সরব: মণিপুরে শান্তি চেয়ে মেইতেই নারী-গোষ্ঠী অবস্থান বিক্ষোভ। ইম্ফল। পিটিআই।
শিরোনাম থেকে স্পষ্ট, এই বই ভারতীয় রাষ্ট্র এবং ভারত থেকে বিচ্ছিন্নতা চায় এমন অগণিত বিদ্রোহী দল, তাদের মধ্যে জাতিগত বা অবস্থানগত বিরোধ এবং পাল্টা বিরোধের দীর্ঘায়িত সমস্যা, তা থেকে তৈরি হওয়া দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত। আলোচনার মূল বিষয় আবর্তিত হয়েছে নাগাল্যান্ড ও মণিপুর রাজ্যকে কেন্দ্র করে, যার সঙ্গে লেখক সুদূর প্রাচ্যকে যোগ করেছেন। লেখক দেখিয়েছেন, কী ভাবে বিভিন্ন প্রশ্নকে কেন্দ্র করে আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণের জেরে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই রাজ্যগুলো চিরস্থায়ী সংঘাতের ক্ষেত্রভূমিতে পরিণত হয়েছে।
ভারতের স্বাধীনতার পরে ইম্ফল ও কোহিমায় অধিবাসীদের জাতিগত অস্তিত্ব ও স্বাধিকারের প্রশ্নে কেন্দ্রের সঙ্গে সংঘাতের সূচনা হয়েছিল। লেখক ইতিহাস ও সাহিত্যের উপাদান ব্যবহার করে, উপনিবেশিক রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগা জনজাতিদের সম্পর্কের টানাপড়েন, ১৯৪৬ সাল থেকে নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিল নাগা হিলস এবং তার সংলগ্ন অঞ্চল কী ভাবে ভারতে অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করেছিল, এবং স্বাধীনতার পর স্বাধীন ‘নাগালিম’ গঠনে নেহরুর বিরোধিতা ইত্যাদির সংক্ষিপ্তসার লিখেছেন। তিনি এই বইতে সাংবাদিকতার অংশগ্রহণমূলক বিশ্লেষণকে পদ্ধতি হিসাবে ব্যবহারে করে এই অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় নীতি, স্থানিক বিদ্বেষ, বিশৃঙ্খলা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এ ছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির বিরুদ্ধে কেন্দ্র যে আক্রমণাত্মক কৌশল ব্যবহার করেছে, এই বইতে সেই নতুন পদক্ষেপ সম্বন্ধে পর্যবেক্ষণ রয়েছে। লেখক উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এই সংঘাতের রাজনীতি ও ইতিহাসে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে উপাদান হিসাবে ব্যবহার করেছেন আমলাতন্ত্রের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত কথোপকথনের বর্ণনা, বিদ্রোহী নেতাদের দাবি এবং পাল্টা দাবির চরিত্র বিশ্লেষণ, ক্রমাগত প্রাসঙ্গিক থাকার ক্ষেত্রে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির প্রথমে উৎসাহ ও পরে ক্লান্তিরকারণ ব্যাখ্যা, বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে বিভাজন সংক্রান্ত আলোচনা ইত্যাদিকে।
দি ইস্টার্ন গেট: ওয়ার অ্যান্ড পিস ইন নাগাল্যান্ড, মণিপুর অ্যান্ড ইন্ডিয়া’জ় ফার ইস্ট
সুদীপ চক্রবর্তী
৮৯৯.০০
সাইমন অ্যান্ড শুস্টার
লেখকের ভাষায়, এই বইটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের, বিশেষত নাগাল্যান্ড ও মণিপুরের সীমান্ত অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে নীতিগত যান্ত্রিকতা, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে ঐক্যের অভাব এবং সীমানা নিয়ে নিয়মিত দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে লেখা। বইটির প্রথম অংশের শিরোনাম ‘স্মোক’ ব্যবহারের মাধ্যমে লেখক বোঝাতে