পুস্তক পরিচয় ১

বিপন্ন পরিবেশ আজ মারমুখী

পরিবেশ-গবেষক প্রদীপ দত্তের লেখা পৃথিবী বিপন্ন পড়তে পড়তে হল্যান্ডের সাম্প্রতিক ঘটনা মনে এল। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ যে কী দ্রুত হারে নষ্ট হচ্ছে, এবং তার পরিণাম যে ইতিমধ্যে কী হারে প্রকট হচ্ছে, সে-সব বিস্তারে জানিয়েছেন প্রদীপ।

Advertisement
পথিক গুহ
শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৫ ০০:০১

পরিবেশ বাঁচানোর লক্ষ্যে এক অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে হল্যান্ডের সংগঠন আর্জেন্ডা। দূষণের বিপদের মূলে পরিবেশের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি। কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন ইত্যাদির উৎপাদন আধুনিক উন্নত জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। বায়ুমণ্ডলে ও-সব গ্যাসের পরিমাণ যে-সব উৎসের কারণে বাড়ে, তার মধ্যে অগ্রগণ্য হল কলকারখানা কিংবা যানবাহন। ও-সব থেকে ক্ষতিকর গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জরুরি। কে নেবে ব্যবস্থা? রাষ্ট্র। বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে প্রায় কোনও দেশের সরকারই তৎপর নয়। হল্যান্ড সরকারও তার ব্যতিক্রম নয়। আন্দোলন কিংবা চেঁচামেচিতে তার প্রতিক্রিয়াও অন্য দেশের প্রশাসনের মতোই। এ হেন পরিস্থিতিতে কী ভাবে সরকারকে বাধ্য করা যায় গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ চালু করতে? ৯০০ হল্যান্ডবাসীর (যাদের মধ্যে অনেক শিশুও রয়েছে) তরফে আর্জেন্ডা আদালতের দ্বারস্থ। মামলা দেশের সরকারের বিরুদ্ধে। আর্জেন্ডার অভিযোগ, গ্রিনহাউস গ্যাসের উৎপাদন কমাতে প্রশাসনের তৎপরতা কম। সরকার জেনেশুনে দেশবাসীকে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিচ্ছে। আর্জেন্ডার দাবি, আদালত ঘোষণা করুক, ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি উষ্ণায়ন হলে বিশ্ব জুড়ে মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব হবে। হল্যান্ড সরকার যদি গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে কঠোর না হয়, তা হলে মানুষের অধিকার খর্বের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবে।

Advertisement

আদালতে শুনানির সময় হল্যান্ড সরকারের তরফে বলা হল, ২০২০ সালের মধ্যে দেশে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ ১৯৯০ সালের তুলনায় ১৪-১৭ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা আছে। সরকারের এই হলফনামা উড়িয়ে দিয়ে আদালত তা বেআইনি ঘোষণা করল। আর নির্দেশ দিল, ১৪-১৭ শতাংশ নয়, ২০২০ সালের মধ্যে এই পরিমাণ কমাতে হবে ২৫ শতাংশ। বিচারের আঙিনায় জয় হল পরিবেশ আন্দোলনের। পরিবেশ কাজিয়াকে আদালত চত্বরে নিয়ে যাওয়া যেমন অভিনব, তেমনই চমকপ্রদ ওই উদ্যোগের সাফল্য। গত ২৪ জুন দ্য হেগ শহরে কোর্টের রায় পরিবেশবাদীদের খুশির কারণ।

পরিবেশ-গবেষক প্রদীপ দত্তের লেখা পৃথিবী বিপন্ন পড়তে পড়তে হল্যান্ডের সাম্প্রতিক ঘটনা মনে এল। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ যে কী দ্রুত হারে নষ্ট হচ্ছে, এবং তার পরিণাম যে ইতিমধ্যে কী হারে প্রকট হচ্ছে, সে-সব বিস্তারে জানিয়েছেন প্রদীপ। আর শুধু এ-সব নয়, পরিবেশ নষ্টের ব্যাপারে মানুষের চেতনার ইতিহাস যে খুব মসৃণ নয়, অবিশ্বাস কিংবা বিতর্কের বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যে উষ্ণায়নজনিত বিপদের সত্যতা অনেকটা (হ্যাঁ, সংশয়ীদের বিরুদ্ধ প্রচার এখনও অব্যাহত) স্বীকৃত হয়েছে, তাও আলোচনায় এসেছে।

