্রকরণ হিন্দু শাস্ত্রীয় ঐতিহ্যকে একটি বিশেষ অবয়ব প্রদান করেছিল। ফলস্বরূপ, ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের প্রথম কয়েক দশক জুড়ে এই ছাঁচের মধ্যেই হিন্দু বিবাহ সংক্রান্ত যাবতীয় আলোচনা ও বিতর্কের প্রবাহ দেখা যায়। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সমাজ ও ধর্মসংস্কার প্রসঙ্গে জনপরিসরে যে দীর্ঘমেয়াদি বিতর্কের সঞ্চালন হতে থাকে, তার কেন্দ্রে ছিল ‘নারী’, ‘গৃহ’ ও ‘সংসার’। এই আলোচনার সিংহভাগই ছিল হিন্দু-উচ্চবর্ণ সমাজ সংক্রান্ত। জনপরিসরের আলোচকরাও প্রধানত ইংরেজ তাত্ত্বিক এবং দ্বিভাষিক, উচ্চশিক্ষিত, বৃত্তিধারী, সবর্ণ হিন্দু এবং ব্রাহ্ম ‘ভদ্রলোক’ গোষ্ঠীর— পাশ্চাত্যের আলোকপ্রাপ্তির যুগের যুক্তিতত্ত্ব ও উদারনৈতিক মত দ্বারা উদ্বুদ্ধ। কিন্তু এঁদের বেশির ভাগই আবার পুনরুজ্জীবিত নবহিন্দুত্বে অনুপ্রাণিত ছিলেন। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের কিছু শাসননীতি এবং বিভিন্ন কারণে কৃষিজমি থেকে কমতে থাকা আয় ক্রমশ এই স্বত্বভোগী শ্রেণির সামাজিক অবস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছিল। অতএব এঁদের সামাজিক বয়ান ক্রমাগত আত্মরক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে উঠছিল। হিন্দু পুনরুত্থানবাদী জাতীয়তাবাদের সূচনাটিও এখানেই। ব্রাহ্মণ্যবাদী অনুশাসনে আবদ্ধ উচ্চবর্ণের সংসারজীবন, যার কেন্দ্রবিন্দু নারী ও তার বিভিন্ন ভূমিকা— কন্যা, পুত্রবধূ, স্ত্রী ও মা— হয়ে উঠল নেশন বা জাতির প্রতিরূপ। তাই নারীর মর্যাদারক্ষা, হিন্দু জীবনযাপন ও ধর্মের রক্ষা, এবং দেশরক্ষা— এই ত্রয়ী অভিন্ন সূত্রে বাঁধা পড়ল।
ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের দ্বারা সতীদাহ প্রথা রদ, বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়ন এবং বিভিন্ন পর্যায়ে মেয়েদের বিবাহের ও সম্মতির বয়স বৃদ্ধির আইনি প্রচেষ্টা দেশীয় সমাজে বড়সড় রদবদল আনে। হিন্দু সনাতনপন্থী পিতৃতন্ত্র এতে এক ঘোর অমঙ্গলের ইঙ্গিত দেখতে পায়। এই কারণে, ধর্ম ও সমাজ রক্ষার্থে তার মুখ্য অস্ত্র হয়ে ওঠে রক্ষণশীলতা। এই রক্ষণশীলতার প্রধান ক্ষেত্র সবর্ণ হিন্দু গৃহ। ধর্মানুশাসন অনুসারে অনুষ্ঠিত বিবাহই এই গৃহ, সংসার তথা দেশীয় হিন্দু সমাজের ভারসাম্য রক্ষার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়াল। তাই রক্ষণশীল পিতৃতন্ত্র, বিবাহের ক্ষেত্রে সংস্কার আইনের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপের প্রবল বিরোধিতা শুরু করল। ১৮৬০-এর দশক থেকে বিধবাবিবাহ প্রচলন আইনকে কেন্দ্র করে জনপরিসরে এই অসহিষ্ণুতা প্রকাশের তীব্রতা বাড়তে থাকে।
