গত তিন বছরে রাজ্যের আয় বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু পাল্লা দিয়ে কমেছে নিজস্ব কর আদায় বৃদ্ধির হার। ফলে চলতি আর্থিক বছরের গোড়ায় যে পরিমাণ টাকা রাজকোষে পড়ার আশা করেছিলেন অর্থ দফতরের কর্তারা, তার থেকে বেশ দূরেই দৌড় শেষ করতে হবে বলে আশঙ্কা নবান্নের একাংশের।
সরকারি তথ্য বলছে, ২০১২-’১৩ সালে যেখানে কর আদায় বৃদ্ধির হার ছিল ৩১.৫৬ শতাংশ, গত অর্থবর্ষে সেটাই এক ধাক্কায় নেমে যায় ৯.২১ শতাংশে। চলতি আর্থিক বছর শেষ হতে এখনও দু’মাস বাকি থাকলেও নবান্নের খবর, ডিসেম্বর পর্যন্ত যে পরিমাণ কর আদায় হয়েছে তার বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশও পেরোয়নি।
আর এখানেই অশনি সঙ্কেত দেখছেন প্রশাসনের কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, রাজকোষ ভরাতে টাকার অঙ্কে রাজস্ব আদায়ের চেয়ে কর আদায় বৃদ্ধির হারের বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কর আদায়ে বৃদ্ধির হার কমে গেলে সরকারের আয়ের উপরে তার সরাসরি প্রভাব পড়ে। কেন? অর্থ দফতরের কর্তারা বলছেন, কর বৃদ্ধির হারের উপরেই রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্য নির্ভর করে। সেই হার যদি ঊর্ধ্বমুখী হয় তবেই রাজস্ব আদায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। কিন্তু তা নিম্নমুখী হলে বছর শেষে রাজস্বের পরিমাণ বাড়বে ঠিকই, কিন্তু যে পরিমাণ বৃদ্ধি হওয়া উচিত তা হবে না। উল্টে উপার্জনের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ক্রমেই পিছিয়ে পড়বে সরকার।
কেন্দ্রীয় বাজেটের আগে রাজ্য বাজেট পেশ করার উদ্যোগের সূত্র ধরে বিরোধীরাও এখন রাজকোষের বহর কমার আশঙ্কা করছেন। তাঁদের অনেকেরই ধারণা, অর্থ দফতর হয়তো লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে পারেনি। তাই চলতি অর্থবর্ষ শেষ হওয়ার এক মাস আগেই বাজেট করতে চাইছেন।
অর্থ দফতরের কর্তাদের ব্যাখ্যা, করের হার বৃদ্ধি মানে যেমন রাজ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য ভাল চলছে বোঝায়, তেমনই বছরভর কর আদায়ের কাজ ভাল হওয়ারও ইঙ্গিত দেয়। উল্টো হলে দু’টো ক্ষেত্রই আলগা হয়েছে বুঝতে হবে। তাঁদের বক্তব্য, ফি বছর নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করে কর বসিয়ে বা পুরনো ক্ষেত্রে কর বাড়িয়ে সরকার কোষাগার ভরাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজ্যের বর্তমান আর্থিক পরিকাঠামোতে সেই পথও কার্যত বন্ধ। কেন? অর্থ দফতরের এক কর্তা বলেন, মূলত কৃষি থেকে আদায় হওয়া কর, সম্পত্তি কেনাবেচা ও হস্তান্তর, খাজনা, স্ট্যাম্প ডিউটি ও রেজিস্ট্রেশন ফি, পরিষেবা, নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর উপরে কর এবং প্রমোদ কর থেকে মোটা রাজস্ব আদায় করে এ রাজ্যের সরকার। এ ছাড়া গত তিন বছরে মদ ও নেশার সামগ্রী-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে পরিমাণ কর (ভ্যাট) বেড়েছে তা শুধু বেশি-ই নয়, কার্যত সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে। ফলে কর আদায়ের নতুন ক্ষেত্র খোঁজা ছাড়া বিকল্প নেই।
