পুস্তক পরিচয় ১

পুরনো ছাঁচ ভেঙে নতুন সৃষ্টির পথ

আলোচ্য গ্রন্থটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ছয়শো পঞ্চাশ, লেখক সংখ্যা আটত্রিশ। নানা বিচিত্র পথগামী এই গ্রন্থের সার্বিক মূল্যায়ন এই পরিসরে অসাধ্য। এই বইটিতে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আলোকপাত যতটা হয়েছে, সমান বা ততোধিক আলোকপাত ঘটেছে রবীন্দ্রচর্চার বর্তমান অবস্থিতির উপরে।

Advertisement
সব্যসাচী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৫ ০০:০১

টুওয়ার্ডস টেগোর।
সম্পাদনা: সংযুক্তা দাশগুপ্ত, রামকুমার মুখোপাধ্যায়, স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়।
বিশ্বভারতী, ১৫০০.০০

আলোচ্য গ্রন্থটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ছয়শো পঞ্চাশ, লেখক সংখ্যা আটত্রিশ। নানা বিচিত্র পথগামী এই গ্রন্থের সার্বিক মূল্যায়ন এই পরিসরে অসাধ্য। এই বইটিতে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আলোকপাত যতটা হয়েছে, সমান বা ততোধিক আলোকপাত ঘটেছে রবীন্দ্রচর্চার বর্তমান অবস্থিতির উপরে।
সম্পাদকরা জানিয়েছেন যে, তাঁরা সম্পাদনাকর্ম যথাসম্ভব হালকা হাতে করেছেন, এতে লেখকের আপন বিচার ও কথনের স্বাতন্ত্র্য বজায় থেকেছে। সেটা নিশ্চয় কাম্য। কিন্তু অন্তত বিষয় অনুসারে প্রবন্ধগুলিকে বিভক্ত করলে পাঠকের সুবিধা হত। মূল বিষয়গুলি হল: রবীন্দ্ররচনার গড়ন এবং পাঠ-ব্যাখ্যানজনিত বিশ্লেষণ, রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক চিন্তা, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবনা, অনুবাদ এবং অন্যান্য পথে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিশ্বের নানা ভাষা নানা সংস্কৃতির পরিচয়, সাহিত্যকর্মের বাইরে রবীন্দ্রকৃতি। কয়েক জন প্রবন্ধকার বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, যথা, কে জি সুব্রহ্মণ্যম, সুকান্ত চৌধুরী, উইলিয়াম রাদিচে। কয়েকজনের অনুপস্থিতিও চোখে পড়ে, যথা শঙ্খ ঘোষ, সোমেন বন্দ্যোপাধ্যায় বা আশিস নন্দী। রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে একটাও লেখা চোখে পড়ল না। আর, এখানে নানা দেশে কবির ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এবং রবীন্দ্রচর্চার বিষয়ে প্রবন্ধ রয়েছে, বাংলাদেশ বা তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তার মধ্যে নেই। কিন্তু বইতে কী নেই তা নিয়ে বাক্যব্যয় না করে দেখা যাক কী পেলাম।

