চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ভারতমাতা

সম্প্রতি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এ অনুষ্ঠিত অবনীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনীটি দেখলেন মৃণাল ঘোষমাত্র একটি ছবি নিয়ে একটি প্রদর্শনী। এ রকম একটি বিরল ঘটনা ঘটল সম্প্রতি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এ। প্রদর্শিত হল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারতমাতা’ ছবিটি। অবনীন্দ্রনাথের ছবির একটি বড় অংশ দীর্ঘকাল সংগৃহীত ছিল রবীন্দ্রভারতী সোসাইটিতে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৬ ০০:০০
শিল্পী: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

শিল্পী: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

মাত্র একটি ছবি নিয়ে একটি প্রদর্শনী। এ রকম একটি বিরল ঘটনা ঘটল সম্প্রতি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এ। প্রদর্শিত হল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ভারতমাতা’ ছবিটি। অবনীন্দ্রনাথের ছবির একটি বড় অংশ দীর্ঘকাল সংগৃহীত ছিল রবীন্দ্রভারতী সোসাইটিতে। তা থেকে নির্বাচিত একটি অংশ নিয়ে মাস কয়েক আগে প্রদর্শনী করেছেন ভিক্টোরিয়া কর্তৃপক্ষ। সুপরিকল্পিত সেই প্রদর্শনী কিউরেট করেছিলেন রতন পারিমু। ‘ভারতমাতা’ ছবিটি সেই প্রদর্শনীরও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তা সত্ত্বেও একই ছবি যে আবার দেখানো হচ্ছে তাতে ছবিটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বোঝা যায়।

ছবিটি অবনীন্দ্রনাথ কবে এঁকেছিলেন, তা নিয়ে নানা মত আছে। নন্দলাল বসু ড. পঞ্চানন মণ্ডলের সঙ্গে কথোপকথনে বলেছেন, ‘ওখানে অবনীবাবুর ফিনিশ-করা প্রথম বিখ্যাত ছবি ‘বঙ্গমাতা’ (১৯০২)। এই ‘বঙ্গমাতা’ই ‘ভারতমাতা’ হলেন ১৯০৫ সালে। (ভারতশিল্পী নন্দলাল, প্রথম খণ্ড, পৃ: ৬৫)। অবনীন্দ্রনাথ ‘ঘরোয়া’-র স্মৃতিচারণায় বলেছেন: ‘তখন এক সময়ে হঠাৎ দেখি সবাই স্বদেশী হুজুগে মেতে উঠেছে। ... সেই প্রথম আমরা বাংলা ভাষার জন্য লড়লুম। ... আমি আঁকলুম ভারতমাতার ছবি। হাতে অন্নবস্ত্র বরাভয় এক জাপানি আর্টিস্ট সেটিকে বড়ো করে একটা পতাকা বানিয়ে দিলে।’ বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় অবনীন্দ্রনাথের ছবির ক্রমবিকাশ আলোচনা করতে গিয়ে দেখিয়েছেন ১৯০৩ সালের পর অবনীন্দ্রনাথ জাপানি জলরঙের প্রকরণে যে ক’টি ছবি এঁকেছেন, তার মধ্যে রয়েছে ‘সন্ধ্যা-প্রদীপ’, ‘ঊর্ধ্বাকাশে যক্ষরা’, ‘ভারতমাতা’ ইত্যাদি।

Advertisement

১৯০২ সালে ওকাকুরা প্রথম ভারতে আসেন। জাপানি প্রভাবের সূত্রপাত সেখান থেকে। দেশে ফিরে গিয়ে ওকাকুরা তাইকান ও হিসিদা নামে দুই জাপানি শিল্পীকে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা এসেছিলেন ১৯০৩ সালে। তাঁদের কাছ থেকেই অবনীন্দ্রনাথ জাপানি প্রকরণ শেখেন। এই তথ্যের সমর্থন মেলে সত্যজিৎ চৌধুরীর ‘অবনীন্দ্র-নন্দনতত্ত্ব’ গ্রন্থেও। তা সত্ত্বেও পার্থ মিত্র তাঁর প্রজ্ঞাদীপ্ত গ্রন্থ ‘আর্ট অ্যান্ড ন্যাশানালিজম ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’-তে ছবিটির তারিখ বলেছেন ১৯০৬ (পৃ: ২৯৫)। শোভন সোম তাঁর ‘সংকলিত প্রবন্ধ’ বইতে লিখেছেন, ‘উনিশশ’ পাঁচে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের কালে অবনীন্দ্রনাথ আঁকলেন দেবীরূপিণী বঙ্গমাতা।’ শোভন সোম এই ছবির ভাবনার উৎস নির্দেশ করেছেন ১৮৩০-এ আঁকা ইউজিন দ্যলাক্রোয়া’র ‘স্বাধীনতার দেবী জনগণকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন’ শীর্ষক ছবিতে। বলেছেন, ‘দ্যলাক্রোয়া’র ছবির রূপান্তর ঘটেছে অবনীন্দ্রনাথের বঙ্গমাতার ধারণায়।’ (পৃ: ৩২)। স্বদেশী আন্দোলনের আবহাওয়ায় এই ছবিটি দিয়েই পতাকা তৈরি করেছিলেন জাপানি শিল্পী টাইকান। ছবিটি এভাবেই স্বদেশী আন্দোলের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে যুক্ত হয়ে যায়। ছবিটির তাৎপর্য এখানেই।

মোগল স্থাপত্য রীতি ব্যবহার করে যে সব ছবি করেছেন অবনীন্দ্রনাথ, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য— জলরঙের রচনা, ‘দ্য বিল্ডিং অব দ্য তাজ’ (১৯০১)। দ্বিতীয়টি তেলরঙে আঁকা ‘দ্য পাসিং অব শাহজাহান’ (১৯০২)। এই পর্যায়ের পর এসেছে জাপানি প্রকরণ আত্তীকরণ পর্ব। এরই প্রকাশ অন্যান্য ছবির মধ্যে ‘ভারতমাতা’ ছবিতে। এই ধারাবাহিকতায় তিনি আঁকেন ‘রুবাইত-ই-ওমর খৈয়াম’ চিত্রমালা। যেটি তাঁর নিজস্ব স্টাইল গড়ে তুলতে পেরেছেন বলে মনে করেন বিনোদবিহারী, কে. জি. সুব্রামনিয়ন বা আর. শিবকুমার। এর পর অবনীন্দ্র-প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ ঘটেছে ১৯৩০-এর ‘আরব্য-রজনী’ চিত্রমালায়।

‘ভারতমাতা’ ছবিটির রূপাবয়বের আদর্শ ছিলেন নিবেদিতা। আবার নিবেদিতারই উদ্যোগে ‘বঙ্গমাতা’-র ‘ভারতমাতা’য় উত্তরণ। পরবর্তী কালে এই ছবিটি সম্পর্কে দু’দিক থেকে সমালোচনা উঠেছে। অনেকে মনে করেন এই ছবিটি অবনীন্দ্রনাথের রূপভাবনার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত নয়। দ্বিতীয় সমালোচনা হল বহুধর্মের এই দেশে ‘ভারতমাতা’ কেন হবেন একজন হিন্দু দেবী। এ সমস্ত সমালোচনা সত্ত্বেও নব্য-ভারতীয় ঘরানার বিবর্তন ধারায় ‘ভারতমাতা’ একটি স্মরণীয় দিকচিহ্ন হিসাবে গণ্য হয়ে এসেছে।

আরও পড়ুন
Advertisement