Amartya Sen

ভারত বলতে যে দেশকে বোঝায়

অমর্ত্য সেনের দু’টি বহুচর্চিত লেখা ও বক্তৃতা— দু’টিই ১৯৯৮ সালের, অগস্ট মাসে ইউনেস্কো বক্তৃতা, এবং নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর আত্মজীবনীমূলক লেখাটি— বাংলায় অনুবাদ করলেন উর্বা চৌধুরী।

Advertisement
অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২১ ০৮:১১

নিজের কথা পৃথিবীর কথা
অমর্ত্য সেন
অনুবাদ: উর্বা চৌধুরী

২০০.০০
গাঙচিল

মূর্খের সবচেয়ে বড় অভিশাপ, তার নিজের অজ্ঞানতা সম্বন্ধে অন্ধত্ব। যে জ্ঞানাঞ্জনশলাকা তার এই অন্ধত্ব দূর করতে পারত, মূর্খ তার অলীক অহঙ্কারে সেই পুস্তকরাজির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক স্থাপিতই হতে দেয়নি। ফলে, যাঁরা বাঙালিকে ‘হিন্দু নববর্ষ’-এর শুভেচ্ছা জানিয়ে আত্মশ্লাঘা অনুভব করছেন, তাঁরা কখনও জানবেন না, প্রায় দুই যুগ পূর্বে, এক বক্তৃতায় অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, “কোনও বাঙালি হিন্দু যখন তাঁর ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করেন তখন তিনি এটা নাও জানতে পারেন যে তাঁর হিন্দু আচারের জন্য ব্যবহার করা তারিখগুলো আসলে মহম্মদের মক্কা থেকে মদিনা যাত্রার সময়কালের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে তৈরি হয়েছে।” হায় বঙ্গ হিন্দুবীর, বঙ্গ সংস্কৃতির একটি ইঞ্চিও যে তোমার একবগ্গা মৌলবাদের খোপে পুরিতে পারিবে না, মূর্খতার অহঙ্কারে সেই কথাটিও তোমার অজানাই থাকিয়া গেল!

Advertisement

অমর্ত্য সেনের দু’টি বহুচর্চিত লেখা ও বক্তৃতা— দু’টিই ১৯৯৮ সালের, অগস্ট মাসে ইউনেস্কো বক্তৃতা, এবং নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর আত্মজীবনীমূলক লেখাটি— বাংলায় অনুবাদ করলেন উর্বা চৌধুরী। সাবলীল অনুবাদ, সামান্য দু’একটি জায়গা বাদে ঠোক্কর খেতে হয় না কখনও। ভাষার ব্যবধান ঘুচলে আরও বেশি পাঠকের কাছে অসামান্য লেখা দু’টি পৌঁছতে পারে, তাই এই অনুবাদের কাজটিকে অবশ্যই জনস্বার্থের অনুকূল কাজ বলা যায়। কেন, উপরের উদ্ধৃতিটির মতো আরও গোটাকয়েক উদাহরণ তুলে আনলে তা বুঝতে সুবিধা হবে। নিজের ছাত্রজীবনে রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রশ্নে অমর্ত্য বলেছেন, “বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রশ্নে আমি কিছুটা দোটানায় পড়ে যাই। আমার মনে হয়েছিল, আলোকায়ন-পরবর্তী ইউরোপ ও আমেরিকার উদার রাজনৈতিক বিতর্ক তো বাদ পড়ে যাচ্ছেই, পাশাপাশি ভারত সহ বিশ্বের নানান সংস্কৃতিতে বহুত্ববাদের প্রতি সহিষ্ণুতার যে মূল্যবোধ এত গুরুত্ব পেয়ে এসেছে, সে দিকটিও এখনকার বামপন্থী চিন্তায় অবহেলিত থেকে যাচ্ছে।” যে সময়ের কথা বলছেন অমর্ত্য, তখন রাজনৈতিক হিন্দুত্বের বিপদটি গৃহস্থের হেঁশেলে ঢুকে পড়েনি।

ভারত দেশটা চরিত্রগত ভাবে কেমন, তা বোঝাতে গিয়ে অমর্ত্য বলেছেন, “সপ্তম শতাব্দীতে যখন ব্রিটেনে সবেমাত্র খ্রিস্টধর্মের প্রসার শুরু হয়েছে, তারও তিনশো বছর আগে থেকে অর্থাৎ চতুর্থ শতাব্দী থেকেই ভারতবর্ষে খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেছেন। জেরুসালেমের পতনের পর ইহুদিরাও ভারতে বসবাস শুরু করেন। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম তো বহু দিন ধরেই ভারতের মাটিতে শিকড় বিস্তার করেছিল। সত্যি বলতে কি, মুসলমানদের আগমন কেবল ছবিটাকে পূর্ণতা দেয়।” প্রাক্-ইসলাম বিশুদ্ধ হিঁদুয়ানি সংস্কৃতির গল্প যাঁরা ফেরি করে বেড়ান, তাঁরা ভারতবর্ষ নামক দেশটিকে চেনেন না, চেনেননি কোনও দিন।

কাদের মিয়া ছিলেন সেই ভারতের মানুষ। দিন-আনি-দিন-খাই মুসলমান মজুর। ঢাকা শহরে যখন দাঙ্গা চরমে, তখনও কাজের খোঁজে রাস্তায় নামতে হয়েছিল তাঁকে। বাড়িতে খাবার ছিল না, বাড়ির লোকের জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে তাঁর না বেরিয়ে উপায় ছিল না। হিন্দুপ্রধান পাড়ায় ছুরিকাহত হয়ে মারা যান কাদের মিয়া। প্রাক্‌-কৈশোরের সেই স্মৃতি আজীবন ভোলেননি অমর্ত্য। তিনি লিখেছেন, “দরিদ্র মানুষের আর্থিক অক্ষমতা তার অন্যান্য স্বক্ষমতাকে (ফ্রিডম) বিপর্যস্ত করে।” যে মানুষটি দু’মুঠো খাবারের সংস্থান করতে সব বিপদ অগ্রাহ্য করেও পথে নামতে বাধ্য হন, তাঁকে সেই ক্ষুধার পরিচয়ে না চিনে ধর্মের পরিচিতিতে যারা চেনে, তারা যে ভারতের শত্রু— তখনও, এখনও— অমর্ত্য সে কথা বারে বারে মনে করিয়ে দিয়েছেন। সেই কথাগুলো পড়ে আমরা মনে রাখতে পারলাম কি না, সেটা আমাদের বোধের প্রশ্ন।

আরও পড়ুন
Advertisement