Book Review

বিরুদ্ধ স্বরের লোকপরিসর 

অনিকেত দে গম্ভীরা গানের চালচিত্রে বাংলার এক প্রান্তিক অঞ্চলের সীমান্ত, সীমান্তবর্তী মানুষজন এবং একটি লোকসংস্কৃতির বিভাজন তুলে ধরতে চেয়েছেন৷

Advertisement
অসীমকুমার সরকার
শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:১৬
লোকায়ত: মালদহের গম্ভীরায় ফুটে ওঠে জীবন ও সমাজচিত্র।

লোকায়ত: মালদহের গম্ভীরায় ফুটে ওঠে জীবন ও সমাজচিত্র। ছবি সৌজন্য: দীপঙ্কর ঘোষ।

গম্ভীরা গান পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলা এবং বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী জেলায় প্রচলিত জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত৷ দেশভাগ-পূর্ব মালদহে অনেক আগে থেকেই গম্ভীরা গানের বোলবোলা৷ গম্ভীরা শিবোৎসব, গম্ভীরা লোক-উৎসব৷ শিব-কেন্দ্রিক এই গানে শিব লৌকিক দেবতা নন, ঘরের মানুষ, কখনও নানা, কখনও ভোলা৷ তাঁর কাছে গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষজন তাঁদের অভাব-অভিযোগ জানাতে পারেন নির্দ্বিধায়৷ মালদহের গম্ভীরা বিদ্রুপাত্মক৷ এর আদলে যাত্রাপালার ছায়া৷ ভাষা মূলত আঞ্চলিক, অর্থাৎ মালদহের মৌখিক ভাষা৷ মৈমনসিংহ-গীতিকা, মনসার ভাসান ইত্যাদি গম্ভীরার দোসর৷

Advertisement

অনিকেত দে গম্ভীরা গানের চালচিত্রে বাংলার এক প্রান্তিক অঞ্চলের সীমান্ত, সীমান্তবর্তী মানুষজন এবং একটি লোকসংস্কৃতির বিভাজন তুলে ধরতে চেয়েছেন৷ গম্ভীরা নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশে লেখালিখি হয়েছে অনেক৷ কিন্তু এ নিয়ে সমাজতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক গবেষণার মিশেলে অ্যাকাডেমিক ইতিহাসের বই এই প্রথম৷ গম্ভীরা একান্ত ভাবেই স্থানীয় উৎসব৷ অনিকেত দেখিয়েছেন, সেই স্থানিকতার সবচেয়ে বড় অঙ্গটি অবশ্যই ধর্ম-জাতিগত ভেদাভেদের সীমানা ছাড়িয়ে মানুষের প্রাত্যহিক আদানপ্রদান৷ অর্জুন আপ্পাদুরাইয়ের ‘লোকালিটি’র ধারণায় নিহিত এই সমাজ-সংযোগের সূত্রটি ধরেই তিনি তাঁর গবেষণা ও ক্ষেত্রসমীক্ষা চালিয়েছেন৷

কী ভাবে ঔপনিবেশিকের খামখেয়ালে ভরা অনৈতিহাসিক, অযৌক্তিক মনগড়া মানচিত্রনির্মিত সীমান্তে গম্ভীরার ইতিহাস নিরন্তর গড়ে উঠছে, অনিকেত তা-ই দেখাতে চেয়েছেন৷ তিনি সচেতন ভাবেই ‘সীমান্তভূমি’-র (বর্ডারল্যান্ড: উইলিয়াম ভ্যান শেন্ডেল) বদলে ব্যাপকার্থে ‘পরিসর’ (স্পেস) শব্দটি ব্যবহার করেছেন৷ তিনি বোঝার চেষ্টা করেছেন জাতি-রাষ্ট্র ও সম্প্রদায়গত সীমান্তের সঙ্গে গম্ভীরার সম্পর্কের স্বরূপটি ঠিক কী রকমের। মালদহ ও রাজশাহীর নিম্নবর্ণীয়, নিম্নবর্গীয় গম্ভীরা শিল্পীর অনুভূতিতে জাতি, রাষ্ট্র ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর পরিবর্তনশীল অর্থ আত্তীকরণের প্রয়াস ঠিক কী রকম? জাতি-রাষ্ট্রের বদ্ধ খাঁচার মধ্যে তাঁদের গান ও পালার মধ্যে কী ভাবে এক ভিন্ন স্থানিকতার চিত্র ফুটে ওঠে? আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ায় সীমান্ত নির্মাণের ইতিহাসে লোককল্পনা ও লোকসংস্কৃতির বিবর্তনের স্বরূপটির তাৎপর্য ঠিক কী?