Advertisement

প্রায় চল্লিশ জন বিদ্বান কী কী বিষয়ে লিখেছেন জানাতে গেলেও একটা নামাবলি হয়ে উঠবে। স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকৃতি সম্বন্ধে লেখার প্রাচুর্য রয়েছে। লেখকরা সুকান্ত চৌধুরী, কেতকী কুশারী ডাইসন, উদয়নারায়ণ সিংহ, বিশ্বজিৎ রায়, ফকরুল আলম, রাধা চক্রবর্তী, নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। সুকান্ত চৌধুরী অনেক নূতন ভাবনা পেশ করেছেন সদ্য-সমাপ্ত ‘বিচিত্রা’ প্রকল্প পর্যালোচনা করে। অন্যরা নানা প্রশ্ন তুলেছেন, সাধারণত পাঠ-ব্যাখ্যানের পথে। রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত ‘লেখন’ গ্রন্থে কবির স্বহস্তে সংশোধন রয়েছে, অদ্যাবধি অপ্রকাশিত এই পরিমার্জনা কী জানায় আমাদের? রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতিমূলক লেখা নানা রচনায় প্রকীর্ণ, পাঠের বিভিন্নতাও দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের স্বকৃত সংশোধন ও সংক্ষেপকরণের ফলে, শিশিরকুমার দাস এই নিয়ে যে আলোচনা করেছেন, তদতিরিক্ত কী বলছে আজকের গবেষণা? (এই বিষয়ে দুটি প্রবন্ধের একটিতে পাদটীকা অংশ নানা ছাপার ভুলে ভরা)। ভাষাতাত্ত্বিক প্রশ্ন তুলেছেন ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে ‘সংকট’ এবং ‘সভ্যতা’ এই দুই শব্দের কী ব্যুৎপত্তি? ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’র সৃষ্টি এবং পশ্চিমী সাহিত্যসেবী মহলে বইটির অসাধারণ প্রতিষ্ঠালাভ কোন ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল? আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে রবীন্দ্রনাথ কী ভাবে সম্পৃক্ত, এ বিষয়ে এক জন রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞের কী অনুভব, ইত্যাকার নানা দিক থেকে সাহিত্যের আলোচনা নানা প্রবন্ধে।

যদিও রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন তাঁর সমস্ত রচনাতেই প্রতিভাসিত, বিশেষত তাঁর দার্শনিক চিন্তা নিয়ে লিখেছেন উইলিয়াম রাদিচে, শৈলেশ পারেখ, মার্টিন কেম্পশেন, অমিয় সেন, শেফালী মৈত্র, উমা দাশগুপ্ত এবং রজতকান্ত রায়। আলোচিত হয়েছে যুক্তিবাদ এবং রবীন্দ্রকাব্য, ‘প্রথমদিনের সূর্য’ কবিতায় কবির ঔপনিষদিক চেতনা, রবীন্দ্রদর্শনে ত্যাগ এবং আনন্দ, আধুনিক বঙ্গদেশে ধর্মীয় চেতনার ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ, বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের উক্তি সংকলন, ইত্যাদি।

বর্তমান গ্রন্থে রাজনীতি ও সমাজ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার বিবরণ এবং দু-এক ক্ষেত্রে বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। লেখকদের মধ্যে আছেন দীক্ষিত সিংহ, ভারতী রায়, দেবারতি বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপঙ্কর রায়, বাসবী ফ্রেজার এবং স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়। নারীমুক্তি সম্বন্ধে নূতন চিন্তার প্রতিফলন কয়েকটি প্রবন্ধে। ‘বিষবৃক্ষ’ ও ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের তুলনাটি চিত্তাকর্ষক। দ্বিতীয়ত, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের যে স্থান পূর্বে অনেকে নির্ধারণ করেছিলেন, সে সম্বন্ধে নূতন নানা প্রশ্ন দেখা যায়। তৃতীয়ত, সমবায়ের পথে গ্রামীণ সমস্যা মোচন, শ্রীনিকেতন কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য এবং ফলাফল ইত্যাদি বিষয়ক লেখাগুলি নূতন তথ্যে সমৃদ্ধ। আজকের পরিবেশ-আলোচনায় রবীন্দ্রচিন্তার পুনর্বিবেচনা পাওয়া যায়। একটি আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, যখন মহাত্মা গাঁধী বা রবীন্দ্রনাথ প্রাযুক্তিক প্রগতি এবং প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার করেছিলেন, যখন তাঁরা সর্বব্যাপী রাষ্ট্রের পরিবর্তে ক্ষুদ্রতম সমবায়ে আস্থা দেখিয়েছিলেন, যখন তাঁরা এশীয় দেশগুলির দ্বারা আগ্রাসী ইউরোপের জাতীয়তাবাদের অনুকরণে অনাস্থা প্রকাশ করেছিলেন, তখন বর্তমানের পরিবেশবিজ্ঞান জন্ম নেয়নি, তাঁদের বক্তব্য তৎকালে মান্য অর্থনীতিকরা শুনতে নারাজ ছিলেন। বর্তমানে তাঁদের বাণীর সমাদর মানে এই নয় যে, গাঁধী বা রবীন্দ্রনাথ ঋষি জাতীয় কিছু ছিলেন। তাঁরা তাঁদের চিন্তা ও অনুভবে যা বোধ করেছিলেন, তার অনেকটাই আজ অভিজ্ঞতা ও নূতন জ্ঞানের আলোতে নূতন অর্থে সমৃদ্ধ হয়ে উপস্থিত।

