Book Review

মার্ক্সবাদের নতুন ভাবনা

ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে হলে এই ধারণাগত ভূতের মুখোমুখি হতেই হবে, তাকে ঝাড়ানোর জন্য নয়, তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য।

অচিন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:৩০
কার্ল মার্ক্স।

কার্ল মার্ক্স।

অনুপ ধর এবং অঞ্জন চক্রবর্তী আলোচ্য বইটিতে এক সামাজিক রূপান্তরের রাজনীতির ধারণার রূপরেখা দিয়েছেন। এই ধারণা উঠে এসেছে এক দিকে যেমন মার্ক্সবাদের আত্মসমালোচনা ও তার পুনর্নির্মাণ থেকে, অন্য দিকে গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মার্ক্সের ‘কথোপকথন’-এর মধ্যে দিয়ে। এই তিন মহান চিন্তকের এক জনকে অপরের সঙ্গে মিলিয়ে বা পার্থক্য টেনে কিছু লেখালিখি ইতিপূর্বে কেউ কেউ করেছেন বটে, কিন্তু আলোচ্য গ্রন্থটি জাতে একেবারেই আলাদা। এর অনন্যতা এর নিবিড় পাঠপদ্ধতিতে, যুক্তির বিন্যাসে, গভীর বিশ্লেষণে, এবং সর্বোপরি মৌলিক চিন্তার সাহসে।

অনুপ ও অঞ্জন ‘ভবিষ্যৎ’-এ ঢোকার আগে ‘রাজনীতির ভূত’কে চিহ্নিত করে উল্টেপাল্টে দেখান। ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে হলে এই ধারণাগত ভূতের মুখোমুখি হতেই হবে, তাকে ঝাড়ানোর জন্য নয়, তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য। ভূতের মধ্যে আবার রয়েছে হরেক কিসিমের ভূত। আছে বাইনারি চিন্তার ভূত— যেমন, মানবজাতিকে ‘শত্রু’ আর ‘মিত্র’ এই দুই শিবিরে বিভাজনের রাজনীতির ভূত। অতীতের গণসঙ্গীতে বিপ্লবের ডাক দিয়ে বলা হত ‘চিরশত্রুর পরে ঘৃণার আগুন’। এই শত্রু-মিত্র চিহ্নিতকরণের মধ্যে রয়ে যায় যে সংঘর্ষের বীজ, তা-ই মহীরুহ হয়ে চাপা দিয়ে দেয় পুনর্নির্মাণের লক্ষ্যকে। লেখকদ্বয়ের বিশেষ রাজনীতির ধারণাটি তাই ‘রূপান্তরের অস্তিত্ব-দর্শন’-এ আধারিত। মানবসত্তার পরিবর্তন এই রূপান্তরের মর্মবস্তু। মার্ক্স যদি সমাজ-কাঠামোর আমূল পরিবর্তন লক্ষ্যে রাখেন, গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের লক্ষ্য ব্যক্তিসত্তার রূপান্তরে। অনুপ ও অঞ্জনের মতে ‘বিরোধিতার রাজনীতির অতিতিক্ততা রাজনীতিকল্পনার রিক্ততায় পর্যবসিত হয়’। কথাটি অনেকে মানলেও রাজনীতির কারবারিদের পক্ষে মেনে নেওয়া মুশকিল। তিক্ততা ও রিক্ততার রাজনীতিই যেন আমাদের ভবিতব্য!

এর পর রয়েছে সনাতন মার্ক্সবাদের ভূত। যেমন, ‘সারবাদ’ বা এসেনশিয়ালিজ়ম, আর্থনীতিক ‘ভিত্তি’ আর সাংস্কৃতিক ‘উপরিস্তর’-এর যান্ত্রিক বিভাজন, আর সেখান থেকে আর্থনীতিক ‘নির্ধারণবাদ’ (ডিটারমিনিজ়ম)। সমাজের যাবতীয় দ্বন্দ্বের ব্যাখ্যা শেষমেশ অর্থনীতিতেই নিহিত রয়েছে— এই দৃষ্টিভঙ্গি। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলে, সমাজ এগোবে দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতো এক ধাপ থেকে পরের ধাপে— আদিম সাম্যবাদ, প্রাচীন দাসব্যবস্থা, সামন্ততন্ত্র, ধনতন্ত্র, অন্তিমে সাম্যবাদ। বিজ্ঞানের মতোই ধ্রুব, অতএব এর অন্যথা হতে পারে না। বলা বাহুল্য, মার্ক্সের লেখাপত্র থেকে যে ঠিক এই ‘মার্ক্সবাদ’ই উঠে আসে তা কিন্তু নয়। মার্ক্সের বহুমাত্রিক ভাবনাকে একমাত্রিক ছাঁচে ভরে দেওয়ার পরিণতিতেই পাই এমন ভাষ্য। অতীতে দেওয়াল লিখনে দেখেছি ‘মার্কসবাদ বিজ্ঞান, অতএব ইহা সত্য’।

