পুস্তক পরিচয় ১

থিম পুজোর জন্য প্রয়োজন অন্য মাপকাঠি

গত বছর দেশপ্রিয় পার্কের পুজোর টিজার বিজ্ঞাপনে শহরের মুখ ঢেকে গিয়েছিল। অভূতপূর্ব জনজোয়ারে শেষ পর্যন্ত সেখানে দর্শকের প্রবেশ বন্ধ করে দিতে হয় প্রশাসনকে।

Advertisement
ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
শিল্পী: শানু লাহিড়ী। বকুলবাগান, ১৯৮২

শিল্পী: শানু লাহিড়ী। বকুলবাগান, ১৯৮২

গত বছর দেশপ্রিয় পার্কের পুজোর টিজার বিজ্ঞাপনে শহরের মুখ ঢেকে গিয়েছিল। অভূতপূর্ব জনজোয়ারে শেষ পর্যন্ত সেখানে দর্শকের প্রবেশ বন্ধ করে দিতে হয় প্রশাসনকে। কলকাতার দুর্গাপুজো নিয়ে শিল্প-ইতিহাসবিদ তপতী গুহঠাকুরতার ইন দ্য নেম অব দ্য গডেস বইটি এ ঘটনার আগেই প্রকাশিত, তাঁর আলোচ্য পর্বও ২০০২-২০১২, সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই এই ঘটনা জায়গা পায়নি। কিন্তু বইটির বিপুল তথ্য ও গভীর বিশ্লেষণী আলোচনায় তপতীর ইঙ্গিত নির্ভুল প্রমাণিত হয়েছে দেশপ্রিয় পার্কের ঘটনায়— দর্শক এবং স্পন্সর তথা পুরস্কার টানার অত্যুগ্র বাসনা থিমের পুজোকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা এ থেকেই স্পষ্ট।

থিম পুজোর পরিণতি অবশ্য এই বইয়ের মূল আলোচ্য নয়। থিম পুজোয় ‘শিল্প’ এবং তার ‘শিল্পী’দের নিয়েই তপতীর ভাবনা, আর সেটা তিনি বুঝতে চেয়েছেন আগেপিছে অনেক কিছু খুঁটিয়ে দেখে। কলকাতা তথা বাংলায় দুর্গাপুজোর ইতিহাস নিয়ে উনিশ শতক থেকেই নানা রকম প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও বই লেখা হয়েছে, সাম্প্রতিক পর্বের ভাষ্য হিসাবে অঞ্জন মিত্র এবং অনিতা অগ্নিহোত্রীর বই দুটি ব্যবহারও করেছেন তিনি। বিশ শতকে কলকাতার পুজোর দিকবদলের কথা বলতে গিয়ে বার বারই এসেছে বারোয়ারি থেকে সর্বজনীনের কথা। সর্বজনীনের নানা মোড়েই থেকে গিয়েছে পুজোর ভাবনা, প্রতিমার রূপকল্প, শিল্পীদের পর্বান্তর, পুজোর বাণিজ্যিকীকরণ, প্যােন্ডলের চরিত্রবদল থেকে শেষে থিমপুজোর বিস্ফোরণ। একুশ শতকের শুরুর দশকে ক্ষেত্রসমীক্ষায় তপতী দেখাতে চেয়েছেন কলকাতার দুর্গাপুজোর চরিত্র কেমন দ্রুত বদলাচ্ছে। নির্মাণপ্রক্রিয়া বদলাচ্ছে, প্রচার ও অর্থানুকূল্যের দিকে নজর পড়ছে অনেক বেশি, অনেক বেশি মানুষ ভিড় করছেন পুজো দেখতে। অর্থাৎ দৃশ্য-সংস্কৃতির চেহারাটাই পাল্টে যাচ্ছে। নতুন শিল্পীগোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠছেন। বৈচিত্রের খোঁজে হন্যে হয়ে ছুটছেন পুজোর সংগঠক, পরিকল্পনাকারী, শিল্পী, আর শেষমেষ দর্শক। সর্বজনীনে ধর্মীয় অনুষঙ্গের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে, দীর্ঘকাল ধরেই সবাই ‘ঠাকুর দেখে’। অন্য দিকে, এর স্থায়িত্ব মাত্র চার দিন। যত জনপ্রিয়, যত বিশিষ্ট শিল্পকর্মই হোক না কেন, সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা নেই। তারই মধ্যে সৃষ্টির অক্লান্ত প্রয়াস, ‘পাবলিক আর্ট’-এর বৃহত্তম প্রদর্শনী। তা হলে কতটা এর শিল্প, কতটা কারিগরি?

