তার অস্তিত্ব যে আদৌ রয়েছে, গত এক বছরে বোঝা যায়নি সেটাই। রাজ্য মানবাধিকার কমিশন কার্যত ঘুমিয়েই ছিল। কিন্তু মাস দুয়েক আগে তার ঘুম ভেঙেছে। রাজ্যের সংশোধনাগারগুলি কী ভাবে আরও উন্নত করা যায়, নবান্নকে তার জন্য এক গুচ্ছ সুপারিশ করেছেন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নপরাজিত মুখোপাধ্যায়। আর যে প্রশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণত ঢিমে তালে কাজ করার অভিযোগ থাকে, তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এ ক্ষেত্রে তারাও অত্যন্ত তৎপর। নবান্ন সূত্রেই এই নিয়ে দফায় দফায় বৈঠকের খবর মিলেছে।
আকস্মিক এ হেন তৎপরতা দেখে বিরোধীরা কটাক্ষ করছেন, সারদা কেলেঙ্কারিতে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের জেলে যাওয়া শুরু হয়েছে, সেই জন্যই কি এমন উদ্যোগ? কংগ্রেসের আইনজীবী নেতা অরুণাভ ঘোষের কথায়, “মদন মিত্রর জন্য কি এত দিন বাদে কমিশন এই প্রস্তাব দিচ্ছে? শুনে তো মনে হচ্ছে, মুকুল রায় জেলে ঢুকছেনই।”
বস্তুত, এই মুহূর্তে জেলের অন্দরে কোন ‘ভিআইপি’ বন্দি কতটা সুবিধা পাচ্ছেন, কী ধরনেরই বা অসুবিধেয় রয়েছেন রাজ্যের নাগরিক সমাজ তা নিয়ে তর্ক-বিতর্কে মশগুল। কে কোন পথে পছন্দসই পানীয় পাচ্ছেন, কে নিজস্ব ব্র্যান্ডের সিগারেট পাচ্ছেন, কে পশ্চিমী ধাঁচের শৌচাগার না-থাকায় কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় পড়েছেন এ সব নিয়েও রটনার অন্ত নেই। এমনও শোনা যাচ্ছে, নামজাদা কেউ মাছ-মাংসের মান-পরিমাণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। কেউ আবার টিভিতে ২৮টি চ্যানেল কেন মিলছে না, তা নিয়ে বিরক্ত!
সংশোধনাগারগুলির হাল ফেরাতে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের তরফে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দেওয়া হয়েছিল গত ১৮ নভেম্বর। কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তথা রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায় সেই চিঠিতে সংশোধনাগার সংস্কারের জন্য ১৬ দফা সুপারিশ করে তা ‘জরুরি’ ভিত্তিতে কার্যকর করার অনুরোধ করেছিলেন।
হয়তো কাকতালীয়! কিন্তু ঘটনা হল, গত বছরে সারদা তদন্তের ভার সিবিআইয়ের হাতে যাওয়ার পর থেকে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠদের অনেকে জেলে গিয়েছেন এবং আরও অনেকে জেলে যেতে পারেন, এমন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। নপরাজিত যখন ওই চিঠি লিখছিলেন, তার আগেই জেলে ঢুকেছেন শাসক দলের ঘনিষ্ঠ ইস্টবেঙ্গল কর্তা নিতু সরকার, তৃণমূলের সহ-সভাপতি রজত মজুমদার। আর চিঠি লেখার পরে গ্রেফতার হয়েছেন সাংসদ সৃঞ্জয় বসু এবং মন্ত্রী মদন মিত্র। যে দিন নপরাজিত চিঠি লেখেন, তার আগের দিনই অর্থাৎ ১৭ নভেম্বর সারদা-কাণ্ডের দ্বিতীয় চার্জশিট পেশ করে সিবিআই।
এই সূত্র ধরেই বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের টিপ্পনি, “কয়েদিদের জন্য এত দরদ মদন জেলে ঢোকার পরেই হল কেন? তা হলে কি মদনের দলের আরও রথী, মহারথী জেলে ঢুকবেন! তাঁদের আরামের ব্যবস্থাই হচ্ছে নাকি!” নপরাজিতবাবু অবশ্য বলছেন, “জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নভেম্বরে দিল্লিতে সংশোধনাগার সংস্কার নিয়ে আলোচনা করে কিছু পরামর্শ দিয়েছিল। সেই মতো সুপারিশ করা হয়েছে। ছিদ্রান্বেষীরা নানা কিছু ভাবতেই পারেন। আমার এর বেশি কিছু বলার নেই।”
কী কী সুপারিশ করেছে কমিশন?
চিঠির বয়ান অনুযায়ী, তিহাড় ও তিরুঅনন্তপুরম জেলকে মডেল করে এ রাজ্যের প্রেসিডেন্সি, আলিপুর এবং জলপাইগুড়ি জেলের সংস্কার করতে অনুরোধ করা হয়েছে। বিশেষত প্রেসিডেন্সি জেলে জরুরি ভিত্তিতে ন্যূনতম অত্যাধুনিক পরিষেবার ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেছে কমিশন।
সরকারি সূত্রের খবর, ওই সব সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে জেলে অত্যাধুনিক শৌচাগার, বায়ো গ্যাসে রান্না, আধুনিক হাসপাতাল, সাপ্তাহিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার যাবতীয় সরঞ্জাম, মাল্টি জিমও দেখা যাবে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন মিললে দিল্লির তিহাড় জেলের ধাঁচে রাজ্যের কারাগারেও বাতানুকূল কক্ষ, কনফারেন্স হল, ইন্টারনেট পরিষেবা মিলবে। এমনকী, প্যারোলে ছাড়া পাওয়ার প্রক্রিয়াও অনেক সহজ হয়ে যাবে।
তিহাড় জেলে ‘ভিআইপি’ বন্দিদের আনাগোনা লেগেই থাকে। ওই জেলে বন্দি থেকেছেন প্রয়াত কংগ্রেস নেতা সঞ্জয় গাঁধী। হালে ডিএমকে নেত্রী এম কে কানিমোঝি, সমাজবাদী পার্টির নেতা অমর সিংহও সেখানে কাটিয়েছেন। এখনও তিহাড়ে রয়েছেন সহারা কর্ণধার সুব্রত রায়। আদালতের অনুমতি পেয়ে যিনি এখন জেলের এসি রুমে থাকেন। এসি কনফারেন্স হল-এ বসে ল্যাপটপ, সচিব, আপ্ত সহায়ক নিয়ে কাজ করতে পারেন।
এ রাজ্যে মানবাধিকার কমিশনের আর পাঁচটা সুপারিশ কার্যকর করা নিয়ে গয়ংগচ্ছ মনোভাবের অভিযোগ থাকলেও এ ক্ষেত্রে কিন্তু প্রশাসন অতি মাত্রায় তৎপর। সরকারি সূত্রের খবর, চিঠি পাওয়ার পরে নবান্নে তিন দফায় বৈঠক করে কারা সংস্কারের খসড়া প্রায় তৈরি। কিছু কাজও হয়ে গিয়েছে। কলকাতার প্রেসিডেন্সি, আলিপুর, দমদম তিন জেলে পরিষেবার মান বাড়ানোর কাজ পুরোদমে চলছে। এ নিয়ে কমিশনের পক্ষ থেকেও ঘনঘন স্বরাষ্ট্র দফতরে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে বলে সূত্রের খবর।
সারদা-কাণ্ডের আগে জেল সংস্কারের ব্যাপারে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন কখনও এতটা মনোযোগী হয়েছে কি? স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা জানান, ফাইল না-দেখে সেটা বলা সম্ভব নয়। আপাতদৃষ্টিতে কমিশনের ওই চিঠিকে প্রশাসন ‘রুটিন’ বলে দাবি করলেও সারদা-কাণ্ডের প্রেক্ষাপটে এতে ভিন্ন বার্তাই খুঁজে পাচ্ছেন বিরোধীরা। তাদের অভিযোগ, রাজ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘লিখিত অভিযোগ নেই’ বলে দাবি করে হাত গুটিয়ে বসে থাকে কমিশন। গত বছরের গোড়ায় প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পরে পদটি শূন্যই পড়ে রয়েছে। কমিশনের সবেধন নীলমণি সদস্য নপরাজিতই দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। কিন্তু গত এক বছরে তাঁকে কখনও কোনও ব্যাপারে সরব হতে দেখা গিয়েছে বলে মনে করতে পারছেন না বিরোধীরা। সেই ঠুঁটো কমিশনই হঠাৎ কেন ১৬ দফার সুপারিশ পাঠিয়ে জরুরি ভিত্তিতে রূপায়ণের প্রস্তাব দিল, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে বলে বিরোধীদের মত।
স্বরাষ্ট্র দফতরেরই এক শীর্ষ কর্তা জানাচ্ছেন, ২০১১ সালেও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দেশের নানা রাজ্যের জেল সংস্কারের ব্যাপারে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনগুলিকে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। সে সময়ে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তা নিয়ে ‘জরুরি’ ভিত্তিতে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। তবে বাম আমলে জেলের রান্নাঘর, ডাইনিং হলের চেহারা আমূল বদলানো হয়েছিল বলে দাবি করেছেন প্রাক্তন মন্ত্রী বিশ্বনাথ চৌধুরী। প্রাক্তন কারামন্ত্রীর টিপ্পনি, “আমরা জেলের হাল ফিরিয়েছিলাম। মুক্ত কারাগার করেছিলাম। এখনকার সরকার তিহাড় কেন, চাইলে লন্ডনের ধাঁচেও জেল গড়তে পারে। তার আড়ালে কোন শঙ্কা রয়েছে তা তো সময়ই বলবে।”
সরকারি সূত্রের খবর, কমিশনের প্রস্তাব কাজে পরিণত করতে হলে অন্তত আড়াইশো কোটি টাকা লাগতে পারে। এখন আগামী দিনে আরও কে বা কারা জেলে যেতে পারেন এবং জেলে তাঁদের কী ধরনের পরিষেবা লাগতে পারে, সেটা ভেবেই আগাম ব্যবস্থা করা হচ্ছে কিনা, এই গুঞ্জন প্রশাসনের অন্দরেও।