পুস্তক পরিচয় ২

বঙ্গজীবনের সাংস্কৃতিক বৈভব-বৈচিত্র

প্রত্নতত্ত্ব, আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতির বিষয়ভিত্তিক ভিন্নতার মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের প্রবাহ-ধারা আছে। এই প্রবহমানতায় ইতিহাসের উপাদান, লোকসমাজের প্রাত্যহিকতা, বঙ্গজীবনের সাংস্কৃতিক বৈভব-বৈচিত্র নানা চর্চায় প্রতিফলিত হয়। নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের সমাজ, রাজনীতি, বাণিজ্য, শিল্পকলা, প্রাসাদ, মন্দির, মসজিদ, গির্জা, সমাধিক্ষেত্র ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৫ ০০:০১

প্রত্নতত্ত্ব, আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতির বিষয়ভিত্তিক ভিন্নতার মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের প্রবাহ-ধারা আছে। এই প্রবহমানতায় ইতিহাসের উপাদান, লোকসমাজের প্রাত্যহিকতা, বঙ্গজীবনের সাংস্কৃতিক বৈভব-বৈচিত্র নানা চর্চায় প্রতিফলিত হয়। নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের সমাজ, রাজনীতি, বাণিজ্য, শিল্পকলা, প্রাসাদ, মন্দির, মসজিদ, গির্জা, সমাধিক্ষেত্র ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। জেলার নানা প্রান্তের অজস্র সমাধির হদিশ দিয়েছেন সুশান্ত বিশ্বাস মুর্শিদাবাদের প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র (শিল্পনগরী প্রকাশনী, ৮০.০০) বইতে। আলিবর্দি, সিরাজউদ্দৌল্লা, মুর্শিদকুলি, মিরজাফর, মিরমদনের সমাধি-সহ কাশিমবাজারের ডাচ ও ইংরেজ সমাধিক্ষেত্র, পিরের মাজারের ক্ষেত্র-অনুসন্ধানী বর্ণনা আছে এখানে।

আশুতোষ সংগ্রহশালার ভাস্কর্য নিয়ে ১৯৪৭-এ পরিচয়-পুস্তিকা তৈরি করেন কল্যাণকুমার গঙ্গোপাধ্যায়। পরিবর্ধিত ও পুনর্মুদ্রিত হয়ে বাংলার ভাস্কর্য (সুবর্ণরেখা, ২০০.০০) আজও গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। মন্দিরকে কেন্দ্র করে যে মূর্তিশিল্পের উদ্ভব ও বিকাশ অখণ্ড বাংলায় ঘটেছিল, তার সুচারু আলোচনায় মূল্যবান এই বই।

Advertisement

ইতিহাস আলোচনায় আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট বৃহত্তর চর্চাতেও গুরুত্বপূর্ণ। বীরভূম জেলা-সদর সিউড়ি নিয়ে পার্থপ্রতিম দে লিখেছেন সিউড়ির ইতিবৃত্ত (গল্পসরণি, ১০০.০০)। শহর গড়ে ওঠার আদিপর্ব, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন, ধর্মীয় স্থাপত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য, স্বাধীনতা সংগ্রাম ইত্যাদির তথ্যসন্নিবেশে বইটি আঞ্চলিক ইতিহাসের একটি সংযোজন।

বর্ধমানের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অঞ্চল কাটোয়া। বৃহত্তর কাটোয়া মহকুমার স্থাননাম ও জনপদ পরিচিতি বইয়ে (নান্দনিক, ১৫০.০০) স্বপনকুমার ঠাকুর সেই অঞ্চলের স্থাননামের ব্যাখ্যায় লোকঐতিহ্য, জনজাতি, গ্রামদেবতা, লোকছড়া, গাছপালা— নানা বিচিত্র উৎস থেকে তথ্য আহরণ করেছেন। মূল্যবান জনপদ পরিচিতি অংশটি নিঃসন্দেহে নিবিড় ক্ষেত্রসমীক্ষার ফসল। সেখ ফিরোজ আলি (কাঞ্চন) গলসী কথা (৭০.০০) বইতে বর্ধমান জেলার গলসি থানা এলাকার প্রাচীনত্ব, ভূ-পরিচয়, আঞ্চলিক ধর্ম-সংস্কৃতি ও বিশিষ্ট ব্যক্তির তথ্য-পরিচয় দিয়েছেন।

খাতায়-কলমে চর্চার লোকায়ত হাওড়া (পুস্তক বিপণি, ১৫০.০০) বইতে তপন কর মিশিয়েছেন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয়। হাওড়া জেলার লোকসাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে ভাষা, গান, নাটক, ব্রত, আচার-অনুষ্ঠান, পিঠে-পুলি পুতুলের কথা-সহ আছে ঘরোয়া সংস্কৃতির দৈনন্দিনতার নানা রূপ। কালিকাপাতাড়ি নৃত্য নিয়ে লেখকের নিজস্ব প্রকল্প ও প্রয়োগ ভাবনার দিকও জানা যায় বইটি পড়লে।