দ্য বাউন্ডারি অব লাফটার: পপুলার পারফরমেন্সেস অ্যাক্রস বর্ডারস ইন সাউথ এশিয়া

অনিকেত দে

১৮৯৫. ০০

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস

ইতিহাসবিদ ও নৃতাত্ত্বিকের দৃষ্টিভঙ্গির মিশেলে লিখিত এ বইটি পাঁচটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত৷ প্রথম অধ্যায়ে অনিকেত প্রাক্-আধুনিক বাংলার শিবায়ন কাব্যের নিরিখে দেখিয়েছেন কী ভাবে শিব-কথাকে ঘিরে গড়ে উঠছে প্রাকৃতিক অঞ্চল, কৃষি-সমাজ ও সামাজিক মর্যাদা সংক্রান্ত নিম্নবর্গীয় মানুষের কল্পনা৷ ‘হিন্দু দেবতা’র জায়গায় শিব হয়ে উঠছেন কৃষি-সমাজের মূল্যবোধ ও পারস্পরিক সম্পর্কের দ্যোতক৷ গম্ভীরার শিব শিবায়ন কাব্যের মতোই পরিশ্রমী কৃষক৷ মালদহের হিন্দু-মুসলিম-জনজাতি কৃষিসমাজে গম্ভীরার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার মূল কারণ এটাই৷

দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে কী ভাবে স্বদেশি যুগে (১৯০৫-১৯১৪) জাতীয়তাবাদের বুনটে গম্ভীরা গানের আদলে পরিবর্তন এল৷ এক সময় যা ছিল উন্নাসিক শহুরে এলিটের চোখে নিম্নবর্গের/বর্ণের মানুষের ‘অর্থহীন হুল্লোড়’, বিনয়কুমার সরকারের উদ্যোগে তা হয়ে উঠল ‘জাতীয় উৎসব’, স্বদেশি ভাবধারা প্রচারের হাতিয়ার৷ এর আঙ্গিকে কী ভাবে ১৯২০-৩০’এর দশকে আরও পরিবর্তন এল, কী ভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জটিল আবর্তে গম্ভীরা শিল্পীরা একটি ‘সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ রাজনৈতিক পরিসর’ তৈরি করতে চেয়েছিলেন, কী ভাবে ধর্মীয় বিভেদের উপরে উঠে এক বৃহত্তর সামাজিক আদর্শ, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার কথা তুলে ধরেছিলেন, তা তৃতীয় অধ্যায়ের আলোচনার বিষয়বস্তু৷

১৯৪৭-এর দেশভাগ গম্ভীরা শিল্পীদের জীবনে এক বিপর্যয় ও পরিবর্তন নিয়ে এল৷ চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে সদ্যগঠিত ভারত ও পাকিস্তান, এই দুই জাতি-রাষ্ট্রে গম্ভীরা গানের বিবর্তন৷ অনিকেত দেখিয়েছেন কী ভাবে রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনে পূর্ব পাকিস্তানের গম্ভীরা গানে শিবের পরিবর্তে জায়গা নিল দু’জন মুসলিম কৃষকের (নানা ও নাতি) কথোপকথন৷ এই রূপান্তরের রাজনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আলোচ্য বইটির এক বিশিষ্ট দিক৷ পঞ্চম অধ্যায়ের আলোচিত বিষয় ১৯৭১-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশ জাতি-রাষ্ট্রে, এনজিও ও বেসরকারি কর্পোরেশনের স্বার্থ ও চাহিদা মেটাতে গিয়ে ‘ভারতীয়’ ও ‘বাংলাদেশি’ গম্ভীরার সীমান্তরেখা আরও সুদৃঢ় হল৷

