পুস্তক পরিচয় ২

চিরাভ্যস্ত ভাবনাচিন্তাকে আঘাত করেছেন

গোলাম মুরশিদ রাসসুন্দরী, কৃষ্ণভাবিনীর জীবনকথা ও রোকেয়ার মহৎ জীবনাদর্শ একালের পাঠকদের সামনে উপস্থাপিত করে পুরুষ সমাজের চিরাভ্যস্ত ভাবনা-চিন্তাকে আঘাত করেছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৬ ০০:১৯

গোলাম মুরশিদ রাসসুন্দরী, কৃষ্ণভাবিনীর জীবনকথা ও রোকেয়ার মহৎ জীবনাদর্শ একালের পাঠকদের সামনে উপস্থাপিত করে পুরুষ সমাজের চিরাভ্যস্ত ভাবনা-চিন্তাকে আঘাত করেছেন।’ জানিয়েছেন স্বরাজ সেনগুপ্ত, মুরশিদের নারী প্রগতির তিন পথিকৃৎ/ রাসসুন্দরী দেবী, কৃষ্ণভাবিনী দাস ও বেগম রোকেয়া (রেডিয়্যান্স, ১০০.০০) বইটির শুরুতেই। তাতে কৃষ্ণভাবিনী সম্পর্কে লিখছেন মুরশিদ ‘‘সেকালে মহিলাদের কর্মভূমিকা সম্পর্কে এ দেশের নারী-পুরুষের যে-সার্বজনিক আদর্শ ছিলো, তাঁর আদর্শ ছিলো তা থেকে অনেকাংশে ভিন্ন। পুরুষের সমান মর্যাদা ও অধিকার পেতে চাইলে মেয়েদেরও সমান কাজ করতে হবে এবং আর্থিক দিক দিয়ে ‘উপযোগী’ হতে হবে— এ তিনি সেকালেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।’’ আর রাসসুন্দরীর ‘রচনায় বৃহত্তর সমাজের চিত্র আশা করাও সমুচিত নয়। কিন্তু সেকালে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী গ্রামের একজন সাধারণ মহিলা কেমন করে ভাবতেন, তার উজ্জ্বল বিবরণ পাই তাঁর আত্মজীবনীতে।... সমাজে সেকালের মহিলাদের স্থান, সংসারে তাঁদের ভূমিকা, বিয়ে এবং স্বামী সম্পর্কে মনোভাব এবং পারিবারিক ইতিহাস যথেষ্ট পরিমাণে জানা যায়।’ লিখেছেন মুরশিদ। তিনি জানাচ্ছেন ‘১৯০৪ সালে, মাত্র ২৪ বছর বয়সে রোকেয়া লেখেন, পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষরা কেবল গায়ের জোরে মেয়েদের বঞ্চিত করেছেন সকল ন্যায্য অধিকার থেকে।’ লেখকের কথায়, ‘রোকেয়া মনে করতেন, সব বিদ্যাতেই মহিলাদের সমান অধিকার,... নারীকে সর্ববিদ্যায় পারদর্শী করে সুমার্জিত এবং পূর্ণবিকশিত একটি ব্যক্তিতে রূপায়িত করাই ছিলো তাঁর বাসনা।’

বেদ, ব্রাহ্মণ সাহিত্য, আরণ্যক, উপনিষদ থেকে সংস্কৃত নাটক ও মহাকাব্যের মূল্যায়ন করেছেন সুকুমারী ভট্টাচার্য। তাঁর চিন্তাভাবনার পরিধির বিস্তার দীর্ঘায়ত— আধুনিক সময়ের সমস্যা, রামমন্দির ভাঙা বা গুজরাত গণহত্যা, বামিয়ানে শিল্পহত্যা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সূত্রেই সম্পাদক আফিফ ফুয়াদ দিবারাত্রির কাব্য-এর ‘সুকুমারী ভট্টাচার্য সংখ্যা’ (২৫০.০০) প্রকাশের অভিপ্রায় জানিয়েছেন: ‘আমরা চেষ্টা করেছি তাঁর মূল্যায়নকে পাঠকের সামনে যথাযথ তুলে ধরতে।’ যেমন ‘সুকুমারী ভট্টাচার্যের দৃষ্টিতে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান এবং কিছু ভাবনা’-য় গোপা দত্তভৌমিক লিখছেন ‘‘ ‘ভালো মেয়ে’ কাকে বলে শাস্ত্র তা সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ-এর মতে উত্তম নারী স্বামীকে তুষ্ট করবে, পুত্রসন্তানের জন্ম দেবে এবং স্বামীর উক্তির প্রতিবাদ করবে না। বৌধায়ন ধর্মসূত্র, আপস্তম্ব ধর্মসূত্র এবং মনুসংহিতা জানাচ্ছে পুত্রসন্তানই কাম্য, তাই যে স্ত্রী শুধু কন্যার জন্ম দেয় তাকে বারো বছর পরে পরিত্যাগ করা যায়। নিঃসন্তান স্ত্রীকে দশবছর পরে এবং মৃতবৎসাকে পনেরো বছর পরে ত্যাগ করা যায়।’’ এমন প্রবন্ধাদিতেই ঋদ্ধ এ-পত্র। সুকুমারীর জীবনপঞ্জি, গ্রন্থপ়ঞ্জি, এমনকী তাঁকে নিয়ে চর্চার পঞ্জিও পত্রিকাটিতে। সঙ্গে তাঁর একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ চিঠি, তপোধীর ভট্টাচার্য ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্নাকে লেখা। সেগুলির একটির কিয়দংশ: ‘সাহিত্য অমল তরু নয়। সামাজিক রাষ্ট্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা থেকেই উদ্ভূত বলেই এগুলির প্রতিবিম্ব সাহিত্যে দেখা যায়।... গ্রীক নাটকে দৈবই শক্তিমান, কিন্তু মানুষ বুক ফুলিয়ে তাল ঠুকে প্রতিস্পর্ধায় তাকে আহ্বান করছে মল্লযুদ্ধে অবধারিত পরাজয় জেনেই।... এই প্রকাশের জন্যে প্রতীক্ষা ছিল বস্তুগত সভ্যতার সেই স্তরটির যেখানে সে জড়প্রকৃতিকে পুরো জয় করতে না পারলেও তাকে স্বরূপে চিনেছে (বিজ্ঞানে) এবং দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করছে, কোনো কোনো খণ্ডযুদ্ধে জিতছেও।’

