পুস্তক পরিচয় ১

শিল্পরূপের খোঁজে আত্মপরিচয়ের কাহিনি

রূ পলাবণ্যের বহতা ধারা বাঙালি জীবনের ফেলে আসা দিনের সৌকর্যকে মোহময় করেছে। ধর্মীয় স্থাপত্য ও শিল্পকলার রূপকে রসিক খুঁটিয়ে দেখলে জীবনবোধের এক তন্ময় জগৎ গড়ে ওঠে। পুজোপাঠ, আরাধনা, নমাজ, প্রার্থনার ধর্মীয় অবগুণ্ঠন পেরিয়ে তা অন্যতর জগতের সন্ধান দেয়।

Advertisement
দীপঙ্কর ঘোষ
শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০০
বাংলার টেরাকোটা মন্দির: আখ্যান ও অলংকরণ, শ্রীলা বসু ও অভ্র বসু। সিগনেট প্রেস (একটি আনন্দ প্রকাশন), ৫০০.০০

বাংলার টেরাকোটা মন্দির: আখ্যান ও অলংকরণ, শ্রীলা বসু ও অভ্র বসু। সিগনেট প্রেস (একটি আনন্দ প্রকাশন), ৫০০.০০

রূ পলাবণ্যের বহতা ধারা বাঙালি জীবনের ফেলে আসা দিনের সৌকর্যকে মোহময় করেছে। ধর্মীয় স্থাপত্য ও শিল্পকলার রূপকে রসিক খুঁটিয়ে দেখলে জীবনবোধের এক তন্ময় জগৎ গড়ে ওঠে। পুজোপাঠ, আরাধনা, নমাজ, প্রার্থনার ধর্মীয় অবগুণ্ঠন পেরিয়ে তা অন্যতর জগতের সন্ধান দেয়। ঢাক, ঘণ্টার শব্দ, ধূপধুনো, আতরের গন্ধের মধ্যে যে অবলোকন, তা স্থাপত্য-অলংকরণ ও মূর্তিতত্ত্বের অন্তর-বাহির পরম্পরাকে ছুঁয়ে যায়। তাই পেরিয়ে আসা কয়েক শতকে বাঙালির মন্দিরশিল্প ভাবনায়, সমাজ-সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের হদিশও অনুভব করা যায়। শিল্পরূপের খোঁজে তৈরি হয় আত্মপরিচয়ের কাহিনি।

বছর কয়েক আগে, আমার কথার পিঠে উনিশ শতকের রামহরি সূত্রধরের কথা বলছিলেন তাঁরই এক আত্মজন। বর্ধমানের কালনা বা কাটোয়া এলাকার আদত বাসিন্দা, সেই রামহরির পোড়ামাটির মন্দির নির্মাণ কৌশল— ফলকের পর ফলকে ফুটিয়ে তোলা নৈপুণ্য ছিল দেখার মতো! মুগ্ধ বর্ধমানরাজের কাছ থেকে কী উপহার পেতে চান, তা শিল্পীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি চেয়েছিলেন হাতির পিঠে চেপে বাঁকুড়ার সোনামুখীতে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে যেতে। হতেই পারে এর কিছু হয়তো শ্রুতিবাহিত গল্পকথা। কিন্তু মন্দিরলিপির তথ্যে আছে, কালনার প্রতাপেশ্বর মন্দিরের এই নির্মাণশিল্পী তৈরি করেন সোনামুখীর শ্রীধর মন্দিরও। টেরাকোটা ফলকের প্রাচুর্যে এই দু’টি মন্দির সমৃদ্ধ শুধু নয়— শৈলী বিচারেও বিশিষ্ট। উনিশ শতকের শেষেও দক্ষ শিল্পীসমাজ সক্রিয় ছিল বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে— বিশেষ করে রাঢ়বঙ্গে। এ সব বলার অর্থ, ইটের তৈরি মন্দির আর খোদাই ফলকে সৃষ্ট কাহিনির যে রূপ, তা পোড়ামাটি বা টেরাকোটার পাল্টে যাওয়া কাঠিন্যের মধ্যে নতুন সূত্রের সন্ধান দেয়।

