সম্পর্ক শীতল তৃণমূল-মোর্চার

ভোটের উত্তাপ যত বাড়ছে, আপাতত ততই শীতল হচ্ছে তৃণমূল ও গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সম্পর্ক। ভাইচুং ভুটিয়াকে প্রার্থী করায় মোর্চা বৃহস্পতিবার তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তুলেছিল। শুক্রবার তৃণমূল নেতৃত্ব জানিয়ে দিল, সহমতের ভিত্তিতে প্রার্থী ঠিক করার জন্য খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই একাধিকবার মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গকে ফোন করেছিলেন।

Advertisement

কিশোর সাহা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৪ ০৩:৫০
Share:

দার্জিলিঙে সাংবাদিক বৈঠকে দলীয় নেতারই ক্ষোভের মুখে তৃণমূল প্রার্থী ভাইচুং ভুটিয়া। বাঁ দিকে তাঁর বিরুদ্ধে সরব তৃণমূল নেতা রাজেন তামাঙ্গ। শুক্রবার ছবিটি তুলেছেন রবিন রাই।

ভোটের উত্তাপ যত বাড়ছে, আপাতত ততই শীতল হচ্ছে তৃণমূল ও গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সম্পর্ক।

Advertisement

ভাইচুং ভুটিয়াকে প্রার্থী করায় মোর্চা বৃহস্পতিবার তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তুলেছিল। শুক্রবার তৃণমূল নেতৃত্ব জানিয়ে দিল, সহমতের ভিত্তিতে প্রার্থী ঠিক করার জন্য খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই একাধিকবার মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গকে ফোন করেছিলেন। গুরুঙ্গকে বেশ কয়েক বার ফোন করেছিলেন দলের সবর্ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ও। মোর্চাই বরং অসহযোগিতা করেছে। তাই বাধ্য হয়েই তৃণমূলকে প্রার্থী ঘোষণা করে দিতে হয়। এখন মোর্চা বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তোলায় তাই ক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতৃত্ব।

তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা জানান, মোর্চার সঙ্গে সহমতের ভিত্তিতেই পাহাড়ের প্রার্থী ঠিক করতে চেয়েছিলেন দলনেত্রী। যে কারণে মোর্চা কাকে প্রার্থী করতে চায়, তা জানতে একাধিকবার গুরুঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু প্রতিবারেই তা নিয়ে আলোচনার জন্য সময় চাওয়া হয়েছে। তাই শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই তৃণমূল দার্জিলিং আসনের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। মুকুলবাবু বলেন, “এটুকু বলতে পারি, আমাদের দলনেত্রীই মানুষের বিশ্বাসকে সব থেকে বেশি মর্যাদা দেন। কাজেই বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ তোলাটা একেবারেই ঠিক নয়।”

Advertisement

তৃণমূল নেত্রীর ক্ষোভ-অসন্তোষের বার্তা পৌঁছেছে গুরুঙ্গের কাছেও। তবে মুখ্যমন্ত্রী ও মুকুলবাবু পাঁচ দফায় ফোন করে প্রার্থীর নাম ঠিক করার কথা বললেও, কেন সেই আলোচনা এগোয়নি, সেই প্রশ্নে মোর্চা নেতারা কেউই মন্তব্য করতে চাননি। এমনকী, তৃণমূলের ক্ষোভের ব্যাপারেও কোনও মন্তব্য করতে চাননি মোর্চা নেতারা। মোর্চার অন্দরের খবর, তৃণমূলের সঙ্গে সমঝোতার রাস্তা খোলা রাখতে চাইছেন গুরুঙ্গ। সে জন্য ভাইচুংকে সরিয়ে অন্য কাউকে প্রার্থী করা হলে সমঝোতা হতে পারে বলেও মোর্চার একাংশের পক্ষ থেকে তৃণমূলের কাছে বার্তা দেওয়া হয়েছে। তাঁরা জিটিএ ভোটের উদাহরণও দিচ্ছেন। সেখানে প্রার্থী দিয়েও পরে প্রত্যাহার করে নেয় তৃণমূল। কিন্তু লোকসভা ভোটের প্রেক্ষাপট অনেক বড়। তাই সরকারি ভাবে মোর্চার কাছ থেকে এই প্রস্তাব এলে তৃণমূল নেতৃত্ব কী করবে, তা নিয়ে মোর্চার কেউই নিশ্চিত নন। যদিও মোর্চা নেতারা বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চাননি। বরং মোর্চার প্রচার সচিব হরকাবাহাদুর ছেত্রী এ দিন বলেছেন, “রাজ্যসভার ভোটে তো আমরা সহমতের ভিত্তিতেই চলেছি। লোকসভাতেও তা-ই হওয়া উচিত। তা হলে পারস্পরিক বিশ্বাস আরও মজবুত হতে পারে।”