Advertisement

ইন দ্য নেম অব দ্য গডেস/ দ্য দুর্গা পুজাস অব কন্টেম্পোরারি কলকাতা।

তপতী গুহঠাকুরতা। প্রাইমাস, ৫৫০০.০০

আটটি অধ্যায়ে ব্যাপ্ত আলোচনায় তপতী প্রশ্ন তুলেছেন, আলোচ্য পর্বে দেবী দুর্গা কী ভাবে একাধারে ভক্তের আরাধ্য প্রতিমা, বিজ্ঞাপনের পয়লা নম্বর ‘ব্র্যান্ড ইমেজ’, আবার দৃষ্টিভোগ্য/ সংগ্রহযোগ্য শিল্পকর্ম হয়ে উঠলেন? তাঁর মতে, শিল্প হয়ে ওঠার জন্য এক দিকে ধর্মানুষ্ঠানের কাঠামো, অন্য দিকে উৎসবের গণ-চরিত্রের মধ্যে নিরন্তর টানাপড়েন চলছে। এতটাই অস্থায়ী, এতটাই ‘পাবলিক’, সেখানে শিল্পের স্বকীয়তা এবং স্রষ্টার স্বাক্ষরের অস্তিত্ব কোথায়, কী ভাবে থাকবে? এই নাগরিক উৎসব এক অন্য নন্দনতত্ত্বের দাবি করে, যাকে বুঝতে হলে চাই ব্যাখ্যার নিজস্ব মাপকাঠি।

নানা দিক থেকে সর্বজনীন পুজোকে বিশ্লেষণ করতে করতে থিম পুজোর দিকে এগিয়েছেন তপতী, দেখিয়েছেন কী ভাবে তা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। চার দিনের উৎসব হয়ে উঠল সাম্বৎসরিক, এক বছরের ঢাকের বাদ্যি থামতে না থামতেই সংগঠক, শিল্পী, কি বিজ্ঞাপনদাতারা মাঠে নেমে পড়ছেন। বাটা-র ‘পুজোয় চাই নতুন জুতো’ কি ‘বঙ্গজীবনের অঙ্গ বোরোলীন’-এর যুগ পেরিয়ে কর্পোরেট বিজ্ঞাপনের সর্বগ্রাসী চেহারা, পুরনো শহর ছাড়িয়ে একদা শহরতলিতে আজ পুজোর রমরমা, আর এখন তো পুজো উদ্বোধনের মহিমায় অনেক আগে থেকে শুরু হয়ে যাচ্ছে ঠাকুর দেখা। পরিবর্তনকে নির্দিষ্ট সালতারিখে বাঁধা কঠিন হলেও এটুকু স্পষ্ট, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় ১৯২০-’৪০-এর দশকে সর্বজনীন পুজো যে মাত্রা পেয়েছিল, ষাট-সত্তর দশকের বড় বাজেটের পুজোর চূড়ান্ত আড়ম্বরে তা হারিয়ে যায়। কেউ কেউ এর সমালোচনায় মুখর হন, আবার অধিকাংশই ঠাকুর দেখার ভিড়ে আরও বেশি করে গা ভাসাতে থাকেন। পাড়ার মধ্যে চাঁদা তুলে সবার সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত ছোট বাজেটের পুজো থেকে থিম পুজোয় পৌঁছনর অন্যতম বড় কারণ যে এই দর্শকদের চাপ, তাতে সন্দেহ নেই।

