পুস্তক পরিচয় ১

Book review: It will be batter if Bengal was included

আলোচ্য গ্রন্থটি দক্ষিণ এশিয়ার শিয়া সম্প্রদায় সংক্রান্ত কিছু সেমিনার পেপারের সংকলন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়াল হলোওয়ে কলেজে ২০১১-য় এ বিষয়ে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

Advertisement
অমিত দে
শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৬ ০৪:০৪
দ্য শিয়া ইন মডার্ন সাউথ এশিয়া: রিলিজিয়ন, হিস্ট্রি অ্যান্ড পলিটিক্‌স। সম্পা: জাস্টিন জোন্‌স ও আলি ওসমান কাসমি। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৫৯৫.০০

দ্য শিয়া ইন মডার্ন সাউথ এশিয়া: রিলিজিয়ন, হিস্ট্রি অ্যান্ড পলিটিক্‌স। সম্পা: জাস্টিন জোন্‌স ও আলি ওসমান কাসমি। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৫৯৫.০০

আলোচ্য গ্রন্থটি দক্ষিণ এশিয়ার শিয়া সম্প্রদায় সংক্রান্ত কিছু সেমিনার পেপারের সংকলন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়াল হলোওয়ে কলেজে ২০১১-য় এ বিষয়ে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধগুলি আগে রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটি-র পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যায় (২৪/৩, ২০১৪) প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা দেখেছি যে, শিয়া ইসলাম সংক্রান্ত গবেষণা মূলত ইরান বা মধ্য এশিয়াকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। অথচ দক্ষিণ এশিয়াতেও বহু শিয়া বসবাস করেন। এদের মধ্যে কয়েকটি গোষ্ঠী আবার যথেষ্ট প্রভাবশালী। দক্ষিণ এশিয়ার শিয়াদের নিয়ে লিখিত আলোচ্য গ্রন্থটি তাই ব্যতিক্রমী। প্রতিষ্ঠিত গবেষকদের প্রবন্ধ নিয়েই গ্রন্থটি সংকলিত। ইস্‌না আশারি ও ইসমাইলি— এই দুই সম্প্রদায়ভুক্ত শিয়াদের নিয়েই আলোচনা রয়েছে এই গ্রন্থে। বৈচিত্রময় এই উপমহাদেশে যে বড় শহরগুলিতে শিয়া সংস্কৃতি ছাপ ফেলেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য করাচি, লখনউ, মুম্বই এবং হায়দরাবাদ। তা ছাড়া, দক্ষিণ এশিয়ার শিয়া সম্প্রদায়ের একটি অংশ পূর্ব আফ্রিকায় চলে গিয়েছিল। সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিশেষজ্ঞরা তাঁদের গবেষণার ডালি সাজিয়ে দিয়েছেন, যার ফলে এখানে বিভিন্ন গবেষণা প্রক্রিয়ার একটি মেলবন্ধন নজরে পড়ে, যা আধুনিক গবেষণার বৈশিষ্ট্য। ফলে শিয়া সমাজ ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত অনেক ধূসর জায়গাতেও আলোকপাত সম্ভব হয়েছে।

Advertisement

দক্ষিণ এশিয়ায় যত শিয়া বসবাস করেন জনবিন্যাসগত ভাবে ইরান ছাড়া আর কোথাও তার অধিক শিয়া জনসংখ্যা দেখতে পাওয়া যায় না। মহরমের মিছিলের কথা যদি মনে করি, তা হলে দেখব যে, দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনও সম্প্রদায়ই সম্ভবত শহর ও নগরে এতটা দৃশ্যমান নয়। তা সত্ত্বেও উপমহাদেশের শিয়া সম্প্রদায় নিয়ে ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত মাত্র দু’তিনটি উল্লেখ্য কাজ হয়েছে, যেমন জন নর্মান হলিস্টার-এর দ্য শি’য়া অব ইন্ডিয়া (১৯৩৬) এবং আসগর আলি ইঞ্জিনিয়ার-এর দ্য বোহরাজ (১৯৮০)। পরিস্থিতি বদলায়, যখন ১৯৮৬-তে প্রখ্যাত মধ্যযুগ বিশেষজ্ঞ সৈয়দ আথার আব্বাস রিজভি আমাদের উপহার দিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের উপর দুই খণ্ডে বিভক্ত অমূল্য গ্রন্থ। এর দু’বছরের মধ্যেই এল অষ্টাদশ শতকের অযোধ্যায় শিয়া রাজ্য স্থাপনের উপর লেখা জুয়ান কোল-এর গবেষণাগ্রন্থ। দক্ষিণ এশিয়ার শিয়া ইতিহাস সম্বন্ধে সমৃদ্ধ করেছেন ভারনন শুবেল (১৯৯৩), ডেভিড পিন্যল্ট (১৯৯২ ও ২০০১), টবি হাওয়ার্থ (২০০৫), সৈয়দ আকবর হায়দার (২০০৬), মার্ক ভ্যান গ্রনদেলে (২০০৯), টিনা পুরোহিত (২০১২), জাস্টিন জোনস (২০১২), কারেন রাফ্‌ল (২০১১) এবং ডায়ানা ডিসুজা (২০১২) প্রমুখ।