রবীন্দ্রনাথকে অনেক সময়ে বিশ্বকবি বলা হয়, এটা একটা শোনা কথার অন্যমনস্ক পুনরাবৃত্তি। এক দিকে কী অর্থে বিশ্বচেতনা রবীন্দ্রকৃতিতে দেখা যায়, এবং অপর দিকে কী ভাবে তিনি নানা ভাষা ও সংস্কৃতির মানবগোষ্ঠীর মধ্যে পরিচিত হলেন, এই বিষয়ে ফ্রাঁস ভট্টাচার্য, ইমরে বাংগা, মালবিকা ভট্টাচার্য, বন্দনা পুরকায়স্থ, ভিকটরস ইভবুলিস, ফকরুল আলম দেখিয়েছেন যথাক্রমে ফরাসি, হাঙ্গারীয়, স্পেনীয়, পূর্ব এশীয়, রুশ এবং ইংরেজি ভাষার সাহিত্য-সমাজে রবীন্দ্রনাথের স্থান। সুপ্রিয়া চৌধুরীর লেখাটি এই প্রবন্ধগুচ্ছের মুখবন্ধস্বরূপ। বিষয় ‘বিশ্ব সাহিত্য’, যে শিরোনামে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘বঙ্গদর্শনে’ (১৯০৭)। একেই তুলনামূলক সাহিত্য আলোচনার সূচনা বলা চলে।

রবীন্দ্রপ্রতিভার বহুমুখিনতার জন্য সাহিত্য ভিন্ন নানা ক্ষেত্রে তাঁর কৃতি এবং চিন্তনের পরিমাপ সহজ নয়। কবির বিজ্ঞানচিন্তা নিয়ে লিখেছেন পদার্থবিদ বিকাশ সিংহ, পার্থ ঘোষ, জীববিজ্ঞানী সমীর ভট্টাচার্য এবং রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ ক্যাথলিন ও’কনেল, যিনি জানিয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞান, উদ্ভিদ ও প্রাণিবিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান-দর্শন সম্বন্ধে ১৮৮৩-১৯৩৫ পর্যন্ত প্রকাশিত কী কী বই রবীন্দ্রনাথ সংগ্রহে রেখেছিলেন এবং ধরা যায় পড়েছিলেন। তাঁর ওপরে অলৌকিক জ্ঞান বা দিব্যদৃষ্টি আরোপ করা হয়নি, বিজ্ঞানী লেখকদের লেখা বৈজ্ঞানিক-জনোচিত। একই মেজাজে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের অনন্যতন্ত্রতা ও প্রভাব বিষয়ে লিখেছেন কে জি সুব্রহ্মণ্যম। তাঁর মত, রবীন্দ্রনাথ পুরনো ছাঁচ ভেঙে নূতন সৃষ্টির পথ দেখিয়েছিলেন, কিন্তু চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের ‘বিশ্লেষণ যেটুকু হয়েছে তা নিতান্ত দুর্বল’, এবং শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ‘ছায়ায় পড়ে আছেন’ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের তুলনায়।

