যে বই ছাপার কথা ছিল না
bhagbad gita

কৃষ্ণের আধিপত্যকে যে বিনা প্রশ্নে মেনে নেবে, গীতায় শুধু তারই অধিকার?

গোটা বই জুড়ে পরিস্ফুট রাজশেখরের স্বাভাবিক স্পষ্টতা।

Advertisement
কুমার রাণা
শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৪১

শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা
রাজশেখর বসু
২০১৭

রূপে মজে গেলাম। এমন হস্তলিপি বিরল। পড়তে লেগে গেলাম রাজশেখর বসুর শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা-র অনুবাদ। দামোদর ধর্মানন্দ কোসম্বীর উপলব্ধি, “গীতাকে যত সম্মান করা হয়, লোকেরা বইটা ততখানি পড়ে না, বোঝে না।” কোর্ট, মৃতদেহ সৎকার, অগ্নিযুগে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড— সর্বত্র গীতার চল, অথচ মন দিয়ে গীতার পাঠ অনুধাবন করা তেমন একটা ঘটে না। গীতাকে ‘শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী’ হিসেবে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী উভয় পক্ষের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। এমন ভাবে শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা পড়ার সুযোগ পেয়ে কৃতার্থ হলাম।

Advertisement

বইটি পাণ্ডুলিপির অবিকল প্রতিলিপি। এতে আছে ‘ভূমিকা, মূল শ্লোক, অন্বয় ও অন্বয়ানুগামী অনুবাদ’। প্রথম পাতাতেই বড় হরফে লেখা: ‘এই বই ছাপা হবে না’। লোকে শোনেনি। ১৯৬০ সালে তাঁর মৃত্যুর পর এম সি সরকার থেকে এ বই ছাপা হয়। পাণ্ডুলিপিটি সংরক্ষিত ছিল রাজশেখরের প্রপৌত্র দীপঙ্কর বসুর কাছে। ২০১৭ সালে শিল্পী কে এস রাধাকৃষ্ণনের সহায়তায় পরিমল রায়, কাজি অনির্বাণ, দীপঙ্কর বসু এবং ভবানীপ্রসাদ দে এই প্রতিলিপি ছেপে বার করেন। মুদ্রণ, এক হাজার। পৃথিবীর প্রথম তারিখ সম্বলিত বই বজ্রচ্ছেদিকা প্রজ্ঞাপারমিতা (ডায়মন্ড সুত্ত) ছাপা হয়েছিল চিনে, সর্বসাধারণের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের উদ্দেশ্যে। বর্তমান বইটিও বিনামূল্যে বিতরণের জন্য।

গোটা বই জুড়ে পরিস্ফুট রাজশেখরের স্বাভাবিক স্পষ্টতা। প্রথমেই তিনি গীতা প্রসঙ্গে একটি সংক্ষিপ্ত, নয়টি উপ-শিরোনামে ভাগ করা, স্পষ্ট ভূমিকা লিখছেন। বিদ্যাতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর উপলব্ধি, “যেসকল বিষয় নিয়ে কোনও কাজ করতে হয় তাদের প্রকৃতি ও পরস্পর সম্বন্ধ না জানলে সিদ্ধিলাভ হয় না।” ভূমিকাটি যেন এই তত্ত্ব বিষয়ক উপলব্ধির ব্যবহারিক প্রয়োগ। এই রচনাই পাঠককে টেনে নিয়ে যায় বাংলা অনুবাদে দেওয়া মূল পাঠটির দিকে। রাজশেখর আমাদের জানাচ্ছেন, “গীতার অনেক অংশ দুর্বোধ, ভাষ্যটীকাকারগণের ব্যাখ্যাও বহুস্থলে বিভিন্ন।” কিন্তু, আমাদের মতো সংস্কৃতে অনভিজ্ঞ পাঠকের কাছে এই অনুবাদ যেন একটা নৌকাবিশেষ। রাজশেখরের অনুবাদ বিষয়ে কাউকে নতুন করে কিছু বলার নেই, শুধু এইটুকু বলার যে, ‘মূলের শব্দ যথাসম্ভব অনুবাদে বজায়’ রাখা সত্ত্বেও, কিংবা ‘বজায় রাখা’ হয়েছে বলেই এটা না পড়ে থাকা যায় না। এবং, “হে সঞ্জয়, ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেত যুযুৎসু (যুদ্ধাভিলাষী) আমার (পুত্রগণ) এবং পাণ্ডবগণ কি করলে?”— এই অনুবাদ পড়তে পড়তে পাঠক ‘ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ’, এই মূল শ্লোকে ঢুকে পড়তে প্রলুব্ধ হতে পারেন।