মেদিনীপুর জেলার লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতি (অক্ষর প্রকাশনী, ৩০০.০০) লক্ষ্মী দাস অট্ট-র প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার প্রকাশিত রূপ। প্রশাসনিক বিভাজনে মেদিনীপুর জেলা পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগীকরণ হলেও, সাংস্কৃতিক সম্পর্কসূত্রে আবহমানের যোগাযোগ। লোকায়ত সংস্কৃতিতে ভাষা, আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস-সংস্কার, নাচ, গান, নাটকের রূপ, লোকপ্রযুক্তি, পরিচ্ছদ, আভরণ, খাদ্য, চিকিৎসা-সহ নানা বিচিত্র আলোচনায় সমৃদ্ধ এই বই।

জেলার অঞ্চলভিত্তিক নিজস্বতা কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র চর্চার বিষয় হতে পারে। আঞ্চলিক সমাজজীবনের বহু বিচিত্র উপাদান— জনগোষ্ঠীর পরিচয়, ধর্মাচরণ, সংগীত, ধাঁধা, ছড়া, মেলা, পুজোপার্বণ ও উৎসবের সঙ্গে মিশে থাকে। এই পটভূমিতে বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণ ভাগ অর্থাৎ খাতড়া মহকুমার তথ্য চর্চায় সুবীর মণ্ডল লিখেছেন দক্ষিণ বাঁকুড়ার লোকজীবন ও সংস্কৃতি (লোক, ৩০০.০০)।

নিরাপদ মণ্ডল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ডাং পুতুলনাচের শিল্পী ও সংগঠক হিসেবে ভিন রাজ্য এবং বিদেশেও গেছেন। বিশ্বের পুতুলনাচের কথা, ভারতের পুতুলনাচের ইতিবৃত্ত, মঞ্চ, নাটক, সংগীত, আলোর কথা-সহ বাংলার পুতুলনাচের শিল্পীদের পরিচয় এবং ভারতের বিভিন্ন পুতুলনাচের দলের ঠিকানা সংবলিত পুতুলনাচের ইতিহাস অন্বেষা (সমকালের জিয়নকাঠি প্রকাশন, ১৫০.০০) শীর্ষক এই বই শিল্পীর অন্তরঙ্গ আগ্রহের প্রকাশ।

লোকনৃত্যে সার্বিক নৃত্যধারার যে সূত্রকথা আর পরিকল্পিত কাঠামোর ভিত্তিভূমি, তা দেশ-কালের প্রেক্ষিতে দেখা যায়। মহুয়া মুখোপাধ্যায়ের ফোক ডান্স ফর্মস অব বেঙ্গল (এন ই পাবলিশার্স, ৩০০.০০) বাংলার বহুবিচিত্র নৃত্যধারার পরিচয়জ্ঞাপক বিশ্লেষণী আলোচনা। আছে ধর্মীয় ও আচারকেন্দ্রিক নৃত্য, যুদ্ধ নৃত্য, আনন্দোৎসবের নৃত্য, লোকনাট্যে সংশ্লিষ্ট নৃত্য, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বহুবিচিত্র নৃত্যশৈলীর তথ্যবর্ণনা আর ধ্রুপদীশৈলীর তুলনামূলক প্রেক্ষিতে বঙ্গনৃত্যধারার রূপবৈশিষ্ট্য আলোচনা।

‘বাঙলার মাটি বাঙলার জল/ বাঙলার হাওয়া বাঙলার ফল/ পুণ্য হউক, পুণ্য হউক,/পুণ্য হউক হে ভগবান।’ স্বদেশি আন্দোলন ও চেতনার ব্রতে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা (সূত্রধর, ৫০.০০) রচনা করেছিলেন, তা অলোক রায়ের বিস্তারিত ভূমিকা-সহ আবার সাধারণের গোচরে এল।

লোকসংস্কৃতি চর্চা-গবেষণা আর সরকারি পৃষ্ঠপোষণার গতিপ্রকৃতি ও তথ্যতালাশের ভিন্নধর্মী আলোচনা প্রদীপ ঘোষের লোকসংস্কৃতির বিপন্নতা ও অন্যান্য (প্রিটোনিয়া, ১৫০.০০) বইতে। চর্চার নিরিখে লালনের ধর্মতত্ত্ব, আলকাপ-সহ অন্য লোকনাট্য আলোচনা, উৎসব ইত্যাদির সঙ্গে এই সময়ে লোকসংস্কৃতির বিপন্নতা নিয়ে রাজ্যস্তরীয় সরকারি কেন্দ্র পরিচালনায় তাঁর অভিজ্ঞতা ও অভিমত তাৎপর্যবাহী।

আরও পড়ুন
Advertisement