পুস্তক পরিচয় ১

কত ভাষা কত স্বর: কান পাতা চাই

ভারত বহু ভাষার দেশ। সাগর ডিঙিয়ে আসা সাহেবরা এ দেশের ভাষা-বৈচিত্রকে বিশেষ ভাবে নির্ধারণ করতে চেয়েছিল। সব ভারতীয় ভাষা তাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৭:০০

ভারতীয় ভাষা লোক সর্বেক্ষণ/ পশ্চিমবঙ্গের ভাষা

সম্পাদক: শংকরপ্রসাদ সিংহ ও ইন্দ্রনীল আচার্য

Advertisement

২৬৫০.০০

ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান

ভারত বহু ভাষার দেশ। সাগর ডিঙিয়ে আসা সাহেবরা এ দেশের ভাষা-বৈচিত্রকে বিশেষ ভাবে নির্ধারণ করতে চেয়েছিল। সব ভারতীয় ভাষা তাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বাণিজ্য ও প্রশাসনের স্বার্থ বজায় রাখার জন্য তারা কতগুলি ভাষাকে বেশি ও কতগুলি ভাষাকে কম মর্যাদা দিয়েছিল। হিন্দুস্থানি আর বাংলা যতটা গুরুত্ব পেয়েছিল, অসমিয়া বা ওডিয়া ততটা গুরুত্ব পায়নি। ওডিয়া অসমিয়াকে এক সময় আত্মমর্যাদা রক্ষা করার জন্য বাংলা ভাষার সঙ্গে রীতিমত লড়াই করতে হয়েছিল। ভাষা রাজনীতির এই পরিসরে ভাষা ব্রাত্য হয়ে যায়, হারিয়ে যায়, ভাষার মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। অনুভবপরায়ণ ভাষাভাবুকেরা এই রাজনীতির বিরোধিতা করার জন্য কোনও ভৌগোলিক পরিসরে ব্যবহৃত বিভিন্ন ভাষাকে ‘ছোট’ ‘বড়’ নির্বিশেষে সমমর্যাদা দিতে চান। মর্যাদা প্রদানের প্রথম ধাপ হল নানা ভাষার ইতিহাস-সংস্কৃতি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা, তথ্য নথিবদ্ধ করা। গণেশ দেবীর নেতৃত্বে ‘ভারতীয় ভাষার লোক সর্বেক্ষণ’-এর কাজ শুরু হয়েছে। উপনিবেশ-পর্বের ভাষা রাজনীতির ‘পাপ’ দূর করা এই কাজের লক্ষ্য। তফসিল সব ভাষাকে জায়গা দেয়নি। তফসিলের বাইরে যে ভাষাগুলি আছে সেগুলির খোঁজ নেওয়া জরুরি। গণেশ দেবী ও তাঁর সহযোগীরা সে কাজ করছেন। পশ্চিমবঙ্গ যে কেবল বাংলাভাষীদের ভূমি নয় এই খণ্ডটি হাতে নিলে তা টের পাওয়া যায়। ভদ্রলোক বাঙালিরা যাঁদের গণ্য করেন না সেই জনজাতিগুলির নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। কুড়মালি, কুড়ুখ, খেড়িয়া শবর, ধিমাল— কত ভাষা কত স্বর। কান পাতা চাই। সেই কাজ শুরু হয়েছে। তবে ‘পশ্চিমবঙ্গের ভাষা’ শীর্ষক এই খণ্ডটি মন দিয়ে দেখলে কতকগুলি কথা মনে হয়। ভাষা ও সংস্কৃতির পরিচয় কী ভাবে দেওয়া হবে তা নিয়ে এই খণ্ডের দুই সম্পাদক শংকরপ্রসাদ সিংহ ও ইন্দ্রনীল আচার্য কোনও সাধারণ নীতি গ্রহণ করেননি। ফলে নানা জন নানা রীতিতে ভাষা-সংস্কৃতির পরিচয় দিয়েছেন। কারও লেখায় তথ্য কম, আবেগ বেশি। ভাষা ভাবনায় আবেগ জরুরি তবে লেখায় তথ্যহীন আবেগ অকারণ। পশ্চিমবঙ্গের ‘চেনা ভাষা’ বাংলা নিয়ে এই বইতে লিখেছিলেন বীতশোক ভট্টাচার্য। বাংলা ভাষা সম্বন্ধে কবি-প্রাবন্ধিক বীতশোকের নানা অভিমান সে লেখায় প্রকাশিত। আবেগ ও ব্যক্তিগত অভিমত এ-জাতীয় বইতে অপ্রয়োজনীয়। ‘উপভাষা’ শব্দটি এই বইতে নানা লেখায় ফিরে ফিরে আসে। ‘উপভাষা’ শব্দটি ভাষার রূপভেদকে ‘উপত্ব’ প্রদান করে খাটো করে। এ বইটি তো ভাষাকে খাটো করার রাজনীতির বিরোধিতা করার জন্যই লেখা!

