জেনেছি, হিন্দুদের উৎসবও আমার পরব। তাই আমিও দুর্গাপুজো উপভোগ করি।
টানা প্রায় ৩০ ঘন্টা জেগে আছি। দুর্গাপুজোর বোধন থেকে ষষ্ঠীর আগমন, সব একে একে এল। বিদায়ও নিল। দেখতে দেখতে দুয়ারে পা রাখল সপ্তমী। আজ নবপত্রিকা স্নান। অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন, গাজী আব্দূন নূর কী ভাবে এত খুঁটিয়ে জানল! আমি কিন্তু ওপার বাংলাতেও পড়াশোনা এবং অভিনয় সূত্রে কয়েকটা বছর কাটিয়েছি। তা ছাড়া, জানবাজারে জমিদার রাজচন্দ্র দাসের বাড়িতে এখনও দুর্গাপুজো হয়। ভুলে গেলেন! আমি এক সময় সেই দাপুটে জমিদারের চরিত্রেই অভিনয় করেছি। তাই খুব কাছ থেকে দেখেছি দেবী আরাধনা। অধুনা বাংলাদেশেও জমজমাট পুজোর আয়োজন। ছোট থেকে এ সব দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। জেনেছি, হিন্দুদের উৎসবও আমার পরব। তাই আমিও দুর্গাপুজো উপভোগ করি।
টানা এত ঘণ্টা জেগে কাটানো যদিও পুজোর কারণে নয়। ষষ্ঠীর সকাল থেকে আমি আচমকাই জমিদার রাজচন্দ্র দাস! আমার পারিবারিক জমি এবং মাছের ভেড়ি দেখাশোনার খাতিরে। সব কাজ মিটিয়ে যশোহরে যখন ফিরলাম আকাশে গোধূলির রং ধরেছে। তার পরেই অন্ধকারের ঘোমটা টেনে দেখি ধীর পায়ে সন্ধে হাজির! সবে একটু জিরবো বলে ভাবছি, দীপংকর দাস রতনদার(সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ) ফোন। আমি যশোহরে। অতএব সবার সঙ্গে ঠাকুর দেখতেই হবে। শোনার পরেই মাথায় দুটো চিন্তা এল। এক, ঘুমটা আরও কয়েক ঘণ্টা পিছিয়ে যাবে। দুই, কলকাতার পুজো থেকে দূরে থাকার মনখারাপ মিলিয়ে যাবে। এবং অনুরোধ রাখা যাবে আনন্দবাজার অনলাইনেরও। প্রথম সারির ওয়েবসাইটের পক্ষ থেকে আন্তরিক অনুরোধ জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের পুজো নিয়ে কলম ধরতে হবে।
কলকাতার পুজোর সঙ্গে বাংলাদেশের পুজোয় মিলের চেয়ে অমিলটাই বেশি। কলকাতায় আলোর চমক, থিম পুজোর জাঁক। বাংলাদেশে সাবেকিয়ানা, আন্তরিকতা বেশি। প্রথমেই বলব যশোহরের রামকৃষ্ণ মিশনের পুজোর কথা। প্রাঙ্গনে বেলুড় মঠের অদ্ভুত গন্ধ। আশ্রমের ডানদিকে অধ্যক্ষ স্বামী জ্ঞানপ্রকাশানন্দজি মহারাজের অফিস ঘর। পা রাখতেই এক গাল হেসে কাছে টেনে নিলেন। যেন তিনি আমার কত দিনের চেনা! যদিও আমাদের সাক্ষাৎ এই প্রথম। ওঁর-ও সেই ‘রাজচন্দ্র’ সম্বোধন! আমার সেই আগের গোঁফ-দাড়ি নেই। মুখোশে মুখ ঢাকা। তবু চোখ দেখেই চিনতে পারলেন।
১৯৩৬ সালে যশোহরের রেল স্টেশনের খুব কাছে নিরিবিলি এক জায়গা। সেখানেই এক একর ৫৫ শতক জমিতে প্রতিষ্ঠিত এই শ্রী রামকৃষ্ণ আশ্রম। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মঠের শান্তি নষ্ট হয়েছিল। স্বামী সুধানন্দজি মহারাজ অক্লান্ত পরিশ্রম করে সাধ্য অনুযায়ী মঠের সংস্কার করেন। ২০১২ সালের ৪ জুন বাংলাদেশের রামকৃষ্ণ মিশন ও রামকৃষ্ণ মঠ বেলুড়ের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে যশোহর রামকৃষ্ণ আশ্রমটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত আসেন। দুর্গোৎসবে মানুষের ঢল নামে।
