রাজ্যপালের সঙ্গে আলোচনার পরে সাংবাদিক বৈঠকে পাঁচ অধ্যাপক অমিতা চট্টোপাধ্যায়, যশোধরা বাগচি, সুকান্ত চৌধুরী, অশোক নাথ বসু, আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র
সার্চ কমিটি তালিকা দিয়েছে ঠিকই। তবে সেই তালিকায় বিভিন্ন জনের নাম আগে-পরে যে-ভাবেই দেওয়া থাক, সেটার উপরে তত নির্ভর না-করতে আচার্য-রাজ্যপালকে অনুরোধ করলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ জন এমেরিটাস অধ্যাপক। তাঁদের আবেদন, যাদবপুরে স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগে আচার্য নিজের বিবেচনা প্রয়োগ করুন। বর্তমান সরকারের আমলেই যে এমন নজির রয়েছে, আচার্যকে তা-ও জানিয়েছেন তাঁরা।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীর কার্যকাল শেষ হওয়ার কথা আগামী মাসের শেষে। স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটির তৈরি তিন জনের প্যানেল এখন রাজভবনে। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, অভিজিৎবাবুর নামই সেই তালিকার শীর্ষে আছে। স্থায়ী উপাচার্য হিসেবে তাঁকেই যে রাজ্য সরকারের পছন্দ, প্রকারান্তরে তা-ও বুঝিয়ে দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। এই পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার দুপুরে রাজভবনে গিয়ে যাদবপুরের পাঁচ প্রবীণ শিক্ষক রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন সার্চ কমিটির তালিকাভুক্ত তিন জনের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে কথা বলেই নিজের পছন্দ চূড়ান্ত করেন।
যাদবপুরে পুলিশের হাতে ছাত্র-নিগ্রহ এবং তাতে উপাচার্যের ভূমিকা নিয়ে বিতর্কের আবহেই এ দিন রাজভবনে যান ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসু, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অমিতা চট্টোপাধ্যায়, অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী ও যশোধরা বাগচী। এঁদের সকলেই এখন যাদবপুরের এমেরিটাস অধ্যাপক।
রাজভবন থেকে বেরিয়ে ওই অধ্যাপকেরা সাংবাদিক বৈঠক করেন। জানান, রাজ্যপালের সঙ্গে তাঁদের প্রায় ৪৫ মিনিট কথা হয়েছে। যাদবপুরে পঠনপাঠন, গবেষণা ও প্রশাসন সংক্রান্ত বেশ কিছু সমস্যার দিকে রাজ্যপালের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন তাঁরা। ছুঁয়ে গিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি এবং স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের বিষয়টিও। অশোকনাথবাবু বলেন, “কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব অত্যন্ত জরুরি বিষয়। আমরা শুনেছি, যাদবপুরে উপাচার্য বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে। সার্চ কমিটির প্রস্তাবিত প্যানেলে যে-তিন জনের নাম আছে, তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে কথা বলার আর্জি জানিয়েছি আচার্যকে।” নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা কার কেমন, প্যানেলে নাম থাকা তিন জনের সঙ্গে কথা বলে আচার্য-রাজ্যপাল সেটা যাচাই করে নিন এটাই তাঁরা চান বলে জানান প্রবীণ অধ্যাপকেরা।
রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বর্তমান আইন অনুযায়ী সার্চ কমিটিকে তাদের পছন্দের ক্রম অনুসারে তিন জনের নাম পাঠাতে হয় আচার্যের কাছে। কিন্তু রাজ্যপাল যে কমিটির প্রথম পছন্দের নামটিই বেছে নেবেন, এমন বাধ্যবাধকতা নেই ওই আইনে। বরং সার্চ কমিটির তালিকার ক্রম না-মেনে নিজের বিবেচনা অনুযায়ী এক জনকে উপাচার্য-পদের দায়িত্ব দেওয়ার অন্তত দু’টি নজির সাম্প্রতিক অতীতে রয়েছে। দু’টিই বর্তমান সরকারের আমলে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সার্চ কমিটির প্রথম পছন্দ ছিলেন ইংরেজির শিক্ষক চিন্ময় গুহ। কিন্তু রাজভবন শেষ পর্যন্ত সিলমোহর দেয় সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরীর নামে। পরের নজিরটি বেসু (এখনকার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং, সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বা আইআইইএসটি)-তে। সেখানে সার্চ কমিটির বাছাই-তালিকার প্রথমে না-থাকা সত্ত্বেও অজয় রায়কেই উপাচার্য নিয়োগ করেছিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল। রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, আচার্য-রাজ্যপাল রবীন্দ্রভারতীর ক্ষেত্রে সরকারের মনোভাবকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, কিন্তু বেসু-র ক্ষেত্রে তা করেননি।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ে এখনই সতর্ক না-হলে ভবিষ্যতে পঠনপাঠন ও গবেষণার মান ধরে রাখা কঠিন হবে বলে ওই প্রবীণ অধ্যাপকেরা মনে করেন। ঠিক কোন কোন বিষয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন, রাজ্যপালকে লিখিত ভাবে তা-ও জানিয়ে দিয়েছেন পাঁচ অধ্যাপক। সাংবাদিক বৈঠকে সুকান্তবাবু বলেন, “এত দিন যাদবপুরে শিক্ষকতা করেছি স্বাধীন ভাবে, আনন্দের সঙ্গে। অশোকনাথবাবু উপাচার্য থাকাকালীন অনেক ঝগড়া হয়েছে। মতবিরোধও হয়েছে। কিন্তু তার মধ্য দিয়েই এগোনোর পথ বেরিয়েছে।” যাদবপুরের ভবিষ্যৎ নিয়ে ‘সিঁদুরে মেঘ’ দেখা দিয়েছে বলে তাঁর মত।
এমিরেটাস অধ্যাপকেরা এ দিন রাজ্যপালকে জানান, পঠনপাঠনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে যাদবপুরের সাফল্য প্রশ্নাতীত। কিন্তু সেই সুনাম এখন প্রশ্নের মুখে। তাঁরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১টি স্কুল অব স্টাডিজের মধ্যে ১৫টিতেই এখন অধিকর্তা নেই। তার জেরে স্কুলগুলির পঠনপাঠন ছন্নছাড়া। অনেক প্রকল্পই হাতছাড়া হওয়ার মুখে।
যাদবপুরে এ দিনও ক্লাস হয়নি। ক্যাম্পাসে যাননি উপাচার্য। কবে থেকে যাবেন, তা-ও ঠিক নেই বলে জানিয়েছেন তিনি। পুলিশ জানিয়েছে, যাদবপুর ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগে ধৃত দুই ছাত্রকে এ দিন শনাক্ত করেছেন অভিযোগকারিণী ছাত্রী। ধৃতদের জামিনের আবেদন খারিজ করে আদালত ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত তাঁদের জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।