স্বাধীনোত্তর বাংলার লিটল ম্যাগাজিন/ চর্চা ও চর্যা

সম্পাদক: তপন গোস্বামী, আশিস চক্রবর্তী, অসীম চট্টরাজ, রামানুজ মুখোপাধ্যায়

২৫০.০০

আশাদীপ

লিটল ম্যাগাজিনও একটি সাময়িকপত্র, তবে তার চরিত্র, আয়তন, প্রচার এবং আয়ু অন্যান্য সাময়িকপত্র থেকে আলাদা। এ ব্যাপারে প্রাঞ্জল করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু ‘সাহিত্যপত্র’ রচনায়— ‘লিটল কেন? আকারে ছোট বলে? প্রচারে ক্ষুদ্র বলে? না কি বেশি দিন বাঁচে না বলে? সব কটাই সত্য, কিন্তু এগুলোই সব কথা নয়; ওই ‘ছোট’ বিশেষণটাতে আরো অনেকখানি অর্থ পোরা আছে। প্রথমত, কথাটা একটা প্রতিবাদ: একজোড়া মলাটের মধ্যে সব কিছুর আমদানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ...এটি কখনো মন যোগাতে চায়নি, মনকে জাগাতে চেয়েছিল। চেয়েছিল নতুন সুরে কথা বলতে।... এটাই লিটল ম্যাগাজিনের কুলধর্ম।’ বাংলা সাময়িকপত্রের দ্বিশতবর্ষে লিটল ম্যাগাজিন চর্চার ওপর গবেষণা-নিবন্ধের একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থে এক দিকে যেমন সামগ্রিক ভাবে লিটল ম্যাগাজিনের নানান দিক এবং সমস্যা নিয়ে আলোচনা রয়েছে, তেমনই অন্য দিকে চরিত্রস্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আঞ্চলিক লিটল ম্যাগাজিন চর্চার পরিসরও কয়েকটি প্রবন্ধে আছে। সংযোজন অংশে ঠিকানাসহ এ সময়ের কিছু উল্লেখযোগ্য লিটল ম্যাগাজিনের নাম মুদ্রিত হয়েছে। আলোচ্য বইটি সাধারণ পাঠকদের কাছে যেমন, লিটল ম্যাগাজিনের গবেষকদের কাছেও তেমনই নানান ভাবে সমাদৃত হওয়ার রসদ নিয়ে অপেক্ষা করছে।

বুদ্ধির মুক্তি শিখা ও আবুল হুসেন

সম্পাদক: বেনজীন খান

৬০০.০০

প্রাচ্য আকাদেমি (বাংলাদেশ), পরি: বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ

১৯২৬ সালে ঢাকায় কয়েকজন মুসলিম তরুণ গড়ে তোলেন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। ধর্ম ও শাস্ত্রের অন্ধ অনুসরণের বিরুদ্ধে এবং মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তির পক্ষে ওই তরুণরা যে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন শুরু করেন তাতে নেতৃত্ব দেন আবুল হুসেন। সাহিত্য সমাজের মুখপত্র ‘শিখা’ সম্পাদনার দায়িত্ব ছিল তাঁর। কাজি আবদুল ওদুদ, কাজি মোতাহার হোসেন, মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, আবুল ফজলরা ছিলেন ওই আন্দোলনে। সাহিত্য সমাজের অন্যেরা যতটা পরিচিত আবুল হুসেন ততটা নন। তিনি বলতেন, ‘বোরকা মুসলমান নারীর দুর্বলতার চরম নিদর্শন।’ সুদ হারাম বা চুরির শাস্তি হাত কেটে নেওয়ার মতো শরিয়ত আইন সময়োপযোগী নয় বিধায় দেশের মুসলমানদের প্রচলিত আইনের আশ্রয়ে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এই সব লেখালিখির জন্য ঢাকার প্রভাবশালী মুসলিমদের সালিশি সভার নির্দেশে তাঁকে ৪০ হাত নাক খত এবং লিখিত মুচলেকা দিতে হয়। লাঞ্ছিত, অপমানিত আবুল হুসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। মাত্র ৪১ বছর জীবনকালে তিনি বহু প্রবন্ধ এবং গল্প লিখেছেন। ১০৯ বছর পরেও তাঁর সব লেখা প্রকাশ হয়নি। বাংলাদেশে আজ ইসলামপন্থীরা যে ভাবে মুক্তচিন্তকদের কণ্ঠরোধ করতে নেমেছে, সম্পাদক বেনজীন খান মনে করেন, সেখানেই আবুল হুসেন এখন প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। বাংলাদেশের বিদ্বজ্জন ও মুক্ত মনের লেখকদের নতুন পুরনো লেখা দিয়ে সাজিয়েছেন বৃহৎ সংকলনটি। আবুল হোসেন স্মরণে তোমার, সময়ের বিবেক তুমি, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন, ঝড়ের উৎসবিন্দু, বিক্ষোভ-বিদ্রোহ, মুসলিম সাহিত্য সমাজ ও চিঠিপত্র— এই সাত ভাগে বিভক্ত বইটি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement