তালিবান যোদ্ধার অস্ত্র নজর কেড়েছে খুদেরও। কাবুলে। ছবি: রয়টার্স
আমেরিকান সেনা ফিরে এল আফগানিস্তান থেকে। হাজার ছয়েক তরুণ-তরুণীর মা-বাবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। দীর্ঘ দু’দশক ধরে দফায় দফায় সে দেশে থেকেছেন অসংখ্য আমেরিকান সেনা। তাঁদের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার আফগানিস্তানে কর্মরত অবস্থায় সংঘর্ষ বা জঙ্গি হানায় নিহত হয়েছেন। যার সাম্প্রতিকতম ঘটনা, ২৬ অগস্ট কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ১৩ জন তরতাজা আমেরিকানের মৃত্যু।
ধ্বংসের এই আঁচে ঝলসাচ্ছে আমাদের খুব কাছের পৃথিবীও। আমাদের প্রতিবেশী লরেন্স নামের শহরটিতে মূলত গরিব এবং কৃষ্ণাঙ্গ বা মেক্সিকান বংশোদ্ভূত মানুষের বাস। এমনই এক পরিবারের মেয়ে ইয়োহানি রোজ়ারিয়ো। ১৮ বছর বয়সে যোগ দিয়েছিল মেরিন কোরে। মা আর বোনের সে-ই ছিল একমাত্র সহায়। শুধু নিজের নয়, এলাকার অনেক স্কুল পড়ুয়ার কাছেই সে ছিল ‘রোল মডেল’। বৃহস্পতিবারের সেই দুপুরে কাবুল বিমানবন্দরে মহিলা ও শিশুদের সঙ্গে কাজ করছিল ইয়োহানি। তার পরে কফিনবন্দি হয়ে ফিরে এল লরেন্সের সেই প্রিয় কন্যা। যুদ্ধ প্রাণ নেয় কাদের?
রোজ়ারিয়ো-র সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে আর এক ‘রোল মডেলের’ কথা। ২০১৮ সালে দেশের মুখ উজ্জ্বল করে আবির্ভাব হয়েছিল এই মেয়েটির। নাম— শামসিয়া আলিজ়াদা। কয়লাখনিতে কাজ করেন তার বাবা, শুধু মেধা আর পরিশ্রমের জোরে আফগানিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার দু’লক্ষ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে প্রথম হয়েছিল শামসিয়া। শুধু অতি সাধারণ আর্থিক অবস্থার লড়াই তাকে রাতারাতি ‘নায়ক’ বানায়নি, আরও বিপদসঙ্কুল পথ পেরিয়ে এসেছিল সে। মৌদাদ একাডেমির ছাত্রী থাকাকালীন, সেখানে আইএস আত্মঘাতী জঙ্গির হামলায় ৪০ জন নিহত হয়। যাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছাত্রছাত্রী। প্রাণে বেঁচে গেলেও এই প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে কিছু দিনের জন্য পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছিল কিশোরী শামসিয়া। পরে, শিক্ষিকাদের উৎসাহে, আবার ফিরে আসে পড়াশোনার জগতে।
তালিবান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে, ২০০১ থেকে ২০২১, এই কুড়ি বছরে আফগান মেয়েদের একটা প্রজন্ম বড় হয়েছে শিক্ষিত হয়ে, সাবলম্বী হয়ে, নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নেওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে। অনেকের, বিশেষত শহরের মেয়েদের ক্ষেত্রে, সেই স্বপ্ন সফলও হয়েছে। তাঁরা স্কুল চালিয়েছেন, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন, ছিলেন প্রশাসনিক নানা গুরুত্বপূর্ণ পদেও। ২০০১ সালের পরে তালিবানমুক্ত দেশে শিক্ষার অধিকার ফিরে পাওয়ার পরে আফগান মেয়েদের একটা বড় অংশ হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল দেশটাকে নতুন ভাবে গড়ে তোলার জন্য। শিক্ষায়, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে, বিচারব্যবস্থায়— সব ক্ষেত্রেই তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল। ফলে শামসিয়ার মতো অনেকে মানসিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল, ঠিক ফিনিক্স পাখির মতো। এখন কোথায় আছে শামসিয়া? পালাতে কি পেরেছে, পালাতে কি চেয়েছিল, দেশ থেকে? উত্তর খুঁজছি গত কয়েক দিন ধরে, খবরের কাগজের পাতায়, টিভির পর্দায়। জানতে পারিনি এখনও।
আমি যে ‘মিডল স্কুলে’ পড়াই সেখানে ‘আমি মালালা’ বইটি পাঠ্য। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বসবাস করলেও মালালার পরিবার, বন্ধু, স্কুল, রোজকার জীবনের খুঁটিনাটি সমস্ত কিছুই আমার ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের সহজ ভাবে গ্রহণ করতে দেখেছি। মেয়েদের শিক্ষার অধিকার থেকে এ ভাবে বঞ্চিত করার চেষ্টা তাদের বিচলিত করে। অনেকেই আমাকে বলেছে, প্রাপ্তবয়স্ক মালালাকে তারা নিজেদের শিক্ষক হিসেবে দেখতে চায়।
এ বার ভাবছি ‘আমি মালালা’ পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে তাদের বলব শামসিয়ার কথা, ইয়োহানির গল্পও। সেই সব মেয়ের আত্মবিশ্বাসের ইমারতে বুনিয়াদ তৈরি হোক আমার ক্লাসঘরের পড়ুয়াদেরও।
লেখক শিক্ষাকর্মী