Advertisement

এই প্রক্রিয়ায় দৃশ্যায়িত হয়ে ওঠে শিল্পতত্ত্বের যুগধর্ম ও সমাজবিন্যাসের বহুস্তরীয় সীমানা। পুরাতত্ত্বের আঙিনাকে আরও প্রসারিত করে শ্রীলা বসুর লেখায় আর অভ্র বসুর আলোকচিত্রের সংযোগে গড়ে উঠেছে আলোচ্য বইটির বিষয়ভিত্তি। তাঁদের ক্ষেত্র-পরিক্রমণের যৌথ আগ্রহ ও মগ্নতাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। বাংলার অজস্র টেরাকোটা মন্দিরের অলংকৃত ফলকে পুরাণ, মহাকাব্য আর জীবন-বাস্তবতার উপাদানের আলেখ্য বর্ণনায় তাঁরা চর্চার কাঠামো আর পরিসর তৈরি করেছেন। এই নিরীক্ষায় টেরাকোটার শিল্পিত কাহিনি তৈরি হয়েছে। বাংলায় সতেরো থেকে উনিশ শতকে গড়ে ওঠা টেরাকোটা মন্দিরের বিষয়ে আট পর্বের বর্ণনায় প্রেক্ষাপট আলোচনা, মন্দিরের স্থপতি শিল্পীদের কথা আর মন্দির ফলকের অলংকৃত ভাস্কর্যের সৌষ্ঠব আঙ্গিকের ভিত্তিতে কৃষ্ণকথা, চৈতন্যকথা, রামকথা, দেবী ও অন্য পৌরাণিক বিষয় আলোচনার সঙ্গে আছে সমাজজীবনের নানা প্রসঙ্গ। মন্দির থেকে মন্দির ঘুরে দেখা আর পাঠতত্ত্বের মিলমিশে টেরাকোটা ভাস্কর্যের এক স্বতন্ত্র দিক উদ্ভাসিত হয়েছে। প্রত্নতত্ত্বের গূঢ় ছক এড়িয়ে, পোড়ামাটির শিল্পভাবনার কাহিনি আর দৃষ্টিভোগ্য শতাধিক আলোকচিত্রের যুগলবন্দিতে তৈরি সুমুদ্রিত সম্ভ্রান্ত এই প্রকাশনার লেখচিত্র।

ইতিহাসের যুগ-কাঠামোয় মধ্যযুগের শেষভাগ ছিল বাংলার টেরাকোটা মন্দির নির্মাণকালের অনুকূল সময়। চৈতন্য আন্দোলনের কীর্তনের সুরে বৈষ্ণবের ধারা আর টেরাকোটা মন্দিরের বিস্তার যেন বহুলাংশে একাত্ম হয়ে গেছে। ইটের মন্দিরের অজস্র রূপবৈচিত্র সারা বাংলা জুড়ে কমবেশি গড়ে উঠতে লাগল— কোনওটি রেখ রীতির, কোনও রত্ন রীতির আবার কোনওটি বাংলার কুটিরের মতোই চালা রীতির। অন্য ব্যতিক্রমী রীতিও এর মধ্যে তৈরি হল। এই সব রীতির প্রকাশ সার্বিক ভাবে নিশ্চয়ই শুধুমাত্র শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রকাশিত হয়নি। লেখকের বয়ানে— ‘মন্দির-শিল্পীরা লোকবৃত্ত থেকে উঠে এলেও মন্দিরের পৃষ্ঠপোষকদের ব্রাহ্মণ্য রুচি এখানে প্রাধান্য পেয়েছে।’ এরই মধ্যে সূত্রধর শিল্পীদের এলাকাভিত্তিক নিজস্ব কুশলতায় মন্দিরের ফলকে আখ্যানের বৈচিত্র তৈরি হয়েছে। এ সব বলতে গিয়ে রাসমঞ্চ, দোলমঞ্চ, তুলসীমঞ্চের প্রসঙ্গও এনেছেন লেখক। তবে মঠ বাংলাদেশের কোথাও কোথাও আজও পরিত্যক্ত হয়েও টিকে আছে। এ বঙ্গের পোড়ামাটির তুলসীমঞ্চের চারকোণ, ছয়কোণ এমনকী আটকোণ-বিশিষ্ট অলংকৃত রূপ কোনও কোনও অঞ্চলে মন্দির নামেই পরিচিত। সূত্রধরশিল্পীর ‘কাষ্ঠ-পাষাণ-মৃত্তিকা-চিত্র’-র উপাদানের বাইরে, কুম্ভকার জাতিগোষ্ঠীর কৃৎকৌশলের ক্ষুদ্রাকৃতি কাঠামোয় রাধাকৃষ্ণ, গৌর-নিতাই, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা ইত্যাদি অলংকরণে স্বতন্ত্র এই লোকশিল্পধারাও প্রাসঙ্গিক বৈচিত্রের দিক।