উনিশ ও বিশ শতকের মালদহের মতো একটি প্রান্তিক অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষদের জনসংস্কৃতির সামাজিক বৈশিষ্ট্যগুলো মূলধারার ইতিহাসে প্রায় অনুপস্থিত৷ অনিকেতের কৃতিত্ব এখানেই যে, এ রকম ইতিহাসে উপেক্ষিত গম্ভীরা শিল্পীদের নিয়ে তিনি একটি ভাবনাসমৃদ্ধ বই লিখেছেন৷ তিনি দেখিয়েছেন যে, গম্ভীরা শিল্পীদের চৈতন্য কোনও স্বচ্ছ, ফাঁকা পরিসর নয়৷ সেখানে আগে থেকেই রয়েছে বিভিন্ন ‘ডিসকোর্স’-এর প্রভাব৷ শিবকেন্দ্রিক গান, পালা, উৎসব অনেক আগে থেকেই মালদহের ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে গ্রামীণ কৃষক ও সমাজে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে ছিল৷ ভারত ও পাকিস্তান (পরে বাংলাদেশ), এই দু’টি জাতি-রাষ্ট্রের গম্ভীরা শিল্পীরা জাতীয় সীমান্তের তুলনায় অনেক বেশি জোর দিয়েছেন স্থানিক পরিচয় ও সামাজিক সম্পর্কের পরিসরে৷

শহুরে ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণির চোখে গম্ভীরা শিল্পীরা হয় সরলমনা গ্রামীণ মানুষ, নয়তো এক চিরন্তন লোক-ঐতিহ্যের বাহক হিসাবেই রয়ে গেছেন— দেখান অনিকেত৷ শিল্পীদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কিংবা নৈতিক সংবেদনশীলতার দিকে তাঁরা নজর দেননি৷ লেখকের দৃষ্টিতে গম্ভীরা শিল্পীরা রাজনৈতিক চিন্তক, আর তাঁদের ‘আইডিয়া’ বৃহত্তর পরিসরের জাতীয়, এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে বিযুক্ত নয়৷ আলোচ্য বই জুড়ে তাই দেখা যায় কী ভাবে গম্ভীরা শিল্পীরা আধিপত্যবাদী শ্রেণিকে (হেজিমনিক ক্লাস) বিদ্রুপ করেছেন, এলিট আখ্যানকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, সামাজিক অর্থনৈতিক দাবি তুলে ধরেছেন এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনে সাড়া দিয়েছেন৷

উপনিবেশিক ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ইতিহাস নিয়ে যে সব ইতিহাসবিদ চর্চা করেন, তাঁদের অনেকেই দুই সম্প্রদায়ের ‘মোনোলিথিক ব্লক’-এর কথা কল্পনা করেন৷ অনিকেতের মতে এ ধরনের আখ্যান প্রাত্যহিক জীবনে হিন্দু-মুসলিম সহযোগিতার পরিসরটিকে উপেক্ষা করে৷ সাম্প্রতিক বেশ কিছু গবেষণা কিন্তু আমজনতা, এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেও এ জাতীয় সমঝোতার উপর আলোকপাত করেছে৷ অনিকেতও গম্ভীরাকে দেখেছেন একটি ‘যৌথ সামাজিক পরিসর’-এর আলোকে, যা ধর্মীয় ও জাতীয় সীমান্তরেখাকে অতিক্রম করে এক বৃহত্তর সামাজিকতার আদর্শকে তুলে ধরে৷ বেঁচে থাকার, ভালবাসার ‘কমিউনিটি’ নির্মাণের অজস্র দৃষ্টান্ত তিনি দেখেছেন দুই বাংলার গম্ভীরা গানের মধ্যে৷

গম্ভীরায় ফুটে ওঠে বারো মাসের জীবনের জলছবি৷ আর তার সঙ্গে মিশে যায় সমাজের মুখাবয়ব৷ সীমান্তবর্তী ও বিভাজিত প্রান্তিক এক অঞ্চলের একটি লোকসংস্কৃতির বিবর্তন আলোচনা করতে গিয়ে অনিকেত গম্ভীরা গানকে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে পেশ করেছেন৷ ভারত, বাংলাদেশ ও আমেরিকার মহাফেজখানার দলিল-দস্তাবেজ ও নৃতাত্ত্বিক ক্ষেত্রসমীক্ষা এ গবেষণাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে৷ তাঁর রচনার সবচেয়ে বড় দিকটি হল, কখনওই এটি গবেষণা-সন্দর্ভের মতো গম্ভীর বা তাত্ত্বিক নয়৷ ফলে সাধারণ পাঠক ও পেশাদার ইতিহাসবিদ, উভয়ের কাছেই এই গবেষণা মূল্যবান৷

আরও পড়ুন
Advertisement