Bengali Short Stories

ছাইভস্ম জীবনের ইউনিকোড

জীবন সহজ নয়, একমাত্রিক বা একস্তরীয় নয়। তা বহুস্তরিক, বহুমাত্রিক এবং জটিল। সেই বহুস্তর, বহুমাত্রার জটিলতাকে ধরার চেষ্টা হচ্ছে গল্প। সেই চেষ্টা এক-এক জনের ক্ষেত্রে এক-এক রকম।

Advertisement
তৃষ্ণা বসাক
শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:২৩
—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

শরৎকুমারী চৌধুরানীর শুভবিবাহ উপন্যাসের আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “বনের আনন্দের অধিকাংশই এইরূপ অত্যন্ত সহজ এবং সামান্য জিনিস লইয়াই তৈরি। আকস্মিক, অদ্ভুত, অপূর্ব আমাদের জীবনে দৈবাৎ আসিয়া জোটে। তাহার জন্য যে বসিয়া থাকে বা খুঁজিয়া বেড়ায় তাহাকে প্রায়ই বঞ্চিত হইতে হয়।” এই সহজ, সামান্য, আকস্মিক এবং বিনা আয়াসে জুটে যাওয়া আনন্দ: সব কিছু পর পর বসালে কখন যেন একটা সার্থক ছোটগল্পের জায়মান রন্ধনপ্রণালী পাওয়া যায়। তাই পার্পল রঙের সামান্য পর্দার কাপড় আমাদের ভিতরঘরের চুনবালি-খসা দেওয়াল, মলিন ছাপছোপ ঢাকার বদলে তাকে জনসমক্ষে তুলে ধরে, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের মনের কোনায় জমে থাকা ময়লা। আমরা চমকে উঠে দেখি, এই তা হলে আমাদের সত্যিকারের চেহারা! বোঝা যায়, “পর্দাগুলো কিন্তু টাঙ্গানো সার। এতটুকু মানাচ্ছে না। মনে হচ্ছে জরাগ্রস্ত বুড়ি মেয়েলোকের গায়ে জড়োয়া গয়না।” (পর্দার কাপড়)

Advertisement

জীবন সহজ নয়, একমাত্রিক বা একস্তরীয় নয়। তা বহুস্তরিক, বহুমাত্রিক এবং জটিল। সেই বহুস্তর, বহুমাত্রার জটিলতাকে ধরার চেষ্টা হচ্ছে গল্প। সেই চেষ্টা এক-এক জনের ক্ষেত্রে এক-এক রকম। কেউ হয়তো ঘটনাধর্মিতায় যান, কেউ বিমূর্ততায়, কেউ সমগ্র ধরেন, কেউ একটা মুহূর্ত, কেউ পরীক্ষানিরীক্ষা ভালবাসেন, কেউ সহজ ন্যারেটিভে গল্প বলেন। বাইশ গজের খেলায় যেমন খেলতে সবাই নামেন, যে যার মতো করে, শেষ পর্যন্ত উদ্দেশ্য তো ব্যাটে-বলে হওয়া, অর্থাৎ কমিউনিকেশন। লেখককে কোথাও গিয়ে পাঠকের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে হয়। বিষয়বস্তু, আঙ্গিক, ভাষা, কমিউনিকেশনের এই তিন মাত্রা। চতুর্থ মাত্রা হচ্ছে লেখকের হাতের তাগবাগ, যাকে বলে ‘এক্স ফ্যাক্টর’।

“চুক্তি চুক্তি চুক্তি। শুনতে শুনতে কান পচে গেল। শুকদেব ওর এই শ্রমিক জীবনের অভিজ্ঞতায় জানে কোন চুক্তিই প্রকাশ্যে হয় না। চুক্তির তলায় আর একটা চুক্তি হয়, তার তলায় আর একটা। সবার সামনে কোনটা আসে তা শুধু মালিক, ইউনিয়নের নেতারা আর কিছু তাঁবেদার জানতে পারে। বাদবাকিরা সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট হবার মাঝামাঝি জায়গায় থাকে। চুক্তি থেকে প্রাপ্তি নিয়ে তাদের আনন্দ রাগ অভিমান একদিন ফিকে হয়ে আসে।” (অন্ধকারে বাঁচার লড়াই)