উইডোজ় অব কলোনিয়াল বেঙ্গল: জেন্ডার, মোরালিটি অ্যান্ড কালচারাল রেপ্রিজ়েন্টেশন
ঐশিকা চক্রবর্তী
১৭৯৫.০০
প্রাইমাস বুকস
লেখিকা বৈধব্যদশা, বিধবার সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা ও তাঁদের পুনর্বিবাহ সংক্রান্ত ভাষ্যগুলিকে পৃথক বিষয় হিসাবে চিহ্নিত না করে, উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ্যবাদী অনুশাসনে আবদ্ধ হিন্দুবিবাহ নামক বৃত্তের অংশ হিসাবেই দেখেছেন। ঔপনিবেশিক বাংলায় বিধবা সমস্যাকে উদারনৈতিক সংস্কারবাদী বয়ান ও পুনরুত্থানবাদী জাতীয়তাবাদের বয়ান— এই দুই পরস্পরবিরোধী প্রবণতার সংঘর্ষের মধ্যে স্থাপন করেছেন। বইটিতে তিনি দেখাচ্ছেন কী ভাবে ঔপনিবেশিক আমলে বিধবা সমস্যা, অর্থাৎ বিধবাদের যৌনতা ও তার সামাজিক নিয়ন্ত্রণ— ইংরেজ সরকার এবং দেশীয় সমাজের নেতৃবৃন্দ, উভয়ের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। বিধবাকে নিয়ে সামাজিক আতঙ্কের দু’টি স্তর লেখিকা দেখিয়েছেন। প্রথম: জাতি ও সমাজ, যার মূল নিয়ন্ত্রণকারী ব্রাহ্মণ্যবাদী অনুশাসন, এবং দ্বিতীয়ত, সরকারি তরফে সমাজনীতি, জনস্বাস্থ্য ও আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ।
হিন্দুবিবাহ সংক্রান্ত আইনগুলি (বিশেষত, ১৮৫৬-র বিধবাবিবাহ আইন) বিবাহ ও সংসারকে নারীর উপর পিতৃতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের একটি বৈধ ক্ষেত্র হিসাবে নিয়োজিত করে। এমনকি, বিদ্যাসাগরের কাছেও নারীর যৌনতা নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় শাস্ত্রসম্মত পুনর্বিবাহ। আবার রক্ষণশীল সমাজের কাছেও ব্রহ্মচর্যের অনুশীলনই বিধবার যৌনতাকে শৃঙ্খলিত করার একমাত্র পথ। এই সনাতনপন্থীদের একাংশ বিধবা বিবাহ আইনে শর্তসাপেক্ষে সমর্থন করেন; তাই ১৮৫৬-তে শুধু অক্ষতযোনি বালিকা বিধবাদেরই পুনর্বিবাহ আইনসম্মত করা সম্ভব হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে লেখিকা দেখাচ্ছেন, কী ভাবে নারীর দেহের নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে জনপরিসরে বহুমুখী ভাষ্য তৈরি হচ্ছে। রক্ষণশীল গোষ্ঠীর কাছে সবর্ণ হিন্দুর দশকর্মের মধ্যে বিবাহই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাঁদের সামাজিক বয়ানে বিধবার ব্রহ্মচর্য প্রবল ভাবে সমর্থিত হতে দেখা যায়। সমসাময়িক সমাজমাধ্যমে (প্রধানত পত্রপত্রিকা, সংবাদপত্র ও থিয়েটার) বিধবা সমস্যা সংক্রান্ত বিতর্ক সবর্ণ হিন্দু সংসারে বৈবাহিকতা, দাম্পত্য, শাস্ত্রীয় রীতিনীতি এবং প্রচলিত দেশাচারের একটা সার্বিক ভাষ্যের মধ্যেই