বিশ শতকের পুজোতেই থিম পুজোর লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। বাংলার চিরপরিচিত একচালা কাঠামো ভেঙে চল্লিশের দশকে নিতাই পাল, গোপেশ্বর পালরা ‘আর্টের ঠাকুর’ গড়তে লাগলেন। গোপেশ্বর পশ্চিমী অ্যাকাডেমিক রীতির প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন, আবার কৃষ্ণনাগরিক পরম্পরাতেও ঋদ্ধ ছিলেন তিনি। আর্টের ঠাকুর গড়ায় বিপ্লব আনলেন আর্ট কলেজের ছাত্র রমেশ পাল। পঞ্চাশ থেকে নব্বই দশক তাঁর তৈরি করা প্রতিমা কলকাতার সেরা দ্রষ্টব্য ছিল। অথচ তাঁর শিল্পীসত্তায় অনেক বেশি গুরুত্ব পেত দেশনেতা বা মনীষীদের মূর্তি তৈরি। তিনি নিজেকে ‘ভাস্কর’ বলেই চিহ্নিত করেছেন, কিন্তু মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে কলকাতার অন্যতম সেরা প্রতিমাশিল্পী হিসাবে। এরই মধ্যে বকুলবাগান প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের দিয়ে প্রতিমা নির্মাণ শুরু করে ১৯৭৫ থেকে, যদিও শিল্পীদের নিজেদের মধ্যেই এ নিয়ে দ্বিধা ছিল। আবার পারম্পরিক শিল্পধারায় দক্ষ নিমাইচন্দ্র পালের মতো শিল্পী বিদেশে গিয়ে সংগ্রহশালার জন্য মূর্তি তৈরি করেছেন। পূর্ববঙ্গ থেকে এসে রাখাল পাল, তাঁর ভাই মোহনবাঁশি রুদ্র পাল, মোহনবাঁশির ছেলে সনাতন ও প্রদীপ নতুন ধরনের মূর্তি গড়ে বিপুল প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। নতুন কিছু গড়া হলেই কেন ‘আর্টের ঠাকুর’ বলা হবে, এ প্রশ্ন উঠেছিল সংবাদমাধ্যমে। তা হলে আগে যা ছিল, তা কি ‘আর্ট’ নয়? আদতে এই প্রশ্ন তো মৃৎশিল্পীদের ‘শিল্পী’ হিসাবে স্বীকৃতির প্রশ্ন। পাশাপাশি সঙ্ঘশ্রী-র পুজোয় চলচ্চিত্রের সেট পরিকল্পনা, আলো ও শব্দের খেলা দর্শক টানতে দারুণ ভূমিকা নিয়েছিল, যা অনেকেই অনুসরণ করে। প্যােন্ডল নির্মাতারা পৃথিবীর যে কোনও স্থাপত্য বা টাইটানিক, গাইসাল ট্রেন দুর্ঘটনা পর্যন্ত নকল করতে থাকে। দুর্গাপুজো বা প্রতিমার সঙ্গে তা নিতান্ত সম্পর্কহীন, সবটাই জনমোহিনী পরিকল্পনা।

এই পরিস্থিতিকে অত্যন্ত দক্ষ ভাবে কাজে লাগিয়েই উঠে এলেন থিম পুজোর শিল্পীরা। অমর সরকার, দীপক ঘোষ, বন্ধন রাহা থেকে সুবোধ রায়, সনাতন দিন্দা, ভবতোষ সুতার, সুশান্ত পাল থেকে গৌরাঙ্গ কুইলা, আরও অনেকে। কেউ আর্ট কলেজের, কেউ স্বশিক্ষিত। দেশের লোকশিল্প ও লোকশিল্পী সমাজকে সরাসরি কাজে লাগানর প্রয়াস যেমন এঁদের মধ্যে আছে, তেমনই গুরুত্ব পেয়েছে প্রাচীন স্থাপত্য-ভাস্কর্য। শুধু স্থাপত্যের অনুকরণ নয়, পরিবেশ সৃষ্টি করার দিকে এঁদের নজর বেশি। প্রাথমিক ভাবনা যদি বা একক ভাবে হয়ে থাকে, কাজ তো সম্পূর্ণ হয় সম্মিলিত ভাবেই। অনেক জায়গায় থিম-শিল্পীর ভূমিকা ইভেন্ট-ম্যানেজারের। কী ভাবে স্পন্সর পাওয়া যাবে, পুরস্কার পেতে হলে কেমন থিম বেশি কার্যকর, এ সব ভাবনাও ভাবতে হয়। সব কিছুর পর বিসর্জনে সব শেষ, সৃজনের কোনও চিহ্নই রইল না। একে কেমন শিল্প বলা যাবে, শিল্পী হিসাবেই বা কে স্বীকৃতি পাবেন? আবার কোটি মানুষ দেবতার নামে যে প্রদর্শনী চার দিন উপভোগ করেন, সেই গণশিল্পের নান্দনিকতা অগ্রাহ্য করাই বা সম্ভব কী ভাবে?

স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রশ্নের সরাসরি কোনও উত্তর হয় না, এই প্রশ্ন আমাদের তলিয়ে ভাবতে উৎসুক করে। ভাবার সব উপকরণই এই বইয়ে মজুত। ভাবতে গিয়ে যখন মনে হয়, সত্যি, এ ক্ষেত্রে ‘শিল্প’কে ধরাবাঁধা সংজ্ঞার বাইরে বার করেই দেখা দরকার, তখন দেখি দেড় দশকেই থিম পুজোর দম ফুরিয়েছে, এখন সময় চূড়ান্ত অতিরেকের। লেখকের সঙ্গে আমরাও আশ্রয় নিই নস্টালজিয়ায়।

আরও পড়ুন
Advertisement