আর এসেছে রাজনীতি, যা অতীব প্রভাবশালী এক শক্তি। যে কোনও সমস্যা সমাধানের বদলে তাকে জটিল করায় যা সিদ্ধহস্ত। প্রদীপ লিখেছেন, ‘গত পঞ্চাশ বছরে জলবায়ু বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে [মার্কিন] যুক্তরাষ্ট্রের অবদানই সবচেয়ে বেশি। ...মার্কিন গবেষকরা [গ্রিনহাউস গ্যাস] নিঃসরণের প্রমাণের কথা পৃথিবীকে জানিয়েছেন। অথচ আমেরিকাতেই উষ্ণায়ন নিয়ে সন্দেহ ছড়ানো এবং চক্রান্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি।’ চক্রান্ত বা অপকীর্তির পুরোভাগে ছিলেন আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। আবহাওয়ার বিপদাশংকা প্রতিষ্ঠিত সত্য নয়— এই জিগির তুলে যিনি ২০০১ সালে কিয়োটো সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন। অজুহাত? তা ছিল। গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমালে আমেরিকার অর্থনৈতিক বৃদ্ধি মন্থর হবে। অর্থাৎ, কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হবে। আশার কথা, আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর পূর্বসূরির মতো কট্টরপন্থী নন। পরিবেশ বাঁচাতে তাঁর দেশের কর্তব্য সম্পর্কে তিনি অন্তত ততটা উদাসীন নন।

১৯৯২ সালে রিও ডি জেনেইরো শহরে বসুন্ধরা সম্মেলনে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও যোগ দিয়েছিলেন বুশ। তবে ওখানে যাওয়ার আগে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি আমেরিকানদের লাইফস্টাইল কিছুতেই পাল্টে দেবেন না। লাইফস্টাইল। সে এক বড় দায়। পৃথিবী বিপন্ন-র ভূমিকায় ধিক্কৃত হয়েছে ‘অকথ্য ভোগবাদ’। অর্থ আছে বলেই যত খুশি জিনিস কেনার, বিদ্যুৎ-পেট্রোল-ডিজেল বেহিসেবি খরচ করার, কাগজ, মোড়ক, প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম যথেচ্ছ ব্যবহার ও অপচয় করার পরিণামে প্রকৃতির ওপর নিপীড়নের হিসেব কষা হয় না। এ প্রসঙ্গে লেখক টেনেছেন ‘এক্সটারনাল কস্ট’-এর প্রসঙ্গ, কিংবা কার্বন নিঃসরণের জন্য কর ধার্যের দাবি। পরিবেশের ক্ষতি হিসেবে আনলে প্লাস্টিকের ব্যাগ বা অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের উৎপাদন মূল্য হবে বাজারে ও-সবের দামের বহু গুণ বেশি। এ ব্যাপারে লেখক যা উল্লেখ করেননি, তা ওই লুকোনো খরচের চেয়ে কোনও অংশে কম ক্ষতিকর নয়। আধুনিক জীবনযাত্রার সেই অলাভজনক দিকটি এখন পরিবেশ আন্দোলনে রীতিমতো আলোচ্য। উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় প্রকাশ, এক কিলোগ্রাম ইনস্ট্যান্ট কফি প্রস্তুতে ১৮,৯৪৮ কিলোক্যালরি এনার্জি খরচ হয়। ওই কফি যে পাত্রে বিক্রি হয়, তা বানাতে আরও ২,২১৩ কিলোক্যালরি এনার্জি লাগে। অথচ ওই কফি সেবনে (৬ আউন্সের ৫২৯ কাপ) যে শক্তি পাওয়া যায়, তা মাত্র ২,৬৪৫ কিলোক্যালরি।

নাইন-ইলেভেন-এর পর যে বিশাল উদ্যোগ, তৎপরতা ও আর্থিক ব্যয়ে গোটা পৃথিবী সন্ত্রাসবাদ দমনে নেমে পড়েছিল, সে দিকে তাকিয়ে পৃথিবী বিপন্ন-র লেখকের খেদ: ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়ের হাত থেকে এই গ্রহকে রক্ষা করতে যদি গোটা পৃথিবী দীর্ঘকাল ধরে একই রকম উদ্যোগ, তৎপরতা ও আর্থিক দায় গ্রহণ করে, তা হলেই হয়তো পৃথিবী বাঁচবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত পৃথিবীময় তেমন কোনও তৎপরতা যে দেখা যাচ্ছে না, তা কেবল দুশ্চিন্তারই নয়, রীতিমত ভয়ের কারণ।’ খেদ যথার্থ। বিপন্ন পরিবেশ যে মারমুখী, তা পৃথিবীর নানা জায়গায় ঝড়-ঝঞ্ঝা-বন্যায় বেশ মালুম হচ্ছে। সে তো সবচেয়ে বড় টেররিস্ট।

আরও পড়ুন
Advertisement