নির্মিত হতে দেখা যায়। লালমোহন বিদ্যানিধি, নগেন্দ্রনাথ বসু ও দুর্গাচরণ সান্যালের মতো পণ্ডিতগণ তাঁদের কৌলীন্যপ্রথা, গোত্র ও কুল মর্যাদা সংক্রান্ত গবেষণাভিত্তিক রচনাদ্বারা দেশীয় সমাজব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের একটি বিশিষ্ট ধারার সূত্রপাত করেন। আবার এই একই জনপরিসরে সধবার একাদশী, বিয়েপাগলা বুড়ো-র মতো ব্যঙ্গরচনার প্রাচুর্যও চোখে পড়ার মতো। বিধবাবিবাহ নিয়ে সমসাময়িক সমাজে বহু স্বরের অস্তিত্ব ও বৈচিত্র লেখিকা ফুটিয়ে তুলেছেন।
ঔপনিবেশিক বাংলার বৈচিত্রময় ও বহুস্তরীয় সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে লেখিকা দেখান, বিধবা নারী এক দিকে যেমন পিতৃতন্ত্রের শোষণ ও নিয়ন্ত্রণের শিকার, ঠিক তেমনই তিনি ক্ষেত্রবিশেষে মৃত স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে একক যোদ্ধা। শেষ অধ্যায়ে জানবাজারের রানি রাসমণি এবং কাশিমবাজার রাজপরিবারের রানি স্বর্ণময়ীর পিতৃতন্ত্র ও কোম্পানির বলপ্রয়োগের মোকাবিলা এবং তাঁদের সমাজসেবার আখ্যান, বইটির জোরালো অংশগুলির একটি। অন্য দিকে, শিক্ষিত বৃত্তিধারী পরিবারের মেয়ে, লোরেটো কনভেন্টে পড়া স্নেহলতা গুপ্তের বৈধব্যের প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াইয়ের কাহিনিটিও সাফল্যের আখ্যানগুলোর একটি। দার্জিলিঙের মহারাণী গার্লস স্কুলে শিক্ষকতা করে পাঁচ সন্তানকে মানুষ করেছিলেন স্নেহলতা।
তবে, অধিকাংশ বিধবা মেয়েদের অবস্থাই ছিল অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত। বইটির সবচেয়ে মর্মস্পর্শী অংশটিতে লেখিকা বিধবাদের নিজস্ব বয়ানগুলোর মাধ্যমে তাঁদের অধিকারচ্যুত হওয়ার গল্প, দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা এবং তাঁদের প্রতিরোধের আখ্যান সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। কৈলাসবাসিনী দেবী, সারদাসুন্দরী দেবী এবং নিস্তারিণী দেবীর মতো অভিজাত হিন্দু ও ব্রাহ্ম পরিবারের বিধবাদের স্মৃতিকথা; কল্যাণী দত্তের পিঞ্জরে বসিয়া-য় উল্লিখিত, কাশীর বিধবা ওয়র্ডে থাকা, মানসিক ভারসাম্যলুপ্ত ইন্দুমতীর জীবনবৃত্তান্ত; বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাশীবাসী দ্রবময়ীর আখ্যান বা হৈমবতী সেনের কাশীবাসের অভিজ্ঞতা— প্রত্যেকটি প্রাথমিক বিবৃতি পাঠে লেখিকার মুনশিয়ানা প্রশংসার দাবি রাখে।
বইটি মানবীবিদ্যা-কেন্দ্রিক সামাজিক ইতিহাসচর্চার একটি বিশদ পর্যালোচনা, যা কলেজপড়ুয়া ও গবেষক, উভয়েরই ব্যবহার্য। সাবলীল ভাষায় ঔপনিবেশিক সমাজ সংক্রান্ত বহু জটিল ধারণা লেখিকা দক্ষতার সঙ্গে আলোচনা করেছেন।