নাট্যকার রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে চমৎকার দুটি প্রবন্ধ পাওয়া গেল: অভিজিৎ সেন ১৯০৩-’৩৯ পর্বে, এবং আনন্দ লাল ১৯৮৬-২০১০ সালের মধ্যে মঞ্চায়িত রবীন্দ্রনাট্যের বিবরণ দাখিল করেছেন। নাটক লেখা ততটা নয়, অভিনীত নাটক ও মঞ্চস্থাপত্য ও পরিকল্পনার মৌলিকতা বিষয়ে আলোচনা চিত্তাকর্ষক। স্থাপত্যবিদ সপ্তর্ষি সান্যাল শান্তিনিকেতনে বাসগৃহ-স্থাপত্যে রবীন্দ্রচিন্তার মৌলিকতা দেখিয়েছেন।

এই বইটির একটি অভাব রবীন্দ্রচর্চাপ্রবাহের সমীক্ষণ। এটির তিনটি পর্যায় চিহ্নিত করা চলে। প্রথম পর্যায়ে অজিতকুমার চক্রবর্তী, কাজী আবদুল ওদুদ, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, প্রমথনাথ বিশী। অপর দিকে, রবীন্দ্ররচনার পঞ্জিকরণ, গ্রন্থ পরিচিতি, প্রকাশনা ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় স্বতন্ত্র গ্রন্থাকারে যা প্রকাশ করেন, সেগুলি ছাড়াও বিশ্বভারতীর রবীন্দ্ররচনাবলিতে সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ পরিচিতি প্রকাশিত হতে শুরু করে চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য এবং তাঁর সহযোগীদের প্রচেষ্টায়। রবীন্দ্রোত্তর কালে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপকদের প্রাধান্য, নেপথ্যে পুলিনবিহারী সেন কানাই সামন্তরা স্মরণীয়। রবীন্দ্ররচনাবলির নূতন ধরনে পরিবেশনে উল্লেখযোগ্য শঙ্খ ঘোষ-কৃত গ্রন্থপরিচয়। বর্তমানে রবীন্দ্রচর্চা তৃতীয় এক বৃত্তে প্রবেশ করেছে, যেখানে দেখা যায় বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির প্রয়োগ, পাঠের বিভিন্নতা নির্ণয়, শব্দ প্রয়োগের অনুধাবন, রচনাবলির কনকরডেন্স ইত্যাদি বিষয়ে প্রচেষ্টা। বর্তমান সংকলনে কেবল দু-একটি প্রবন্ধে এই তৃতীয় পর্যায়ের গবেষণা চোখে পড়ে।

সুকান্ত চৌধুরী বলছেন যে, রবীন্দ্রকৃতিতে সৃষ্ট হয়েছে একটি ‘রচনা-সমূহের স্বরচিত বিশ্ব’ এবং প্রতিটি রচনা অন্য অনেক রচনার বা পাঠান্তরের আলোকে দেখা প্রয়োজন, কারণ বিভিন্ন রচনার মধ্যে নিয়ত পারস্পরিকতা ও প্রতিধ্বনি শোনা যায়, এবং রচনার অর্থ অনুধাবনের জন্য সেই অনুরণন কান পেতে শুনতে হবে। এ প্রস্তাব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কেননা মনে হয় যে, রবীন্দ্রসাহিত্যের চর্চা ক্রমে এখন গভীরতর পাঠ-ব্যাখ্যানের পথে যাবে।

রবীন্দ্রনাথকৃত সাহিত্য সমালোচনায় দেখা যায় যে, তার প্রশ্নমালা এবং আলোচনার পরিধি কত বিস্তারিত ছিল। সেই পথে রবীন্দ্রচর্চা রবীন্দ্র-উত্তর যুগে কতটা এগিয়েছে? নিয়ত চলমান চিন্তার স্রোত কী ভাবে রবীন্দ্রচর্চাকে সমৃদ্ধ করবে? ইত্যাকার প্রশ্ন যদি আজকের পাঠকদের মনে ওঠে, তবে এই প্রবন্ধ সংকলনের উদ্দেশ্য হয়তো পরিপূরিত হবে।

আরও পড়ুন
Advertisement