প্রলুব্ধ হওয়ারই কথা। কী ওজস্বী সে ছন্দ! বীর রসে পরিপূর্ণ। রাজশেখরের উপসংহারে— “গীতাধর্ম শৌর্যবীর্যাদি পুরুষোচিত গুণের এবং সমাজরক্ষার্থ নিষ্ঠুরতারও পরিপন্থী নয়।” সম্ভবত কিছুটা এই পেশিবহুলতার কারণেই, এবং কিছুটা এর অসামান্য কথনশৈলীর কারণে, এ গ্রন্থের এত জনপ্রিয়তা। অথবা, ‘আমাতেই শরণ নাও, তোমাকে কিছু করতে হবে না’— এই ফাঁকির রাস্তাটা দেখিয়ে দেওয়ার কারণেই লোকের কাছে এ গ্রন্থ এত মূল্যবান। না পড়েও এর গুণ অনুভব করা যায়। গীতায় ভাল ভাল কথা অনেক আছে, কিন্তু এর ছত্রে ছত্রে স্ববিরোধ। ‘কর্মেই তোমার অধিকার (ক্ষমতা), ফলে কদাচ নয়’ (২/৪৭) বলে নিষ্কাম কর্মের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে; আবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলা হচ্ছে, ‘বুদ্ধিযোগ অপেক্ষা কর্ম নিতান্তই নিকৃষ্ট; বুদ্ধির শরণ অন্বেষণ কর’ (২/৪৯)। কিন্তু তার চেয়েও বড় স্ববিরোধ হল, প্রচুর বাক্য বলার পরও বাক্যবলে অকৃতকার্য হয়ে কৃষ্ণের জাদুবিদ্যা ও ভীতি প্রদর্শনের শরণ নেওয়া। সারা গীতা জুড়ে অর্জুন কথা বলেছেন সামান্যই। প্রথম অধ্যায়ের আঠারো শ্লোকই তাঁর দীর্ঘতম কথা। এর মূল কথা, রাজ্যসুখের লোভে স্বজনহত্যা করা অন্যায়। তার পর একাদশ অধ্যায় পর্যন্ত এই সংশয় ব্যক্ত হয়ে চলেছে, সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের মধ্য দিয়ে। কৃষ্ণ প্রথমে তাঁকে তিরস্কার করলেন— ‘অনার্যের মতো আচরণ করো না’ (২/২); এবং তার পর সেই বিখ্যাত গালাগালি: ক্লৈব্য পেয়ো না (২/৩)। এর পর কৃষ্ণ নিজেকেই ব্রহ্মা, ইন্দ্র ইত্যাদি বলে আস্ফালন করে গিয়েছেন। তবু, অর্জুন তাঁর সন্দেহে স্পষ্ট: ‘বিমিশ্রিতের মতো (গোলমেলে) বাক্যে তুমি আমার বুদ্ধি যেন মোহগ্রস্ত করছ’ (৩/২); ‘তুমি আদিতে বলেছিলে এ কি করে জানব (বিশ্বাস করব)?’; ‘সন্ন্যাস না যোগ, কোনটা? একটা আমাকে স্পষ্ট করে বল।’ (৫/১) কৃষ্ণের বাগাড়ম্বরে তাঁর প্রতিক্রিয়া: ‘অমৃত (তুল্য বাক্য) শুনে আমার তৃপ্তি হচ্ছে না।’ (১০/১৮) এত ক্ষণ পর্যন্ত মিতবাক অর্জুনই কিন্তু গোটা কথোপকথনের নিয়ন্ত্রক, তাঁর প্রশ্ন দাবি করছে যুক্তিসঙ্গত উত্তর। কিন্তু, একাদশ অধ্যায়ে এসে অর্জুন ফাঁদে পড়লেন। কৃষ্ণের আত্মম্ভরী বক্তৃতার উত্তরে তার প্রমাণ চেয়ে বসলেন: ‘যা নিজের সম্বন্ধে বললে, তোমার সেই ঐশ্বরিক রূপ দেখতে ইচ্ছা করি’ (১১/৩)। কৃষ্ণ জাদুবিদ্যার সাহায্য নিলেন এবং অর্জুনকে ভয়ে কাঠ করে দিলেন। কৃষ্ণের বাক্য নয়, জয়লাভ করল ভীতি প্রদর্শন। কেন এক জনের কাছে নিষ্প্রশ্ন আত্মসমর্পণ করে যেতে হবে, কেন নিজের ধর্ম দোষযুক্ত হলেও তাকেই শ্রেয় বলে আঁকড়ে থাকতে হবে, কী ভাবে জানলাম মৃত্যু হলেই পুনর্জন্ম হবে— এ সবের উত্তর নেই। বরং, জোর করে প্রশ্নগুলোকে চেপে দেওয়াটাই এর ‘সাফল্য’।

আবার, রাজশেখর ধরিয়ে দিচ্ছেন, “গীতা সর্বসাধারণের জন্য রচিত হয়নি।” গীতায় তারই অধিকার, যে কৃষ্ণ-প্রাথম্যকে পরম আনুগত্যে মেনে নেবে। অন্য দিকে, গীতার বিধান, “জ্ঞানী ব্যক্তি নিজ আচরণ দ্বারা সামাজিক আদর্শ রক্ষা করবেন, যাতে জনসাধারণ একটা সুনির্দিষ্ট বিধিবদ্ধ সুগম মার্গ অনুসরণ করতে পারে।” গীতাকারের আশঙ্কা, “বিষয়াসক্ত অজ্ঞলোকের বুদ্ধিভেদ করলে কুতার্কিক সমাজদ্রোহীর উদ্ভব হবে।” উচ্চমার্গীয় দার্শনিকতার আড়ালে পরিষ্কার একনায়কতান্ত্রিক সমাজের তাত্ত্বিক ভিত পাকাপোক্ত করা।

আফসোস, যে রাজশেখর তাঁর ভূমিকায় এবং অনুবাদের মধ্যে মধ্যে গীতার নানা অ-যুক্তি ধরিয়ে দিচ্ছেন, “বর্তমান কালে গীতাসম্বন্ধে এই সতর্কতা অবলম্বন করা অসম্ভব” বলে বলছেন, তিনি নিজেই, হয়তো কোনও প্রাচীন সংস্কারের বশবর্তী হয়ে, গীতায় “সর্বকালের উপযোগী শ্রেষ্ঠ সাধন পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে” বলে উপসংহার টানছেন। সংস্কার ছোট সমস্যা নয়।

আরও পড়ুন
Advertisement