চেয়েছেন, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোকে যতটুকু খালি চোখে দেখা যায়, তার মধ্যে অনেক ধোঁয়াশা আছে। লেখক বন্দুক ও মাদকের আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের উদাহরণ তুলে ধরে দেখাতে চেয়েছেন, কী ভাবে চোরাচালান-নির্ভর অর্থনীতিকে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো কাজে লাগায়। তাতে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে, রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় অংশীদাররাও জড়িত। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর কথোপকথন উদ্ধৃত করে লেখক দেখিয়েছেন, শুধুমাত্র কর্নেল স্তরের এক জন আধিকারিক নন, অনেক ব্রিগেডিয়ার, সিনিয়র অফিসার, এমনকি মন্ত্রীও এই বেহিসাবি বাণিজ্যের অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা সব সময় সেটা অস্বীকার করেন। লেখক তাই শেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, তথাকথিত সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু এই অঞ্চলে ‘অস্বীকার’-এর রাজনীতিও হাতে হাত ধরে চলে।
বইটির দ্বিতীয় অংশের নাম ‘মিরর’। এই অংশ শুরু হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর প্রতিনিধিরা কী ভাবে ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড-এর নেতা মুইভা-র সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তার বর্ণনা দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, নাগা বিদ্রোহীরা শান্তির পথে হাঁটতে চায়। লেখকের মতে, শুধুমাত্র এই বিবৃতি থেকে বোঝা যায়, আলোচনার টেবিলে নাগা বিদ্রোহীদের সমান হিসাবে দেখা হয়নি। এই মন্তব্য থেকে রাষ্ট্রের মানসিকতাও বোঝা যায়, যা তথাকথিত ‘হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন’-এর তত্ত্ব থেকে খুব আলাদা নয়। কারণ, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে প্রতিরোধের বহুকণ্ঠের সঙ্গে না জড়িয়ে, ভারত চুক্তিকারী হিসাবে তাঁদেরই বেছে নিয়েছিল, যাঁরা তাঁদের রাজ্যকে বাণিজ্যের করিডর হিসাবে খুলতে ও সম্পদ-সীমান্ত হিসাবে রূপান্তর করতে সহায়তা করবেন। শান্তি চুক্তি, ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি, সবই দমন-পীড়নের খেলায় বাগাড়ম্বর মাত্র। এর উপর ‘আফস্পা’ আরোপ এবং তা প্রত্যাহার করার আন্দোলন বিষয়ে জরুরি আলোচনা করা হয়েছে এই বইয়ে। কিন্তু, সেই সঙ্গে যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তিগুলির মূল্যায়ন করে, আফস্পা-র বিরুদ্ধে মত সংগ্রহ করে এবং বিচারবিভাগীয় পর্যবেক্ষণগুলিকে সংগ্রহ করে লেখক যখন মন্তব্য করেন, “আমি কয়েক বছর ধরে আমার লেখা এবং আলোচনায় স্লোগানটি ধরে রেখেছি: ভারত ফিরে পেতে আফস্পা বাতিল করুন,” তখন মনে হয়েছে লেখকও আসলে সমস্যার নিরাপদ ও সহজ সমাধানের পথেই হাঁটার চেষ্টা করেছেন। বিশেষত বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং আদালতের পর্যবেক্ষণের পটভূমিতে, আফস্পা-সম্পর্কিত তাঁর মত পরস্পরবিরোধী মনে হয়েছে।
