চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

বাস্তব ও কল্পনায় উন্মোচিত রূপজগৎ

সিমা-য় কে জি সুব্রহ্মণ্যন স্মরণে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীটি দেখে এসে লিখছেন মৃণাল ঘোষ কে  জি সুব্রহ্মণ্যন-এর স্মরণে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে সম্প্রতি সিমা গ্যালারিতে। সুব্রহ্মণ্যনকে বলা যেতে পারে শান্তিনিকেতনের রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকারের অন্যতম শেষ প্রতিনিধি। অন্তত শিল্পকলার ক্ষেত্রে। তাঁর প্রয়াণের পরে এ রকম বহুমুখী প্রতিভা আর খুব বেশি অবশিষ্ট রইলেন না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০১
কে জি সুব্রহ্মণ্যন স্মরণে

কে জি সুব্রহ্মণ্যন স্মরণে

কে  জি সুব্রহ্মণ্যন-এর স্মরণে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে সম্প্রতি সিমা গ্যালারিতে। সুব্রহ্মণ্যনকে বলা যেতে পারে শান্তিনিকেতনের রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকারের অন্যতম শেষ প্রতিনিধি। অন্তত শিল্পকলার ক্ষেত্রে। তাঁর প্রয়াণের পরে এ রকম বহুমুখী প্রতিভা আর খুব বেশি অবশিষ্ট রইলেন না।

বহুমুখী কথাটি তাঁর ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থেই প্রযোজ্য। একাধারে তিনি ছিলেন চিত্রকর, ভাস্কর, ভিত্তিচিত্রকর (ম্যুরালিস্ট), ছাপচিত্রী, স্বতঃস্ফূর্ত লেখক, শিল্পতাত্ত্বিক, কবি ও শিক্ষক। ছোটদের জন্য লিখেছেন, গ্রন্থচিত্রণ করেছেন, ছোটদের খেলনার নকশা তৈরি করেছেন, গড়েছেনও সে সব কৌতুকদীপ্ত খেলনা। বস্ত্রবয়ন শিল্পের নকশা প্রস্তুতেও তাঁর অবদান স্মরণীয়। নাটকের জন্য মঞ্চ ও পোশাক পরিকল্পনাতেও রেখেছেন নিজস্ব ভাবনার পরিচয়। শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রেও তাঁর প্রকরণ চর্চা ছিল বহুধা বিস্তৃত।

Advertisement

তাঁর সমস্ত কাজেই কবিসত্তার প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি ছিল। ১৯৮৩-তে কলকাতার বিড়লা অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত তাঁর পূর্বাপর প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারকপত্রের সাক্ষাৎকার অংশে তিনি বলেছিলেন ‘we are seeking a kind of poetry of the real’. এ কথাটি তাঁর সমগ্র শিল্পসৃষ্টি সম্পর্কেই সত্য। তাঁর ছবির নির্মাণ-পদ্ধতির ভিতর রয়েছে আপাত-অসংলগ্ন মন্তাজধর্মী দৃশ্যাবলির সমাহার। প্রতিটি একক প্রতিমাকল্পের কৌতুকদীপ্ত ছন্দময়তাকে তিনি যেমন সমগ্রের ছন্দে একাত্ম ও স্পন্দিত করে তুলতেন, তার ভিতর থেকেই কবিতার অন্তর্দীপ্তি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আমাদের দেশের আধুনিক বা আধুনিকতাবাদী আন্দোলনগুলির কোনওটির সঙ্গেই তাঁর রূপচেতনাকে ঠিক মিলিয়ে নেওয়া যায় না। ১৯৪০-এর দশকের শিল্প-আন্দোলন বা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের যে তত্ত্ববিশ্ব— এই দুইয়েরই খুব কাছাকাছি ছিলেন তিনি। ‘লোকাল’ আর ‘গ্লোবাল’-এর দ্বৈতে ‘লোকাল’-কে যথেষ্ট সম্মানের আসনেই বসিয়েছেন তিনি। ১৯৯৪ সালে ‘The Local and the Global’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় বলেছিলেন: ‘I cannot see any special reason why as an artist I should have a global perspective’. এই ঐতিহ্য আত্তীকরণের মধ্যেই শান্তিনিকেতন শিল্পধারার যোগ।

১৯৮০-র দশকের দিকে যতই এগিয়েছেন সুব্রহ্মণ্যন, ততই তাঁর ছবি হয়ে উঠেছে সহজ ও মন্ময়। ষাটের দশক পর্যন্ত তাঁর ছবিতে যে গাঠনিকতা বা স্ট্রাকচারাল বৈশিষ্ট্যের উপর জোর ছিল, পোস্ট-কিউবিস্ট আঙ্গিকের প্রাধান্যে যে ‘সেরিব্রাল এলিমেন্টস’ সরব হচ্ছিল, সেটা অবসিত হয়ে আশির দশকে তাঁর ছবিতে মেধা ও মননের সুষম সমন্বয় ঘটতে লাগল।

তখন তিনি সমস্ত কিছুকেই গ্রহণ করছেন। সমস্ত কিছুকেই মিলিয়ে নিচ্ছেন। ‘Bahurupee: A Polymorphic vision’ নামে এক প্রবন্ধে তিনি বলেছেন ‘বিকল্প উপস্থিতি’র কথা। বাস্তব ও কল্পরূপ একসঙ্গে মিলে মিশে থাকে। এক রূপকথার জগৎকে উন্মোচিত করেন তিনি। বাস্তব ও রূপকথার সমন্বয় ঘটে।

সুব্রহ্মণ্যন তাঁর একটি প্রবন্ধে আধুনিকতার অন্তর্নিহিত সমস্যা প্রসঙ্গে বলেছিলেন— আজকের বিশ্বায়িত শিল্প পরিস্থিতিতে শিল্পীর আত্মস্বরূপের সঙ্গে সামগ্রিক মূল্যবোধের কোনও সংযোগ ঘটছে না। এতে উত্তীর্ণ হতে গেলে প্রয়োজন ব্যক্তির সঙ্গে সমগ্রের বন্ধন। আত্মবোধ ও আত্মগত ঐতিহ্যের সঙ্গে বিশ্ববোধের সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই শান্তিনিকেতনের শিল্পকলা রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, বিনোদবিহারী, রামকিঙ্কর থেকে সোমনাথ হোর পর্যন্ত, আধুনিকতাবাদের এক আলোকিত অভিমুখ তৈরি করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় কে জি সুব্রহ্মণ্যন-ই ছিলেন সম্ভবত শেষ প্রতিনিধি।

সে দিনের সেই স্মরণ অনুষ্ঠানে শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা অর্পণ করেছিলেন রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, লালুপ্রসাদ সাউ, পঙ্কজ পওয়ার, শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়, রাখী সরকার ও প্রতীতি সরকার।

সদ্য প্রয়াত হয়েছেন ৯৪ বছর বয়সে আমাদের আর একজন শিল্পী সৈয়দ হায়দর রাজা। তাঁর প্রতিও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে রাখী সরকার বলেন তাঁর দার্শনিক প্রজ্ঞার কথা। বিমূর্তায়িত রূপকল্পে তিনি তাঁর ছবিতে উন্মীলিত করে গেছেন এক ভারতীয় আত্মপরিচয়।

আরও পড়ুন
Advertisement