বস্তুত, দার্জিলিং লোকসভা আসনের প্রার্থী বরাবর পাহাড়ের প্রধান শাসক দলই ঠিক করে থাকে। সুবাস ঘিসিঙ্গ থেকে বিমল গুরুঙ্গ, সেই ট্র্যাডিশনই চলছে। ভোটের তথ্যও বলছে, পাহাড়ের প্রধান শাসক দল যে প্রার্থীকে সমর্থন করে, তিনিই দার্জিলিং আসনে জেতেন। গত লোকসভা ভোটেও মোর্চা সমর্থিত বিজেপি প্রার্থী যশোবন্ত সিংহ বিপুল ভোটে সিপিএম প্রার্থীকে হারিয়ে দেন।

এ বারও পাহাড়ের একমাত্র লোকসভা আসনটি হাতছাড়া করতে নারাজ মোর্চা। কিন্তু তৃণমূল ভাইচুংয়ের নাম ঘোষণা করায় পাহাড়ে তাঁদের একাধিপত্য কিছুটা হলেও যে খর্ব হয়েছে, তা মোর্চা নেতারা অনেকেই কবুল করেছেন। মোর্চার এক নেতা জানান, বিজেপি-র সঙ্গে আলোচনা চললেও রাজ্যের শাসক দলের বিরাগভাজন হওয়ার পক্ষপাতী নন তাঁরা। সে জন্যই তেলঙ্গানা গঠনের পরেও মোর্চার তরফে কখনও রাজ্যের বিরুদ্ধে সে ভাবে তাঁরা সরব হননি। কিন্তু তার পরে তৃণমূল একতরফা ভাবে প্রার্থী দিয়ে দেওয়ায় তাঁরা দলের অন্দরে সমালোচনার মুখে পড়েছেন।

কিন্তু মোর্চা ভোটের দিন ঘোষণার তিন দিন পরেও প্রার্থী হিসেবে একটি নামও ঠিক করতে পারেনি কেন?

দলের কয়েক জন নেতার দাবি, প্রার্থী হিসেবে প্রথমে পাহাড়ের জনজাতি সম্প্রদায়ের কোনও প্রতিনিধি রাখার ব্যাপারে আলোচনা হয়। পরে দার্জিলিঙের এক সাংবাদিকের নামও আলোচনায় ওঠে। ইতিমধ্যে ভাইচুংকে প্রার্থী করায় মোর্চা নেতারা প্রথমে বিজেপি-র এক প্রাক্তন মন্ত্রীর নাম নিয়েও আলোচনা করেন। কিন্তু কোনও আলোচনাই চূড়ান্ত হয়নি। মোর্চা সূত্রে খবর, সম্প্রতি দার্জিলিঙের বাসিন্দা এক জন এভারেস্ট বিজয়ীর নাম নিয়েও দলে আলোচনা হচ্ছে। তবে কোনও ভাবে তৃণমূলের সঙ্গে সহমতের রাস্তা খুঁজে পেলে সমস্যা কেটে যাবে বলে মোর্চা নেতাদের একাংশ এখনও আশাবাদী। মোর্চার অন্য পক্ষ অবশ্য দার্জিলিং তো বটেই, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারেও নেপালি অধ্যুষিত এলাকায় দলের প্রভাব বোঝাতে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যাওয়ার উপরে জোর দিচ্ছে।

২০১২ সালের জানুয়ারিতে দার্জিলিঙের ম্যালের সভার পরে মোর্চা-তৃণমূলের সম্পর্ক খাদের কিনারায় চলে যায়। কিছু দিন আগে দু-তরফে ফের কাছাকাছি আসে। এ বার মান-অভিমান, ক্ষোভ-বিক্ষোভ মিটবে, নাকি সম্পর্ক হিমশীতল হবে তা সময়ই বলবে।

বিতর্কে ভাইচুং

প্রার্থী হওয়ার পরে প্রথম দার্জিলিং সফরে গিয়ে তৃণমূলের অন্দরেই সমালোচনার মুখে পড়লেন ভাইচুং ভুটিয়া। শুক্রবার সকালে দার্জিলিং ট্যুরিস্ট লজে সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে ভাইচুং জানান, “দু’দলের এক সঙ্গে ভোটে লড়া উচিত। তৃণমূলের সকলেই মোর্চার সমর্থন চান।” তৃণমূলের দার্জিলিং জেলা কমিটির সহ সভাপতি রাজেন তামাঙ্গ তখন চিৎকার করে বলেন, “এটা ঠিক নয়। পাহাড়ে তৃণমূল একাই লড়বে।” উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব সকলকে শান্ত করেন। পরে ভাইচুংকে বলতে শোনা যায়, “ওরা (মোর্চা) সমর্থন করলে ভাল, না হলে আমরা একাই লড়ব এবং জিতব।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement