চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

শান্তিনিকেতনী ধারায় প্রসারিত আলপনা শিল্প

সম্প্রতি জীবনস্মৃতি গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত একক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষ।আলপনা কথাটির আভিধানিক অর্থ ‘মাঙ্গল্য চিত্র’। পুরোনো বাংলায় একে ‘আলিপনা’-ও বলা হত, যার অর্থ ‘পিটুলি দ্বারা দেবস্থান গৃহদ্বারাদি লেপন বা চিত্রকরণ’। এটিকে সংস্কৃত আলিম্পন-শব্দজাত বলেও মনে করা হয়। এর সঙ্গে আইল প্রস্তুত করার সম্পর্কের কথাও বলেন অনেকে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৬ ০০:০০

আলপনা কথাটির আভিধানিক অর্থ ‘মাঙ্গল্য চিত্র’। পুরোনো বাংলায় একে ‘আলিপনা’-ও বলা হত, যার অর্থ ‘পিটুলি দ্বারা দেবস্থান গৃহদ্বারাদি লেপন বা চিত্রকরণ’। এটিকে সংস্কৃত আলিম্পন-শব্দজাত বলেও মনে করা হয়। এর সঙ্গে আইল প্রস্তুত করার সম্পর্কের কথাও বলেন অনেকে। প্রাচীন কৃষি সভ্যতার সঙ্গে একটা সম্পর্কের সূত্র উঠে আসে এ থেকে। ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলে আলপনার প্রচলন আছে। যেমন বিহার বা উত্তরপ্রদেশে বলে ‘আরিপন’, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে ‘ওসা’ বা ‘ঝঙ্গতি’, তামিলনাড়ু ও কেরলে ‘কোলম’ ইত্যাদি। উৎসব ও মঙ্গলকার্যে ব্যবহৃত এই শিল্পরূপটি প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে আজকের জায়গায় এসে পৌঁছেছে। শুরুতে জাদু-প্রক্রিয়ার থেকে উদ্ভূত হয়েছিল এই রূপ। এখনও ‘জাদু’-র সঙ্গে সেই সম্পর্ক লুপ্ত হয়নি। লক্ষ্মীপূজোয় বা বিভিন্ন ব্রতে যে আলপনা দেওয়া হয়, তাতে বৈভবের দেবীকে আবাহন ও পারিবারিক মঙ্গল কামনার অনুষঙ্গ থাকেই। আলপনা মূলত অলঙ্করণ শিল্প। সব সময় তা বিমূর্ত নয়। লৌকিক আলপনায় কিছু আখ্যানের আভাসও থাকে। যেমন সাঁঝপূজানী ব্রতের আলপনা, সুবচনীর ব্রতে পাখিদের উড়ে আসা, ‘হাতে পো কাঁখে পো’ আলপনায় গাছের ডালে ঝুলে থাকা মানব শিশুর প্রতিমাকল্প।

অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বাংলার ব্রত’ পুস্তিকায় লিখেছিলেন ‘খাঁটি মেয়েলি ব্রতগুলিতে, তার ছড়ায় এবং আলপনায় একটি জাতির মনের, তাদের চিন্তার, তাদের চেষ্টার ছাপ পাই’। আলপনা ধীরে ধীরে লৌকিক স্তর থেকে ধ্রুপদী স্তরে রূপান্তরিত হয়েছে। অজন্তার ছবির অলঙ্করণে, রাজস্থানি বা পাহাড়ি অনুচিত্রে এর অনেক নিদর্শন পাওয়া যায়।

Advertisement

বাংলার লৌকিক ও ভারতীয় ধ্রুপদী আলপনা-আঙ্গিকের সমন্বয়ে শান্তিনিকেতনে গড়ে উঠেছিল আলপনার স্বতন্ত্র এক ধারা। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছায় ও আগ্রহে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এবং অঙ্গনসজ্জাতেই আলপনার বহুল প্রচলন ছিল সেখানে। সামগ্রিক সৌন্দর্যচেতনার সঙ্গেই যুক্ত ছিল তা। ১৯১৯ সালে কলাভবন প্রতিষ্ঠিত হল। নন্দলাল বসু হলেন সংগঠক ও শিক্ষক। তাঁর উদ্যোগ ও শিক্ষণ আলপনাকে ক্রমশ পরিশীলিত করেছে। সমগ্র প্রাচ্য ঐতিহ্য সমন্বিত হয়েছে এর মধ্যে। ১৯২৪ সালে পূর্ববাংলা থেকে বাল্যবিধবা সুকুমারী দেবী যোগ দেন শান্তিনিকেতনে। আলপনা শিক্ষায় তাঁর রয়েছে প্রভূত অবদান। ক্ষিতিমোহন সেনের পত্নী কিরণ বালাও যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন আলপনার প্রকল্পে। বর্ষামঙ্গল, জলকর্ষণ, বৃক্ষরোপণ, বসন্তোৎসব ইত্যাদি অনুষ্ঠানে আলপনা ছিল সৌন্দর্য ও মঙ্গল অনুষঙ্গের অনিবার্য অঙ্গ। শান্তিনিকেতনের আলপনা ও আলপনা শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে নন্দলাল কন্যা গৌরীদেবী ও যমুনাদেবীর। তাঁদের উদ্যোগে শান্তিনিকেতনের আলপনা একটি স্বতন্ত্র ঘরানায় উন্নীত হয়। প্রকৃতির অনুষঙ্গ তার মধ্যে রয়েছে। মণ্ডনশিল্প হয়েও আলপনা হয়ে উঠেছে বিশুদ্ধ ললিতকলার দৃষ্টান্ত।

শান্তিনিকেতনের এখনকার শিল্পীরা কেমন করে প্রসারিত করছেন আলপনা-শিল্পের দিগন্তটিকে, সে বিষয়ে একটি প্রদর্শনী হল হুগলির ভদ্রকালীতে অবস্থিত ‘জীবনস্মৃতি’ গ্যালারিতে। এটি শুধুমাত্র একটি গ্যালারি নয়, বাংলার সংস্কৃতির বিস্মৃত পরিসরের একটি ‘আর্কাইভ’ও। সেখানে অনুষ্ঠিত হল শান্তিনিককেতনের শিল্পী সুধীররঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের আঁকা আলপনার প্রদর্শনী। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ‘বাংলার আলপনা’ বিষয়ে বললেন সুশোভন অধিকারী। রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানের আবহে সুধীররঞ্জন আঁকলেন একটি আলপনা।

সুধীররঞ্জনের আলপনায় শান্তিনিকেতনের পরিণত পর্বের ঐতিহ্যের প্রতিফলন আছে। বিশেষত গৌরী ভঞ্জের যে অলঙ্করণ রীতি তার অনুসরণ নয়, তবে ঘরানার কিছু সমান্তরলতা অনুভব করা যায়। ঘূর্ণায়মান বক্ররেখার প্রাধান্যে গড়ে উঠেছে তাঁর অনেক রচনা। বৃত্তীয় গতির সঙ্গে শাঙ্খিল গতিকে মিলিয়েছেন। রেখার ঘেরের মধ্যবর্তী পরিসর রং দিয়ে ভরাট করেছেন। প্রকৃতির কোনও অনুষঙ্গ হয়তো আছে। লতার প্রবহমানতা— এ সমস্ত প্রাকৃতিক ছন্দকে রেখেই স্বতন্ত্র এক প্রকৃতি সৃজন করতে চেয়েছেন শিল্পী, বিশুদ্ধ শিল্পের সব সময়ই যা লক্ষ্য। এই আলপনা বাংলার লৌকিক আলপনা থেকে অনেক পরিশীলিত ও ধ্রুপদী বোধে সঞ্জীবিত। শান্তিনিকেতনের আলপনা আর নিছক অলঙ্করণ নয়, একটি বিশুদ্ধ শিল্পপদ্ধতি।

আরও পড়ুন
Advertisement