সারা দিনের খাটনি। আমার পেটে ছুঁচো ডন দিচ্ছে। মহারাজ কী করে বুঝতে পেরেছিলেন! আদর করে বসিয়ে পেট ভরে মিষ্টি খাওয়ালেন। চায়ের প্রতি আগ্রহ না দেখেই বুঝলেন আমি কফিপ্রেমী। সেটিও বাদ গেল না। সারাক্ষণ মুগ্ধ করে রাখলেন দুর্গা উৎসবের প্রকৃতি, প্রতিমা পূজার বর্ণনা শুনিয়ে। তার পর নিজে ঘুরিয়ে দেখালেন দেবী প্রতিমা। চলে আসার আগে মহারাজ বলে উঠলেন, ‘‘আমরা সবাই এক। তুমি, আমি আলাদা কেউ না।’’ সত্যিই তো তাই! আজকাল প্রয়োজনবোধে আমরা সবাই হিন্দু-মুসলিম। যদিও বন্ধুত্ব, সম্পর্ক, ভাললাগা, ভালবাসা, শ্রদ্ধা ধর্ম মানে না।
যশোহর বেলুড় মঠ থেকে বেরিয়ে গন্তব্য আরও একটি সাবেকি পুজো মন্ডপ। সেখানে অল্প আলোর রোশনাই। কিন্তু পুজোর ইতিহাস অনেক পুরনো। যশোহরের রাজা ছিলেন শ্রীহরি বিক্রমাদিত্য। সেই সময়ে নির্মিত দশমহাবিদ্যা মন্দির, চাঁচড়া। যদিও এখন তা ধ্বংসাবশেষ। সেই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের সামনে মণ্ডপ। তাতে হুবহু মায়ের আদলে গড়া দেবীমুখ!
মনে পড়ল, কলকাতাতেও এই সাবেকিয়া একটা সময় ছিল। এখন সবই অতীত, ঝাপসা। সবেতেই যেন বাণিজ্যি বাণিজ্য গন্ধ। তবে ভাল লাগে থিমের ভাবনা। আমি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই মণ্ডপ ঘুরে থিম বোঝার চেষ্টা করতাম। অভিনয়ে আসার পর মুখ ঢেকে অথবা অনেক রাতে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরেছি। আমদের একটা বড় দল ছিল। দেখুন, কী অদ্ভুত ব্যাপার। স্মৃতির উপরের স্মৃতি জমেছে। তবু মরচে ধরেনি! রতনদা এবং অ্যাডভোকেট প্রশান্ত দেবনাথদা দুটো বাইক নিয়ে আসতেই মনে মনে আমার কলকাতা সফর শেষ। ওঁদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম, কোভিড সত্যিই উৎসবের জৌলুষ ফিকে করে দিয়েছে। আনন্দ যেন ভয়ের আবহে মুখ লুকিয়ে।
যশোহরে অনেকদিন বসবাস নেই। তাই অনেক কিছুই চিনে উঠতে পারিনি প্রথমে। শহরের প্যারিস রোড ধরে আমি আমার ছোট ভাই স্বপন বিশ্বাস হাঁটছি তো হাঁটছি। হঠাৎ জিলিপির গন্ধে মন আনচান। পুজোয় আবার ডায়েট কি? খুশি মনে কামড় রসে ভরা জিলিপিতে। খাওয়া শেষের আগেই কলকাতা থেকে ফোন! বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই পুরনো বান্ধবী এক সঙ্গে ভিডিও কলে! পুজোয় তারা নাকি বড্ড মিস করছে আমায়। তার পর কথার পিঠে কত কথা। ওরা কত অনায়াসে কত কিছু বলে গেল। আমি কিছুতেই বলতে পারলাম না, কলকাতাকে কখনও ভুলে থাকা যায়! জানি, আমি না চাইলেও আজও সেখানে কেউ আমায় খোঁজে। আমার না থাকার শূন্যতা হয়তো তাকে গ্রাস করে। আমি কাউকে কিচ্ছু বলি না। চুপ করে থাকি। একেবারে নিশ্চুপ নীরবতা।
নীরব প্রতীক্ষায় শুধুই দিন গুনি আমি......