চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

গভীর প্রতিবাদী মননে আটটি ছাগ-মুণ্ড

বিড়লা অ্যাকাডেমির বার্ষিক যৌথ প্রদর্শনীটি দেখে এসে লিখছেন মৃণাল ঘোষ।স্মৃতির বিশেষ ভূমিকা থাকে ললিতকলা ও ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে। সম্ভবত অন্যান্য জ্ঞান ও মননচর্চার থেকে কিছু বেশি। ব্যক্তিগত স্মৃতির পাশাপাশি কাজ করে যৌথ-সচেতনতা বা নিশ্চেতনা-সংজ্ঞাত স্মৃতিও। এই ভাবনাকে মনে রেখে এ বছর বিড়লা অ্যাকাডেমির ৪৮-তম বার্ষিক প্রদর্শনীতে একটি বিশেষ বিভাগ পরিকল্পিত হয়েছে, যার শিরোনাম ‘আমার স্মৃতি, তোমার ইতিহাস: উত্তরের আখ্যান’।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৫ ০০:০১

স্মৃতির বিশেষ ভূমিকা থাকে ললিতকলা ও ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে। সম্ভবত অন্যান্য জ্ঞান ও মননচর্চার থেকে কিছু বেশি। ব্যক্তিগত স্মৃতির পাশাপাশি কাজ করে যৌথ-সচেতনতা বা নিশ্চেতনা-সংজ্ঞাত স্মৃতিও।

এই ভাবনাকে মনে রেখে এ বছর বিড়লা অ্যাকাডেমির ৪৮-তম বার্ষিক প্রদর্শনীতে একটি বিশেষ বিভাগ পরিকল্পিত হয়েছে, যার শিরোনাম ‘আমার স্মৃতি, তোমার ইতিহাস: উত্তরের আখ্যান’। প্রদর্শনীটি পরিকল্পনা করেছেন প্রিয়া পাল। গত বছর বিড়লার বার্ষিকীতে উপস্থাপিত হয়েছিল দক্ষিণ ভারতের সৃজনসম্ভার। এবার আলোকপাত ঘটেছে উত্তর ও পূর্ব ভারতের দিকে।

Advertisement

স্মৃতির ভূমিকার নানা অনুষঙ্গ নিয়ে কাজ করেছেন ১৭ জন প্রখ্যাত শিল্পী। প্রথম ধারায় সমৃদ্ধ রচনা পেয়েছি অর্পিতা সিংহ, নীলিমা শেখ, অপর্ণা কৌর ও হেমা উপাধ্যায়ের কাছ থেকে। অর্পিতার তিনটি ছবির মধ্যে অনামা একটি ছবি আতঙ্কিত ধ্বংসের স্মৃতি জাগায়। একটি ফলন্ত মহীরুহ যেন সরীসৃপসম অগ্নিস্ফুলিঙ্গে ছেয়ে গেছে। দু’পাশে রয়েছে আতঙ্কিত পুরুষ ও নারী। নীলিমা শেখের সম্বৃত-বর্ণের নিসর্গটিতে ধ্রুপদী ঐতিহ্য আধুনিকতায় অন্বিত হয়েছে। হেমা উপাধ্যায় অসংখ্য চাল জুড়ে জুড়ে এঁকেছেন মৃত নিসর্গে মাছেদের মুখ।

স্মৃতি যেখানে শিল্পের উৎস সেরকম বেশ কয়েকটি সফল কনসেপচুয়াল কাজের দৃষ্টান্ত রয়েছে এই প্রর্দশনীতে। সোনিয়া খুরান্নার ‘দ্য ওয়র্ল্ড’ শীর্ষক ৭ মিনিট দৈর্ঘ্যের ভিডিও-টি দেশভাগের স্মৃতিকে বিনির্মাণ করেছে। ১৯৮৪-র দিল্লিতে দাঙ্গায় শিখ-নিধনের স্মৃতি নিয়ে কাজ করেছেন অতুল ভাল্লা। পলা সেনগুপ্তর আঙ্গিকে মানবীচেতনা সবসময়ই গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এক সময় তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে চিত্র ও লিখিত আখ্যানের সমন্বয়ে নিজস্ব রীতির আঙ্গিক গড়ে তুলতে। এই প্রদর্শনীতে তিনি কাজ করেছেন তিব্বতের ইতিহাস-সম্পৃক্ত স্মৃতি নিয়ে। তার রচনা সব সময়ই দর্শকের কাছে গভীর অভিনিবেশ দাবি করে। তুষার-দংশনে মৃত্যুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে বাপটিস্ট কোয়েলহো-র রচনায়, যার মধ্যে একটিতে তিনি অজস্র ব্যান্ডেজের স্তূপ জড়ো করেছেন। অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংস নিয়ে ইনস্টলেশনধর্মী কাজ করেছেন রাম রহমান। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল গৌরী গিল, গিগি স্কারিয়া, পূজা ইরান্না, রিদ্ধি শা, বিভা গলহোত্রা, ওয়াসো এক্স ওয়াসো প্রমুখ শিল্পীর।