বইটির তৃতীয় অংশে গুরুত্ব পেয়েছে কেন্দ্রের নিরাপত্তা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলো। লেখক ইঙ্গিত দিয়েছেন, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বেশির ভাগ অভিজ্ঞ ও বয়স্ক নেতাদের মৃত্যু সরকারকে এই অঞ্চল সম্পর্কে আক্রমণাত্মক করে তোলে। সরকার বিদ্রোহী দলগুলিকেও আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করে। উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে সংঘাতের চরিত্র বা গুরুত্ব বোঝার জন্য অভিবাসনের প্রশ্নকে বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলি যে ভাবে ম্যালথাসীয় সংখ্যাতত্ত্বের উপর নির্ভরশীল এক অলঙ্কৃত তথ্য ব্যবহার করেন, লেখক এ ক্ষেত্রে ঠিক তা-ই করেছেন। এনআরসি এবং সিএএ-পরবর্তী সময়ে, মানবাধিকারের প্রতি ভারতের প্রতিশ্রুতি নানা প্রশ্ন তুলেছে। এই বইতে ডিটেনশন ক্যাম্পের দৃশ্যমানতা নিয়েও প্রশ্ন করা হয়েছে। লেখকের মতে, ভবিষ্যতে এই অভিবাসন প্রক্রিয়া ক্রমে ‘আঞ্চলিক দখল’-এর দিকে নিয়ে যাবে এবং এ ভাবে চলতে থাকলে উত্তর-পূর্ব ভারতের ভাঙন ঠেকানো যাবে না।
এই বইয়ে মূল সমস্যার জায়গা হল, লেখক আসলে এক ধরনের একরৈখিক ধারণার মধ্য দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোকে দেখেছেন। তাঁর মতে, সব বিদ্রোহী দলের উচিত আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ধারণাকে সমর্থন করা। কিন্তু লেখকের এই ধারণা প্রশ্ন তোলে, সরকারের মতো তিনিও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির উদ্দেশ্য আদৌ বুঝতে পেরেছেন কি না। শুধু তা-ই না, লেখক মনে করেন আগামী কয়েক বছর ভারত দূরপ্রাচ্য মন্থনের মধ্যে থাকবে। হয়তো ২০২৫ বা ২০৩০ সালে এই অঞ্চলে শান্তি ফিরে আসতে পারে। কিন্তু এত রকম জটিলতার মধ্যে শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এই অঞ্চলে শান্তি নিশ্চিত করবে, এমন দাবি শিশুসুলভ মনে হয়। আসলে ঔপনিবেশিক কর্মকর্তা ও নৃতাত্ত্বিকরা যে ভাবে টুর ডায়েরি এবং সরকারি প্রতিবেদনের বিবরণ লিখতেন, এই বইটি তা থেকে আলাদা নয়। কারণ এই বইয়ে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিকে একটি সম্পদ-সীমান্ত হিসাবে দেখা হয়েছে। তাঁর মতে, এই অঞ্চলকে অর্থনৈতিক ভাবে আরও কার্যকর করা দরকার, এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে সংযোগ ও বাণিজ্যের সুবিধার্থে সহায়তা করবে।
রাষ্ট্রের চাণক্যনীতি বিশ্বের কাছে প্রকাশ করার কৃতিত্ব লেখকের প্রাপ্য। কিন্তু লেখক যদি উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোকে জনজাতিভুক্ত মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতেন, তবে এই অঞ্চল সম্পর্কে পাঠকের নতুন ধারণা হতে পারত। যুদ্ধ ও শান্তির কৌশল বা পাল্টা কৌশলগুলির উপর এই বইতে আসল গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা আসলে এই অঞ্চলকে বোঝার জন্য এক ধরনের আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে। পার্থক্য শুধু, তিনি জাতি ও অঞ্চলের উন্নতির জন্য শান্তির গুরুত্বের কথা লিখেছেন। তাঁর মতে, বিদ্রোহী কণ্ঠ একক ভারতের ধারণার বিরুদ্ধে যায়। আসলে উপত্যকা ও পাহাড় উভয়কে উভয়ের প্রয়োজন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য এ কথা অমোঘ সত্য। কিন্তু বিদ্রোহীদের ও ভারতীয় রাজ্যের সংঘাতের মধ্যে এই আসল সমাধানের পথের কথা কবে হারিয়ে গেছে। কিন্তু, এই বইতেও সেই মেলবন্ধনের গুরুত্বের স্বর ঠিক সে ভাবে শোনা গেল না।