মানবিক আদানপ্রদানের কথা উঠে এল না

শিবনাথ শাস্ত্রী হিস্ট্রি অব দ্য ব্রাহ্ম সমাজ (১৯১১) বইয়ে মোটামুটি ১৯১০ পর্যন্ত ব্রাহ্মসমাজের ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ করেন। আলোচ্য খণ্ড দুটির সম্পাদকীয় ভূমিকায় ১৯২০-২০১০ সালের মধ্যবর্তী পর্বের ঘটনার পঞ্জিকরণ করে এটিকে শাস্ত্রীর কাজের ‘সম্প্রসারণ ও সম্পূরণ করার বিনম্র প্রয়াস’ বলে দাবি করা হয়েছে।

Advertisement
অমলশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০৪
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ, কলকাতা

সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ, কলকাতা

শিবনাথ শাস্ত্রী হিস্ট্রি অব দ্য ব্রাহ্ম সমাজ (১৯১১) বইয়ে মোটামুটি ১৯১০ পর্যন্ত ব্রাহ্মসমাজের ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ করেন। আলোচ্য খণ্ড দুটির সম্পাদকীয় ভূমিকায় ১৯২০-২০১০ সালের মধ্যবর্তী পর্বের ঘটনার পঞ্জিকরণ করে এটিকে শাস্ত্রীর কাজের ‘সম্প্রসারণ ও সম্পূরণ করার বিনম্র প্রয়াস’ বলে দাবি করা হয়েছে। ব্রাহ্ম আন্দোলন এই পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল মধ্যাহ্নদীপ্তির অবসানে নিজের অস্তগামী ছায়ায় পর্যবসিত হয়ে এসেছিল। তবু এই উদ্যোগ ব্রাহ্ম ইতিহাসের তথ্য চয়নের ক্ষেত্রে আরেকটি সংযোজন।

এই পর্যায়ে ব্রাহ্ম সমাজের অবস্থা নিয়ে ইতিহাস অনুসন্ধিৎসুদের মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সূচিপত্র অনুসরণ করলে চোখে পড়বে যে উত্তরকালের গ্রহণবর্জনের প্রক্রিয়ায় সেই প্রশ্নগুলির উত্তর আপনাআপনিই বেরিয়ে এসেছে। গৌরবময় সেই পর্যায়টিতে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের সাংবৎসরিক প্রতিবেদনে যে ‘ব্রাহ্ম সমাজগুলির তালিকা’ প্রকাশিত হত, তাতে ‘পশ্চিমবঙ্গের সমাজ’ বলে কোনও বিভাগই থাকত না। কারণ তখনও বঙ্গদেশের অঙ্গহানি হয়নি। সেই পর্যায়ে, ১৮৯২ সালে অবিভক্ত বাংলায় যেখানে ১২৪টি সমাজের উল্লেখ পাই— এই বইটিতে সেখানে পাচ্ছি মাত্র ১৫টি সমাজ সম্পর্কিত তথ্য— যার সব ক’টিই এপার বাংলায়; ‘তার সঙ্গে পূর্বকালের অনেক স্বল্পজ্ঞাত তথ্য’— দৃশ্যতই কালের কষ্টিপাথরে যাচাই করা। সেই তথ্যের সারবত্তা কতটা ?

Advertisement

কলকাতায় ব্রাহ্মদের কাজকর্ম সুপরিজ্ঞাত। বেসরকারি সংগঠন হওয়ায় মহাফেজখানার নথিতে ব্রাহ্মদের সম্বন্ধে তদতিরিক্ত উল্লেখ কমই পাওয়া যায়। পর্যাপ্ত শিক্ষিত, ইতিহাসসচেতন ব্রাহ্মরা উত্তরকালের জন্যে নিজেদের কাজকর্মের সবুদ নিজেরাই সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে গিয়েছেন। এর মধ্যে আছে জীবনী, আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা, সংশ্লিষ্ট সমাজ প্রযোজিত ইতিহাস, ইস্তেহার জাতীয় পুস্তিকা, কলকাতা ও মফস্সলের সমাজগুলি প্রকাশিত ইংরেজি বা বাংলা সাময়িকীতে প্রকাশিত তথ্য, প্রচারকদের প্রতিবেদন ইত্যাদি। সেই তথ্যভাণ্ডার ব্যবহার করলে উনিশ শতকের চল্লিশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত ঢাকা, ময়মনসিংহ ও বরিশাল শহরে ব্রাহ্মদের কর্মকাণ্ডের যে পরিচয় মেলে তাতে একটি তথ্যকে অন্য একটি তথ্য উৎস দিয়ে যাচাই করা সম্ভব। কয়েকশো জন করে মানুষ ব্রাহ্ম আদর্শ অবলম্বন করে নিরবচ্ছিন্ন পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে ওই শহরগুলিতে নিজেদের আর আশপাশের লোকজনের সঙ্গে আদানপ্রদানের মাধ্যমে বিকাশমান একটি সম্প্রদায়ের যে প্রাণতরঙ্গ জাগিয়ে ছিলেন তা হয়তো দুনিয়া কাঁপানো কোনও ঘটনা হয়ে উঠতে পারেনি, কিন্তু মানবিক আবেদনে তা যৎসামান্য ছিল না। সেটাই ব্রাহ্ম বলে মানুষদের ইতিহাস— আলোচ্য পর্যায়ের মতো ঘর, বাড়ি, প্রতিষ্ঠান কি সম্মেলনেই সীমাবদ্ধ নয়। এই রকম প্রাণপ্রাচুর্যসম্পন্ন জীবনের তথ্যসূত্রের সুবিপুল সমাবেশ সমসাময়িক বা পরবর্তী কোনও সমাজের ক্ষেত্রে অলভ্য।