বিগত দুই শতকে সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে কী কী পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, তা নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে, গ্রন্থ ও প্রবন্ধাদিও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ওই সময়কালে শিয়া সম্প্রদায়ের ইতিহাস ছিল প্রায় অনালোচিত। আলোচ্য গ্রন্থটি সেই অভাব অনেকটাই পূরণ করবে। এই গ্রন্থের লেখকরা অনুধাবন করতে পেরেছেন যে, শিয়া সম্প্রদায়ের বিবর্তনে রাজনৈতিক ক্ষমতা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আলোচ্য প্রবন্ধকারগণ জানেন যে, শিয়া আত্মপরিচয়ে, অন্বেষণে এবং শিয়া সম্প্রদায়ের চেতনায় অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে কারবালার সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা। ঘটনাবলি যতই আধুনিক যুগের দিকে প্রবাহিত হতে লাগল, ততই প্রকট হল শিয়া বহুত্ববাদী-উদারনৈতিক আচারানুষ্ঠানের সঙ্গে শিয়া স্বাতন্ত্র্যবাদের দ্বন্দ্ব। অবশ্য এই বৈশিষ্ট্য সুন্নি মুসলমানদের মধ্যেও দেখা যায়। শিয়া ধর্মপরায়ণতা নিয়ে বিস্তারিত কোনও আলোচনা করতে গেলে অনিবার্য প্রাসঙ্গিকতায় চলে আসে ইরানের ভূমিকার কথা, বা ইরাকের শিয়া কেন্দ্রগুলির কথা এবং সাম্প্রতিক কালের লেবাননে শিয়া সক্রিয়তার কথা। এই প্রসঙ্গে যে আলোচনাটি না করলেই নয় তা হল, শিয়া ধর্মপরায়ণতা বা সম্প্রদায় গঠনে মহিলাদের বিশেষ ভূমিকার কথা।

দশম ও একাদশ শতকের সিন্ধু প্রদেশে ফতেমিদ শক্তি ইসমাইলিদের প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছিল। অপর দিকে, মধ্যযুগের দাক্ষিণাত্যে যে শিয়া সুলতানি শাসকগণ (বাহমনি ১৩০৭-১৫২৭, কুতুবশাহি ১৫১৮-১৬৫৭ এবং আদিলশাহি ১৫২৭-১৬৮৬) ছিলেন তাঁরা ওই অঞ্চলে শিয়া সম্প্রদায়গুলিকে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেন। হায়দরাবাদে সুন্নি আসফজাইরা রাজত্ব করতেন। সেখানে উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে প্রধানমন্ত্রী স্যর সালার জং-এর উদ্যোগে শিয়া সংহতি ত্বরান্বিত হয়। নবাব সাদাত খান বা বুরহান উল মুল্‌ক ছিলেন পারস্যের ভাগ্যান্বেষী সৈনিকের বংশধর। ফলে ইরান-ইরাকের শিয়া শহরগুলির বাইরে শিয়া সংস্কৃতি ও শাস্ত্র চর্চার কেন্দ্র হিসেবে লখনউ প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে।

