চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে অধ্যাত্মচেতনাও

ইমামি চিজেল আর্ট-এ অনুষ্ঠিত রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একক দেখলেন মৃণাল ঘোষ।রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি। ইমামি চিজেল আর্টসের উদ্যোগে তাঁদের গ্যালারিতে। প্রদর্শনীটি পরিকল্পনা করেছেন অর্চনা রায়। ১০৮-টি ছবি ও ভাস্কর্য নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনীতে এই শিল্পীর সাম্প্রতিক কাজের নানামুখী বিস্তার ধরা আছে, যার মূল উপজীব্য লৌকিক ও ধ্রুপদী চিত্ররীতির প্রজ্ঞাদীপ্ত সুষম সমন্বয়। আচার্য নন্দলাল বসুর সুযোগ্য শিষ্য এই শিল্পীকে বলা যেতে পারে এই সময়ে নব্য-ভারতীয় ঘরানার একজন সফল প্রতিনিধি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০১

রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি। ইমামি চিজেল আর্টসের উদ্যোগে তাঁদের গ্যালারিতে। প্রদর্শনীটি পরিকল্পনা করেছেন অর্চনা রায়। ১০৮-টি ছবি ও ভাস্কর্য নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনীতে এই শিল্পীর সাম্প্রতিক কাজের নানামুখী বিস্তার ধরা আছে, যার মূল উপজীব্য লৌকিক ও ধ্রুপদী চিত্ররীতির প্রজ্ঞাদীপ্ত সুষম সমন্বয়। আচার্য নন্দলাল বসুর সুযোগ্য শিষ্য এই শিল্পীকে বলা যেতে পারে এই সময়ে নব্য-ভারতীয় ঘরানার একজন সফল প্রতিনিধি।

আমাদের দেশে ঔপনিবেশিক অধীনতার পরিমণ্ডলে নব্য-ভারতীয় ঘরানা শিল্পের আধুনিকতায় দেশীয় আত্মপরিচয়ের সন্ধান করেছিল। বিংশ শতকে এই ঘরানার আন্দোলনই ছিল একমাত্র আঙ্গিকবাদী আন্দোলন, যা নিজস্ব ঐতিহ্যের ভিত্তির বিশ্বগত বিস্তার চেয়েছিল। তা নিছক অতীতের পুনরুজ্জীবন ছিল না। এই ঘরানার প্রথম পথিকৃৎ ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৯৭ থেকে ১৯৪০-এর দশক পর্যন্ত তাঁর কাজের বহুমুখী বিস্তার যদি আমরা দেখি, তাহলে অনুধাবন করা যায় কেমন করে ঐতিহ্যের নানা দিগন্তকে তিনি প্রসারিত করেছিলেন কেবল প্রাচ্যচেতনাতেই নয়, বিশ্বগত প্রজ্ঞায়ও। তাঁর ১৯৩০-এর ‘আরব্যরজনী’ চিত্রমালা বা ১৯৩৮-এর ‘কবি কঙ্কনচণ্ডী চিত্রমালা’ এই প্রজ্ঞারই দৃষ্টান্ত। এখানে পুনরুজ্জীবন বা ‘রিভাইভালিজম’ কোথায়? তেমনি তাঁর ছবিতে পুরাণকল্পের প্রভাব ছিল। কিন্তু ১৯২০-র পর শান্তিনিকেতন পর্যায়ে তাঁর স্বদেশসন্ধানে সমকালীন বাস্তবই প্রাধান্য পেয়েছে। শেষ পর্যায়ে ছোট চিত্রপটে তিনি যে ছোট কোলাজধর্মী ছবি করেছেন, তাতেই বা পুনরুজ্জীবন কোথায়? নব্য-ভারতীয় ঘরানার অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী সম্বন্ধেই এ কথা বলা যায়।

Advertisement

তবু নব্য-ভারতীয় ঘরানাকে পুনরুজ্জীবনবাদী বলার প্রবণতা আজও দূর হল না। আলোচ্য প্রদর্শনীর স্মারকপত্রে শিল্পীর পরিচয় দিতে গিয়ে লেখা হয়েছে : The revivalist movement led by Abanindranath Tagore and developed by Nandalal Bose in Santiniketan helped a lot to produce a number of talented painters, Ramananda is one of them’. ‘রিভাইভালিজম’-এর ভুল না ভাঙলে নব্য-ভারতীয় ঘরানাও বোঝা যায় না, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিও বোঝা যায় না।

রামানন্দের নিজের অবস্থান চিহ্নিত করতে গিয়ে একবার বলেছিলেন- ‘শহরে আমি গ্রামের প্রতিনিধি’। গ্রামীণ সংস্কৃতিকে তিনি নাগরিক বিদগ্ধতায় বিকশিত করেছেন। লৌকিক প্রজ্ঞা আমাদের আধুনিকতার আত্মপরিচয় নির্মাণে প্রভূত অবদান রেখেছে। রামানন্দ এই লৌকিককে আত্মস্থ করেছেন প্রধানত দুটি উৎস থেকে। এক দিকে রয়েছে তাঁর পারিবারিক উত্তরাধিকার এবং গ্রামীণ পরিমণ্ডলে তাঁর শৈশব ও কৈশোরের বিকাশ। আর এক দিকে শান্তিনিকেতনে নন্দলাল বসুর সাহচর্য ও শিক্ষা। এর ভিতর দিয়ে তিনি যে লৌকিক সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করেছেন, তা পরিশীলিত হয়েছে আর একটি উৎসের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে। তা হল তাঁর অধ্যাত্মচেতনা। এই অধ্যাত্মচেতনাও তিনি পারিবারিক উৎস থেকে যেমন পেয়েছেন, তেমনই পেয়েছেন পরিণত পর্বে রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে তাঁর সংযোগ থেকে। লৌকিকের ভিতর আধ্যাত্মিকতার স্ফুরণেই তাঁর ছবি স্পন্দিত করে।

তাঁর রূপাবয়ব এমনভাবে রূপান্তরিত হয়েছে যে তাতে আধুনিকতার অনিবার্য মাত্রা এসেছে। অবয়বের ছায়া অনুসরণ করে, তার যে সংক্ষিপ্তকরণ তিনি করেছেন, সেই রূপান্তরণে রূপারোপের পরিশীলিত অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়। তাঁর রেখার ব্যবহার শরীরের বাইরের পরিসীমাকে বর্ণনা করেও এর জ্যামিতিকে সুন্দরভাবে উন্মীলিত করে। অবয়বের এই জ্যামিতিক বিশ্লেষণ, রেখার কৌণিক সংস্থানের ভিতর দিয়ে, শরীরে যে বিভিন্ন মাত্রা ফুটে ওঠে, এটাই লৌকিক রীতিকে প্রসারিত করে আধুনিকের মূল্যমানে সঞ্জীবিত করে।

আলোচ্য ছবি ও ভাস্কর্যে মানুষ ও প্রকৃতির একাত্মতা অনুভব করা যায়। একাকী মানবী বসে আছে। হাতে পদ্মফুল। তাঁকে ঘিরে কয়েকটি পাখি। রেখা, আলো ও ছায়াতপকে নানা মাত্রায় ব্যবহার করে তিনি অভিব্যক্তির বিভিন্ন ব্যঞ্জনা এনেছেন। কোথাও পৌনঃপুনিকতা আনে না।

আরও পড়ুন
Advertisement