Advertisement

ত্রিষ্টুপ-এর (১৫০.০০) ক্রোড়পত্রও সুকুমারীকে নিয়ে, সম্পাদক ব্রজকুমার সরকার জানিয়েছেন ‘প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও গবেষক শ্রীমতী রোমিলা থাপার তাঁর একটি রচনায় লিখেছেন— ‘‘সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর সমসাময়িক ইন্ডোলজিস্টদের মধ্যে একজন অন্যতম অগ্রগণ্য, যিনি তাঁর বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে ভারতীয় পৌরাণিক আখ্যানগুলির ওপর এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী ব্যাখ্যা করেছেন।’’ ’ তাঁর চিন্তাভাবনার পরিসরটি তুলে আনার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিসরেও তাঁকে চেনার চেষ্টা ক্রোড়পত্রটিতে।

বারণরেখা/ ভাবনার অন্য ভুবন-এর (সম্পা: অরূপ বসু। ৩০০.০০) বিষয়ই: ‘সুকুমারী: জীবন ও জিজ্ঞাসা’। তাঁকে ও তাঁর বাঁধনছেঁড়া ভাবনা নিয়ে লিখেছেন বিশিষ্ট জনেরা। যেমন ভারতবিদ্যা চর্চায় নিহিত তাঁর মননটুকু চিনিয়ে দেন দেবেশ রায়: ‘যে স্বাদেশিক-সামাজিকতার ব্রত থেকে নীহাররঞ্জন রায় বাঙালির ইতিহাস রচনা করেন,.... সেই স্বাদেশিক-সামাজিক ব্রত থেকেই সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর ভারতবিদ্যার অনুশীলনকে প্রামাণিক করে তোলেন।’

রাধানাথ শিকদার (১৮১৩-১৮৭০) ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানের সম্ভাবনাময় বিকাশের সূচনা করেন। রাধানাথ শিকদারের আত্মকথা ও মূল্যায়ন-এর (পত্রলেখা, ১৭০.০০) সম্পাদক দীপক দাঁ শুরুতেই তাঁকে জানার সূত্রগুলি চিনিয়ে দিয়েছেন: ‘বৈজ্ঞানিক জরিপকার্যে উচ্চ গণিতশাস্ত্রের প্রয়োগ ও নিখুঁত গাণনিক পরিমাপক হিসাবে রাধানাথকে এক নতুন প্রতিভা হিসাবে পাওয়া যায়।... আবহাওয়া বিজ্ঞানের কাজে তিনি সারা ভারতে পথিকৃৎ-এর সম্মানে ভূষিত হন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যয়নে তাঁর গভীর অভিনিবেশ আমাদের বিস্মিত করে। গ্রেট ট্রিগানোমেট্রিক্যাল সার্ভে অফিসে চিফ কমপিউটর (প্রধান গণকবিদ) হিসাবে রাধানাথের বৈজ্ঞানিক প্রয়াসের উচ্চ স্বীকৃতি তাঁকে আধুনিক ভারতের সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।’ রাধানাথের ‘আত্মকথা’ তো আছেই, আছে তাঁকে নিয়ে সেকাল-একালের মনস্বীদের রচনাও। যেমন যোগেশচন্দ্র বাগল লিখেছেন ‘রাধানাথ তেজস্বী ও ন্যায়পরায়ণ লোক ছিলেন। আইন-বিগর্হিত হইলেও তখনকার কোম্পানির কর্মচারীরা গরিব লোকদের ধরিয়া বেগার খাটাইতে দ্বিধা করিতেন না।... রাধানাথ নিজ ভৃত্যদিগকে বেগার খাটিতে নিষেধ করেন ও ম্যাজিস্ট্রেটের মালপত্র নিজ গৃহে রাখিয়া দেন।... ম্যাজিস্ট্রেটের কর্মে ব্যাঘাত জন্মাইবার অপরাধে রাধানাথকে অভিযুক্ত করা হয়। মোকদ্দমা বহুদিন চলিবার পর, বিচারে রাধানাথের দুই শত টাকা অর্থদণ্ড দিতে হয়। কিন্তু এই উপলক্ষ্যে যে আন্দোলন উপস্থিত হইল, তাহার ফলে উক্ত অন্যায়ের প্রতিকার-এর পথ সুগম হয়।’ শিবনাথ শাস্ত্রী আলোকিত করেছেন আর একটি দিক: ‘সরল স্ত্রীপাঠ্য ভাষাতে বাঙলা লেখা রাধানাথের একটা বাতিকের মত হইয়া উঠিয়াছিল। মাসিক পত্রিকাতে কোনও প্রবন্ধ লিখিয়া তিনি স্বীয় পরিবারস্থ স্ত্রীলোকদিগকে পড়িয়া শুনাইতেন, তাঁহারা বুঝিতে পারেন কিনা।’

আরও পড়ুন
Advertisement