শিয়া সম্প্রদায়ের বিবর্তনে ঔপনিবেশিক শক্তির ভূমিকাও মনে রাখতে হবে। লখনউয়ে সুন্নি উলামার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে ঔপনিবেশিক সরকার শিয়া মুজতাহিদদের কাজে লাগাবার কথা ভাবে। সাজ্জাদ রিজভি দেখান, কী ভাবে নাসিরাবাদি অষ্টাদশ শতকে ও ঊনবিংশ শতকের প্রাহ্নবেলায় তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে সুন্নি ও সুফিদের সমালোচনা করে তাঁর ভাবাদর্শ প্রচার করতেন, যা উত্তর ভারতের নবাবি শক্তিকে সমর্থন করত। তাহির কামরান বিশ্লেষণ করেছেন, কী ভাবে তাবার‌্যা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে পঞ্জাবে চিস্তি সুফিদের সঙ্গে শিয়াদের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। এই তাবার‌্যা অনুষ্ঠান ছিল শিয়া আত্মপরিচয়ের অন্বেষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং এখানে প্রথম তিন জন খলিফাকে হেয় করা হয়, যা সুন্নি সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। জাস্টিন জোনস্‌ দেখাতে চেয়েছেন ইমাম হোসেনের ভাবমূর্তির বিবর্তন, যার মধ্যে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল এক ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী চরিত্র। এস মির্জার প্রবন্ধে আছে, কী ভাবে সমসাময়িক হায়দরাবাদে শিয়া ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে একটি সক্রিয় ধর্মীয় আনুগত্য দানা বাঁধছিল— যেখানে খোজা শিয়া তান্‌জিম প্রতিষ্ঠানটির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এ ক্ষেত্রে সেই সমস্ত দরিদ্র ছাত্রদের কথা ভাবা হল, যারা যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে চেয়েছিল। হায়দরাবাদের মজলিসের বক্তৃতা গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করে হাওয়ার্থ সেখানে শিয়া আত্মপরিচয় অন্বেষণ ও সম্প্রদায় গঠনের ধরনটি বুঝতে চেয়েছেন। মিশেল বোভিন গতানুগতিক আচারানুষ্ঠানের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিকে বিচার করে খোজা ইসমাইলিদের ভেতরের দ্বন্দ্বকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন। এই প্রসঙ্গে ওই সমস্ত আচারানুষ্ঠানের প্রতি আগা খানের মনোভাবকেও বুঝতে সচেষ্ট হয়েছেন। অপর দিকে, সাইমন ফুকস কারবালার ঘটনার গুরুত্ব অন্য একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেয়েছেন। ইরানের বিপ্লবের পর পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়কে নেতৃত্ব দিতে চায় ইরান। কিন্তু পাকিস্তানের শিয়ারা খোমেইনির একক নেতৃত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে ধর্মীয় কথোপকথনের যে চেতনা আরিফ হোসেন উপস্থাপন করেছিলেন, সে ক্ষেত্রেও পাকিস্তানের শিয়া সম্প্রদায় সহমত ছিলেন না। শিয়াদের মধ্যেও যে নানা মতভেদ ছিল, বৈচিত্র ছিল, এই ঘটনা তারই প্রমাণ।

প্রবন্ধগুলি পাঠ করলে স্বাতন্ত্র্যের দিকে যাত্রা করার একটি প্রবণতা দক্ষিণ এশিয়ার শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে চোখে পড়ে। যেমন ইসমাইলি খোজাদের নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে সৌমেন মুখোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে, সম্প্রদায় বহির্ভূত মানুষদের জন্য আগা খান উন্নয়ন পরিকল্পনায় স্থান অতি সংকুচিত। তবে এই সীমাবদ্ধতার কথা ভুলে যেতে পারলে মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়— কী ভাবে আদি খোজা সম্প্রদায় সমাজসেবার চেতনাকে বিস্তৃত করার মধ্যে দিয়ে ইসলামের সামাজিক বিবেককে উন্মুক্ত করতে সচেষ্ট হয়, তা বোঝা যাবে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক সক্রিয়তার কথাও। তবে যদি বলি যে, আধুনিক উপমহাদেশে শিয়া ভাবনায় ও কর্মকাণ্ডে কেবলমাত্র নির্ভেজাল স্বাতন্ত্র্যবাদই দৃষ্টিগোচর হয়, তা হলে সত্যের অপলাপ হয়। তাই তো দেখি যে, ১৯৪০-এর দশকে লখনউতে সৈয়দ আলি নাকি যখন ইমাম হোসেনের শাহাদাত প্রাপ্তির ১৩০০ বছর উদ্‌যাপনে উদ্যোগী হন, তাঁর সঙ্গে শিয়াদের পাশাপাশি শামিল হন সুন্নি ও হিন্দুরাও। এই প্রয়াস কেবল অবিচারের বিরুদ্ধে মানব সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ ছিল না, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধের বার্তাও এই প্রয়াস বহন করেছিল।

কোনও গবেষণাই নিখুঁত হয় না, আরও উন্নত গবেষণার অবকাশ সব সময়ই থাকে। এটিও তার ব্যতিক্রম নয়। যখন পিন্যল্টস, রাফ্‌ল, ডিসুজা, কুগ্‌ল এবং হাওয়ার্থ-এর মতো গবেষক দক্ষিণ এশিয়ার শিয়া মহিলাদের নিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেছেন, তখন এখানে এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার কোনও প্রয়াস দেখা গেল না। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম মুসলিম সম্প্রদায়ের বাস ছিল অবিভক্ত বাংলা। বাংলার কয়েক জন নবাবের সঙ্গে পারস্যের প্রত্যক্ষ যোগাযোগও ছিল এবং তাঁরা শিয়া আচারানুষ্ঠানকে জনপ্রিয়ও করেন। বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতিতে কারবালা বিষয়ক জারি গান এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এই গ্রন্থে সেই অবিভক্ত বাংলাও বাদ গেছে। প্রথিতযশা ইতিহাসবিদ ফ্রান্সিস রবিনসনের লেখা ভূমিকা গ্রন্থের মূল্য বৃদ্ধি করেছে।

আরও পড়ুন
Advertisement