নবান্নের খবর, এই পরিস্থিতি যে তৈরি হবে তা আঁচ করে বছরখানেক আগে খাদ্যপণ্যে কর বসানোর প্রস্তাব দিয়েছিল অর্থ দফতর। অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু-সহ বেশ কিছু রাজ্য ওই কর থেকে মোটা রাজস্ব আদায় করে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তা করাই যায়নি। অর্থ দফতরের এই প্রস্তাবটিই খারিজ করে দেয় নবান্নের শীর্ষমহল।
তা হলে উপায়? এ ক্ষেত্রেও অর্থ দফতরের অফিসারেরা সেই উৎপাদন শিল্পের কথাই বলেছেন। তাঁদের বক্তব্য, বর্তমানে রাজ্য সরকার যে নিজস্ব কর (স্টেটস ওন ট্যাক্স) আদায় করে, তা মূলত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। সেই ক্ষেত্রও ক্রমে সঙ্কুচিত হচ্ছে। রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ, বিশেষ করে বড় ও মাঝারি মানের ব্যবসায়ীরা বেশ হতাশ। নতুন ব্যবসা খোলার ক্ষেত্রে অনীহা দেখা দেওয়ায় পাল্লা দিয়ে কমছে কর বৃদ্ধির হার। এ ছাড়া, প্রবেশ কর নিয়ে মামলা চলায় অনেক ব্যবসায়ী তা দিতে অস্বীকার করছেন বলে অর্থ দফতর সূত্রের খবর। প্রাক-বাজেট বৈঠকে ব্যবসায়ীরা অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের কাছে এই কর তুলে দেওয়ার আবেদনও জানিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যে উৎপাদন শিল্প না বাড়লে কর বৃদ্ধির হারও খুব একটা বাড়বে না বলেই মনে করছেন অর্থ দফতরের ওই কর্তারা। তাঁদের যুক্তি, উৎপাদন শিল্প যত বাড়বে, ততই কর আদায়ের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে। বড় শিল্পকে ঘিরে যত বেশি মাঝারি ও ছোট শিল্প গড়ে উঠবে, তাতে কর আদায়ের হারও বাড়বে তরতর করে।
কিন্তু সরকারের জমি-নীতির কারণে সেই সম্ভাবনাও পাটে যেতে বসেছে বলে দাবি শিল্পমহলের। তাঁদের বক্তব্য, জমি প্রশ্নে রাজ্যের অবস্থানই উৎপাদন শিল্পে লগ্নি-খরার অন্যতম কারণ। রাজ্যে বড় শিল্পের জন্য এক লপ্তে জমি পাওয়া কঠিন। সরকারের যে ‘জমি ব্যাঙ্ক’ আছে বলে বারেবারেই জানাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী, তার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ্যে আসেনি। একই ভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গঠনেও সরকারের জমি-নীতি অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে মত নবান্নের একাধিক কর্তার। তাঁদের বক্তব্য, সরকার নিজে জমি নেবে না বলে জেলায় জেলায় শিল্প-পার্ক তৈরির ভার ছেড়েছে ব্যক্তি উদ্যোগের উপরে। দু-দু’বার বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছে, কোনও ব্যক্তি বা বাণিজ্যিক সংস্থা নিজেদের উদ্যোগে কমপক্ষে ২০ একর জমি কিনে সেটিকে শিল্প-পার্কে রূপান্তরের জন্য আবেদন জানালে সরকার নিজের খরচে প্রয়োজনীয় সমস্ত পরিকাঠামো গড়ে দেবে। কিন্তু তার পরেও এক জন শিল্পোদ্যোগীও ওই আহ্বানে সাড়া দেননি।
এই পরিস্থিতিতে আগামী দিনে কী ভাবে বাড়বে কর বৃদ্ধির হার, কী ভাবেই বা বাড়বে সন্তোষজনক পরিমাণে রাজস্ব, তা নিয়েই সংশয়ে অর্থ দফতর।