জীবনের প্রতি শিল্পীদের সংরাগ না থাকলে টেরাকোটার এই পরিমিতি প্রকাশ পেত না। বাংলার টেরাকোটা মন্দিরের স্থাপত্য-ভাস্কর্য বিষয়ে এতাবৎ অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেভিড ম্যাককাচ্চন, তারাপদ সাঁতরা প্রমুখ অনেকের কাজই প্রকাশিত। প্রত্নতত্ত্বের কাঠামোর মধ্যেই মূলত সে সবের বিস্তার। হিতেশরঞ্জন সান্যালের বিশ্লেষণ ছিল সমাজ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে মন্দির নির্মাণের প্রেক্ষিত। এখন বলাই যায়, স্বতন্ত্র পটভূমির প্রয়াস এই বইটি। কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য-কথা, কৃত্তিবাসের রামায়ণ, ভারতচন্দ্রের কাব্য, দাশরথি রায়ের পাঁচালি— এমন নানা কাব্য গাথার সঙ্গে মন্দির ফলক অলংকরণের সংযোগসূত্র তৈরি হয়েছে। তবে আলোচনায় বিষয়ভিত্তি উল্লেখে পর্বের অন্তর্ভুক্ত একাধিক উপ-শিরোনামায় বিভাগীকরণে সংহত বর্ণনায় ব্যাঘাত ঘটেছে। এ ছাড়া, বর্ণনা ও চিত্রের উল্লেখে ‘আলংগিরি’ পূর্ব ও পশ্চিম দুই মেদিনীপুরেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে— হবে পূর্ব; চিত্রের পরিচিতিতে হাওড়ার ‘ঝিকিরা’ হয়েছে ‘কিকিরা’; রাজবলহাট হুগলি জেলার বদলে হাওড়া বলা হয়েছে বা যোগেশচন্দ্র ‘পুরাকৃতি’ ভবন হয়েছে ‘পুরাকীর্তি’। এ সব হয়তো অনবধানবশত ত্রুটি, কিন্তু উল্লিখিত হয়নি অমিয়শঙ্কর চৌধুরীর ‘কৃত্তিবাস ও টেরাকোটা’ (শারদীয় দেশ, ১৪০৪) শীর্ষক প্রাসঙ্গিক লেখা। আর, সার্বিক আলোচনায় বাংলাদেশের প্রসঙ্গ কিছু এলেও, উত্তরবঙ্গের প্রসঙ্গ প্রায় ওঠেইনি বলা যায়। ঠিকই, বাংলার কোনও কোনও প্রান্তে বিরল এই ধারা— তবুও প্রেক্ষিত আলোচনাতে তার উল্লেখ জরুরি ছিল।

টেরাকোটা মন্দিরের এই অন্তর-কাহিনি পড়তে গিয়ে, অনাদরে পড়ে থাকা অজস্র ভাস্কর্যের দিকে মন চলে যায়। সত্যিই তো, মন্দিরগুলির সামগ্রিক ঐশ্বর্য দুই মলাটে ধরা প্রায় অসম্ভব। সার্বিক কোনও তালিকাও তৈরি হয়নি আজ পর্যন্ত। বিষ্ণুপুর, গুপ্তিপাড়া উল্লেখ্য প্রত্নক্ষেত্র হলেও, বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্বে আছে অন্য বহু মন্দিরক্ষেত্র। কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের উদ্যোগে গোনাগুনতি কয়েকটি মাত্র মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব হয়েছে। তাই বহু ক্ষেত্রে চলেছে ব্যক্তিগত বা সমষ্টির এক্তিয়ারে থাকা দেবালয়ের খেয়ালখুশির রক্ষণাবেক্ষণ। কোথাও মন্দিরের গায়ে পড়েছে সিমেন্টের ঝকঝকে আস্তরণ, কোথাও রঙের বাহারি প্রলেপ, আবার কোথাও বা মন্দিরের গর্ভগৃহ হয়ে উঠেছে জ্বালানি কাঠ আর গবাদি পশুর খাবারের মজুত ঘর। স্থাপত্য ও ভাস্কর্য রীতিতে গুরুত্বপূর্ণ নানা মন্দিরের ভোল নিয়মিত পাল্টে ফেলা হচ্ছে। মার্বেল পাথরে মোড়া হচ্ছে আপাদমস্তক। সংরক্ষণের নামে ‘অর্থের আবরণে’ মন্দির হয়ে যাচ্ছে বেঢপ। হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্য। মন্দির টেরাকোটার এই আখ্যান-চিত্র দেখতে দেখতে তাই শঙ্কাও জাগে। বাংলার নিজস্ব টেরাকোটা শৈলীর কাব্যগাথা কি আঁধারে ঢেকে যাবে দ্রুত লয়েই!

আরও পড়ুন
Advertisement