এ হচ্ছে মাঝামাঝিদের দুনিয়া। যেখানে সুখ তত গাঢ় নয়, দুঃখ তত চেপে বসতে পায় না। কারণ জীবন থেকে প্রত্যাশাও মাঝারি মাপের। সুখ-দুঃখের চেহারাও যেন বড় চেনা। তার মধ্যে এক-একটা দিন হঠাৎ অন্য রকম। বৃষ্টির সন্ধেয় বাড়ি ফিরতে ফিরতে তারে হাঁটা বৃষ্টির ফোঁটায় আলো পড়ে আচমকা তৈরি প্রিজ়মের মতো। হর্ষ দত্তের গল্পের ভুবন ওই রকম চাপা আলোয় ভরা। এই আলোয় হঠাৎ-হঠাৎ চোখে পড়ে এক-একটা চরিত্র, যাদের আমরা কখনো চেয়ে দেখার দরকার মনে করি না। যেমন অন্নগাছির পলা, ঝিনুক, শেলি— সমাজ যাদের নষ্ট মেয়ে বলে দেগে দিয়েছে, তারা কিসের টানে তাদের সহকর্মিণী, করোনা-আক্রান্ত বিন্দু সাহেবাকে দেখতে রোজ হাসপাতালে আসে? বিন্দু মরার আগে ওদের বলে, “আমাদের সোনাগাছি যেন মরে না যায়। এই রোগ যেন সোনাগাছির কারো না হয়। তোরা সবাই... রুখে দাঁড়াবি তো?”

সেরা পঞ্চাশটি গল্প হর্ষ দত্ত

তৃষ্ণা বসাক

৪৯৯.০০

দে’জ়

সোনাগাছি নয়, অন্নগাছি। কারণ তা অন্ন জোগায়। এই ‘অন্নগাছি’ গল্পটি যেমন অতিমারির সময়ে সব থেকে বিপন্ন পেশাগুলির অন্যতম যৌনকর্মীদের জীবনে আলো ফেলেছে, তেমনই দেখিয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তি কী ভাবে এই সময়ে মেয়েদের বলভরসা হয়ে উঠেছে, তাদের ক্ষমতায়ন করেছে। বিন্দুর অসুখের খবর পাওয়া থেকে, তাকে হাসপাতালে ভর্তি এবং তার পরে তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, অতিমারির সময়ে এই কাজগুলি শেলি, পলারা করতে পেরেছে ছোট্ট একটা মোবাইল ফোনের সাহায্যে। এদের একেবারে বিপ্রতীপে অবস্থান নামকরা স্কুলের ভূগোলের শিক্ষিকা কৃষ্ণকলির। তিনি নিজের উপর বিরক্ত হয়ে ওঠেন কিছুতেই ইউনিকোডে টাইপ করা শিখতে পারছেন না বলে। ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ তাঁকে নিঃসঙ্গ করে দিচ্ছে। যদিও পরে তিনি উপলব্ধি করেন, “ভালবাসার মতো ইউনিভার্সাল আর কিছু নেই। যে ভালবাসার কাহিনি লিখতে চাইছি, তা ইউনিকোড ফন্টে ভর করে বলতে হবে! তাছাড়া বলতে পারব না! এ কেমন কথা! না বুকু, আমি মানতে পারছি না।”

আবার প্রথম প্রজন্মে প্রযুক্তিবিদের পেশায় যেতে গিয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে কৃষিজীবী গোবিন্দগোপালের মেধাবী ছেলে কেষ্টর স্বপ্ন। যেখানে ডোমের চাকরির জন্য একশো জন ইঞ্জিনিয়ার আবেদন করে, সেই অদ্ভুত আঁধারে চাকরি না-পাওয়া কেষ্টকে শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতে হয় পাঁচ টাকার ডিম-ভাতের লাইনে। এই রাষ্ট্র, এই সমাজ শিক্ষার পর উপার্জনের নিশ্চয়তা দিতে না পারলেও উঁকি দিতে পারে ব্যক্তিগত পরিসরে, কেড়ে নিতে পারে মানুষের একলা থাকার অধিকার। একটি মেয়ে কেন একলা থাকবে, কেন সে কারও সঙ্গে মিশবে না, এই নিয়ে মাথা ঘামায় পড়শিরা।