উপাদান হিসেবে তাই বাণীবন সমাজের এককড়ি সিংহরায় (১ম খণ্ড, পৃ: ১৪২), কি শিলঙের সারদামঞ্জরী দত্ত (১ম খণ্ড, পৃ: ২৩৯, ২৪৮) বা খাটুরা মঙ্গলগঞ্জের লক্ষ্মণচন্দ্র আশ’দের মতো ব্যক্তির জীবনকাহিনির সূত্রপাত হয়তো ব্রাহ্মদের গৌরবোজ্জ্বল পর্যায়েই। আলোচ্য পরিসরে পরবর্তী কালেরও দু-দশ জন মানুষ এসেছেন গিয়েছেন। তা কিন্তু মূলত একক ব্যক্তিত্ব বা এক বা কয়েকটি পরিবারের খণ্ড খণ্ড কালের ইতিহাসের উপাদান। নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অনেক মানুষের আদানপ্রদানের মধ্যে আপন গতিতে গড়ে ওঠা সম্পর্ক-জালের সুসম্পৃক্ত তথ্য নয়। দূরবিন দিয়ে বিশাল এক ক্ষেত্রকে অতি দ্রুত সার্ভে করা হয়তো সম্ভব— কাছে বসে প্রাণের আলাপ কিন্তু শোনা হয় না।

তথ্য উৎসের এমন হাল হওয়ার কারণ হিসেবে সম্পাদক যথার্থই নির্দেশ করেছেন ‘সোশাল অ্যাটমাইজেসন’কে (১ম খণ্ড, পৃ: ১৮), যার ফলে “অনেক ক্ষেত্রেই স্বতন্ত্র সমাজটির অস্তিত্ব নির্ভর করে এক (বা একাধিক) পরিবারের এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের হাতে দীপবর্তিকা হস্তান্তরের ওপর।” তাই অন্ধ্রপ্রদেশের চিরালায় শতাধিক বছরের পুরনো সমাজটির ১৯০২, ’১০, ’২৫, ’৫০-এর পর ২০০২-’০৪ সালের ঘটনাবলি মাত্র আড়াই পাতায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে হয়। অল ইন্ডিয়া ব্রাহ্ম কনফারেন্সের সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের বাইরের সমাজগুলির যে তথ্যসূত্রের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, সে সম্পর্কেও এই একই কথা খাটে। না হলে প্রতিটি অধ্যায় সংলগ্ন সম্ভ্রম উদ্রেককারী তথ্যসূত্রের উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও সেখানকার সমাজগুলির ইতিহাস এত খাপছাড়া কেন? বেরহামপুরের সমাজটির জন্য বরাদ্দ তিনটি লাইনের মূল বক্তব্য শুধু তিন জন প্রচারকের নাম। ২০০৮-’১২ সালে নেওয়া সাক্ষাৎকারে বিশ শতকের মাঝামাঝি নিজের (যা আসলে পিতৃপুরুষদের মুখ থেকে শোনা) স্মৃতি থেকে কতটা উদ্ধার করা সম্ভব সে সম্বন্ধেও প্রশ্ন থেকে যায়।

এখানে তাই নিবিড় মানবিক আদানপ্রদানের স্থান নিয়েছে অনেক দ্বৈতয়িক তথ্য, দূরাগত ভাবে সংশ্লিষ্ট তথ্য আর অত্যন্ত বেশি করে ব্রাহ্মদের শিক্ষাগত উদ্যোগের কাহিনি। উচ্চশিক্ষার কিছু কেন্দ্র ব্রাহ্মগণ প্রতিষ্ঠা করে এখনও পরিচালনা করে আসছেন সত্য। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরের ঘটনা তো সেই স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলির ইতিহাস; যা চলে তার আপন প্রয়োজনের তাগিদে। আর ব্রাহ্মগণ পরিচালিত শিক্ষা উদ্যোগের কথা যদি ধরতে হয়, তবে তার মধ্যে পাচ্ছি ব্রাহ্মদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত (কি না— বোঝা যাচ্ছে না) হরিনাভি বিদ্যালয়টির বিখ্যাত তিন ছাত্রের (জানকীনাথ বসু, মানবেন্দ্রনাথ রায় ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়) কথা; তাঁরা কি ব্রাহ্মভাবাপন্ন ছিলেন ?

মুখবন্ধ ও সম্পাদকীয়তে বইটির খসড়া দু’বার আগাগোড়া সংশোধন করা হয়েছে বলা সত্ত্বেও কিছু কিছু সম্পাদনাগত শিথিলতা নজরে পড়ে।

ব্রাহ্ম সমাজেস্ ইন ইন্ডিয়া: আ রিসেন্ট হিস্ট্রি (১৯২০-২০১০)/ ইনক্লুডিং সাম লিটল নোন ফ্যাক্টস অব আর্লিয়ার টাইম, খণ্ড ১: ইস্টার্ন ইন্ডিয়া, খণ্ড ২: সমাজেস ইন সাউথ, ওয়েস্ট, সেন্ট্রাল অ্যান্ড নর্থ ইন্ডিয়া অ্যান্ড অল ইন্ডিয়া ব্রাহ্ম কনফারেন্স। প্রসাদ সেন ও পরীক্ষিত ঠাকুর, সম্পা: পার্থপ্রতিম বসু। প্যাপিরাস, মোট ৩০০.০০

আরও পড়ুন
Advertisement