বার্ষিক প্রদর্শনীর প্রধান বিভাগ নির্বাচনমূলক তরুণ শিল্পীদের কাজ। ৪৩০-জন শিল্পী এবার কাজ পাঠিয়েছিলেন। নির্বাচিত হয়েছেন ১৩২-জন। এর মধ্যে বিভিন্ন বিভাগে পুরস্কৃত হয়েছেন ১৬-জন।

আশিস কুমার মাহাসুদ-এর ‘ভার্চুয়াল কনফারেন্স’ উপস্থাপনাটি অসামান্য দৃষ্টান্ত। ভারতের ধ্রুপদী-অতীতের দুটি মুখাবয়বের পাশাপাশি তিনি উপস্থাপিত করেছেন রবীন্দ্রনাথের একটি মুখাবয়বচিত্র। তিন যুগের এই তিনটি মুখের কল্পিত সংলাপ তাঁর ভিডিও-টির উপজীব্য। দুর্বানন্দ জানা বেলুনের প্রতীকে দেখিয়েছেন অতিরিক্ত উচ্চাশা কেমন করে ধ্বংস ডেকে আনে।

কাঞ্চন কার্জি-র ভাস্কর্যে দেখা যাচ্ছে আকাশ থেকে উল্টোভাবে ঝুলন্ত একটি টিউবওয়েল। দূষণে জলসংকটের করুণ পরিস্থিতি। সুবীর কুমার মণ্ডলের ‘ডেস্ট্রয়িং এনক্লোজার’ একগুচ্ছ কাঁটাতার কাটার দৃশ্য।

গণেশ দাসের ‘উন্ডেড’ জলরঙের রচনাটি খুবই সহজ অথচ গভীর প্রতিবাদী মননে সমৃদ্ধ। আটটি পটে তিনি সাজিয়েছেন ছাগলের আটটি ছিন্ন মুণ্ড। প্রীতম দাসের ‘সরমা মেডিকেল হল’ শীর্ষক ক্যানভাসেও ঐতিহ্যগত উপস্থাপনার মধ্যে বিপন্ন এক রিক্ততা আভাসিত হয়েছে। সম্ভ্রান্ত পরিমণ্ডলে সুসজ্জিত খাওয়ার টেবিলে কাঁটা-চামচ নিয়ে শিয়ালদের ভোজের দৃশ্য এঁকেছেন পার্থ কবিরাজ ‘ডেস্ট্রয়েড ভার্সন’ শীর্ষক ছবিতে। সৌম্য কিশোর চক্রবর্তী-র মিশ্রমাধ্যমে ‘হানিকম্ব’ শীর্ষক মৌচাকের উপস্থাপনাটি সমৃদ্ধ প্রকরণ ও আঙ্গিকচেতনার দৃষ্টান্ত, আজকের বিশ্বায়িত শিল্পপ্রজ্ঞা থেকে যা উঠে এসেছে। বিভাস চক্রবর্তী ‘দ্য ভেটেরান’ কলকাতার নিসর্গকে বিমূর্তায়িত করেছেন শিল্পঋদ্ধভাবে। চিত্রাঞ্জন মহারাণা-র আলোকচিত্র ‘দ্য রেইন’ সমৃদ্ধ বুনোটের মধ্য দিয়ে যেন এক দূষিত বর্ষণের অনুষঙ্গ তুলে আনে। খুবই মননঋদ্ধ উমা রায়ের আলোকচিত্রে সাদাকালো নাগরিক-নিসর্গটিও। এভাবে প্রদর্শনীর অধিকাংশ কাজই যথেষ্ট উচ্চমানের।

আরও পড়ুন
Advertisement