“কিন্তু আমি যদি একা থাকতে চাই— তাহলে অসুবিধে কোথায়? কোনও মানুষ সঙ্গলোভী না হলেই রুগী, বিকারগ্রস্ত? এ আপনাদের কেমন চিন্তা! বিশ্বাস করুন, আমি খুব ভালো আছি। একাকী থাকার মতো মানসিক শক্তি আমার আছে।” (মেয়েটি একলা থাকে)

এই ছাঁচে ঢালা সমাজই একাকী মায়ের লড়াইকে নস্যাৎ করে দেয়, এমন পরিবারে ছেলের বিয়ে দিতে অপারগতা জানায় চিঠি লিখে। (কোন আলো) ‘নাম ও ভূমিকা’ গল্পে তরুণ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের দায়সারা ভূমিকা তরুণ কবির মৃত্যুর পর তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় প্রবীণকে। মনে পড়ে যায় নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতার অমোঘ পঙ্‌ক্তি: “প্রথিতযশা প্রৌঢ় হবার চেয়ে অপমানিত বালক হওয়া ভাল।”

দীর্ঘ অক্ষরজীবন থেকে পঞ্চাশটি সেরা গল্প বাছা কঠিন কাজ। নির্বাচনের সময় প্রাধান্য পেয়েছে গল্পকারের দেখা বিচিত্র চরিত্র। শিবানীতলার জীবন নদী মারা গেলেও জীবননদীর গল্প শুকিয়ে যেতে দেননি কথাকার।

লেখক ভেরা নাজ়ারিয়ান বলেছিলেন, “আই উইল টেল ইউ আ সিক্রেট। ওল্ড স্টোরিটেলারস নেভার ডাই। দে ডিসঅ্যাপিয়ার ইনটু দেয়ার ওন স্টোরি।” সেই গল্পের মধ্যে থাকবে অন্নগাছি, গান স্যালুট, হাতল ভাঙা চেয়ার। যে সব গল্পে লেখক মিশে যান “উড়ে আসা প্রশ্নের মতো, ঝরা পাতার মতো, পালকের মতো, কাগজের তৈরি এরোপ্লেনের মতো।” ‘হাতল ভাঙ্গা চেয়ার’ গল্পে দেবদত্ত চাকরিজীবনের শেষে বুঝতে পারেন, ফেয়ারওয়েল পেতে গেলেও যোগ্যতা লাগে। সংস্থার চোখে তিনি যে সত্যি অযোগ্য ছিলেন তা স্পষ্ট হয়ে যায় তাঁর সহকর্মীর ফেয়ারওয়েল থেকে ফিরে তাঁরই একদা স্নেহভাজনের রূঢ় ফোন পেয়ে।

“অবসরের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতা, প্পুলারিটি, ডায়নামিক মুভমেন্ট, মালিকের দৃষ্টিপথে থাকা— সব সব কিছুর অবসান ঘটে। অফিসে নিত্য প্রবাহে কোনও বদল ঘটে না। কেবল কর্মক্ষেত্রের অলিন্দ থেকে বেরিয়ে আসা মানুষটা বাইরের ভিড়ে মিশে যায়। কাউকে আড়ালে, অন্ধকারে রেখে পতনের এক্তিয়ারটা বরং অনেক আগে থেকে শুরু হয়ে যায়, যে পড়বে, সে ঘুণাক্ষরেও মনে করতে পারবে না পড়ে যাওয়ার দিন সমাগত।...

মিথ্যে অপমানে রক্তাক্ত দেবদত্ত। অনন্ত অবসাদে খাটে বসতে গিয়েও বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ছিটকে সরে এলেন, খাট নয়, একটা হাতল ভাঙ্গা চেয়ার ওঁর দিকে তাকিয়ে খুব হাসছে।”

তৃষ্ণা বসাক

আরও পড়ুন
Advertisement