রাজনীতির ভূত-ভবিষ্যৎঅনুপ ধর ও অঞ্জন চক্রবর্তী

৬০০.০০

আনন্দ

বিকল্পের নির্মাণে মূল ধারণাটি লেখকদ্বয় নেন মার্ক্সবাদে লুই আলথুজ়ার প্রবর্তিত ‘ওভারডিটারমিনেশন’ থেকে, যাকে তাঁরা বলছেন ‘পরম পারস্পরিকতা’, যা নির্ধারণবাদের একমাত্রিক সরলরৈখিক নিশ্চিত মার্ক্সিজ়ম থেকে আমাদের মুক্ত করতে পারে। সামাজিক, আর্থনীতিক, রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলি পারস্পরিকতায় সম্পর্কিত— কোনও একটি প্রক্রিয়া অন্যটিকে নির্ধারণ করছে না। সেই সঙ্গে শ্রেণির ধারণাটিকেও তাঁরা স্টিফেন রেজ়নিক এবং রিচার্ড উলফ-কে অনুসরণ করে অন্য ভাবে দেখাতে চেয়েছেন। শ্রমিক শ্রেণি আর পুঁজিপতি শ্রেণি— এ রকম দ্বিত্ব-অনুসারী বর্গায়ন নিয়ে রাজনীতিতে বেশি দূর যাওয়া যায় না। যে-হেতু একই ব্যক্তির বিভিন্ন শ্রেণি অবস্থান থাকতে পারে শ্রেণি প্রক্রিয়ায় তাঁর অংশগ্রহণের নিরিখে, অতএব শ্রেণি প্রক্রিয়ার ধারণাটি ধরে এগোনোই যুক্তিযুক্ত হবে। শ্রেণি প্রক্রিয়া পুঁজিবাদী হতে পারে, না-ও হতে পারে। মানুষজন আদতে শ্রেণিপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী, আর সেখান থেকেই নির্ণয় করা যাবে তাঁদের শ্রেণি অবস্থান। কিছু মানুষ প্রয়োজনীয় ও উদ্বৃত্ত শ্রম দেন— মার্ক্সের ভাষায় যাঁরা ‘প্রত্যক্ষ উৎপাদক’। অন্যরা উদ্বৃত্ত শ্রমমূল্য আহরণ ও গ্রহণ করেন। এঁদের যে সম্পূর্ণ পৃথক দু’টি দল হতেই হবে, তা নয়। এক জন ব্যক্তি একই সঙ্গে একাধিক শ্রেণি অবস্থানে থাকতে পারেন। প্রশ্নটা হল, উদ্বৃত্ত মূল্য বণ্টনে প্রত্যক্ষ উৎপাদকের ভূমিকা কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে।

সনাতনী মার্ক্সিজ়ম থেকে বেরিয়ে এসে মার্ক্সিজ়মের ভিন্ন ভাষ্য থেকে অন্য রাজনীতির সম্ভাবনার দিকে এগোতে যে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর সঙ্গে কথোপকথনে আসতে হবে, এই প্রধান বক্তব্যটি অনুপ ও অঞ্জন প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁদের নিজস্ব দক্ষতায়। মন ও মননের ঔপনিবেশিকতার উপলব্ধি ও তার অবসানের লক্ষ্য রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী উভয়ের দর্শনেই পেয়ে যাই, যা মার্ক্সীয় সমাজ পরিবর্তনের ধারণাকে সম্প্রসারিত করে। তত্ত্ব ও চর্যার মধ্যে পারস্পরিকতা সে ধারণার কেন্দ্রে। মার্ক্স-উত্তর রাজনৈতিক দর্শনচর্চার জগতে লেখকদ্বয়ের অবদান স্বীকৃত। দীর্ঘ কাল এই চর্চায় রয়েছেন তাঁরা। যৌথ ভাবে বেশ কয়েকটি উত্তম গ্রন্থ রচনা করেছেন ইংরেজি ও বাংলায়। ভাবনার নতুনত্ব ও বিশ্লেষণের গভীরতার কারণে এঁদের লেখা সিরিয়াস পাঠকমহলে সমাদৃত। নতুন ভাবনার জন্য চাই নতুন বাগ্‌ধারা। অঞ্জন ও অনুপ এমন একটি ভাষা গড়ে তুলেছেন, যার রসাস্বাদন করতে হলে ইচ্ছুক পাঠককে মনোযোগী হতেই হয়। মার্ক্সবাদকে বিজ্ঞানের জোব্বা না পরিয়ে খানিক মাটির তাল ভেবে নিয়ে চটকে-ঠেসে নানান আকৃতি দেওয়ার কাজটি এ দেশে তেমন হয়নি, যা এঁরা করে চলেছেন। নির্বাচনে পার্টিলাইন ঠিক করার মহাব্যস্ততায় মার্ক্সবাদ নিয়ে ভাবাভাবির আর সময় কোথায়?

একটু হালকা কথায় শেষ করি। ক্যাপিটাল–এর প্রথম খণ্ডটিই শুধু মার্ক্সের জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল এঙ্গেলস–এর একান্ত প্রচেষ্টায় । ১৮৬৭-তে প্রকাশিত হয়ে ১৮৭১-এই সেটি নিঃশেষিত। কারা কিনলেন? ‘শ্রমিক শ্রেণি’, দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় মার্ক্স জানাচ্ছেন। তিনি লিখছেন, “তত্ত্বচর্চার ক্ষমতা, যা এক সময়ে জার্মানির মহান পরম্পরা বলে মনে করা হত, এখন যেন তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে থেকে একেবারেই লোপ পেয়েছে। অথচ অন্য দিকে শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে তার পুনর্জন্ম ঘটেছে।” আহা, যদি তা-ই হত রাজনীতির ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়েও!

আরও পড়ুন