আদি বাসস্থান চিন। সেখান থেকে কোরিয়া থেকে জাপান। তারপরে ইউরোপের গ্রেট ব্রিটেন। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সেখান থেকেই ভারতে চন্দ্রমল্লিকার শুভাগমণ। বীরবল, সাহনি, অপ্সরা, কুন্দন, শরদ, সিঙ্গার ইত্যাদি জাতগুলি এদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও রোগপোকার আক্রমণে প্রায়শই গাছ নিস্তেজ হয়ে পড়ে, মরে যায় বা ফুল দেয় না।
এই রোগপোকার আক্রমণ কী ভাবে এড়াবেন জানার আগে চন্দ্রমল্লিকা চাষের প্রাথমিক খুঁটিনাটিগুলো জেনে নেওয়া দরকার। যেমন, উর্বর বেলে-দোয়াঁশ মাটি এই ফুল চাষের আদর্শ। মাটির অম্লত্ব ৬.২-৬.৭। তবে আসল বিষয় হল জল যেন না দাঁড়ায় জমিতে। একাধিক চাষ ও মই দিয়ে ভাল ভাবে জমি তৈরি করতে হবে। মাটিতে ইট বা পাথর টুকরো বা পূর্ব-ফসলের গোড়া থাকলে সরিয়ে ফেলতে হবে। শুরুতেই মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে খামার জাত সার মিশিয়ে দিতে হবে। প্রতি একর জমির জন্য খামারজাত সার ৪০০০ কেজি, ইউরিয়া ৭০ কেজি, সিঙ্গল সুপার ফসফেট ৩৪০ কেজি, মিউরিয়েট অফ পটাশ ৫২ কেজি।
সারি থেকে সারি, গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২০ সেমি রাখতে হবে। ১.২ সেমি গভীরে চারা রোপণ করতে হবে। প্রতি বর্গমিটারে ৩০-৩৫টির বেশি চারা যেন না থাকে।
এবার আসি রোগ-পোকার কথায়। চন্দ্রমল্লিকা গাছে শোষক পোকা, জাব পোকা, চষি পোকা, গল মিজ, শুঁয়ো পোকা, কুঁড়ি ছিদ্রকারী পোকা, লালমাকড় লাগতে পারে। সুসংহত জৈব উপায়ে এর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ভাল।
যেমন, প্রতি একর জমিতে কমপক্ষে ৯-১২টি হলুদ আঠালো ফাঁদ বসালে শোষক পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পোকা লাগলে পুরনো পাতা, আক্রান্ত ডগা ও ফুল সংগ্রহ করে দূরে কোথাও মাটির নীচে পুঁতে বা পুড়িয়ে দিতে হবে। একটা স্প্রে-ও করা যায়। এর জন্য দু’কেজি নিম পাতা, ২০০ গ্রাম শুকনো লঙ্কা বেটে তার সঙ্গে এক কেজি কাঁচা গোবর ও দু’লিটার জল মিশিয়ে কমপক্ষে সাত দিন পচাতে হবে। উক্ত দ্রবণ আরও ১০ লিটার জলে মিশিয়ে ছেঁকে নিতে হবে। এরপর সেটি দু’শো লিটার জলের সঙ্গে মিশিয়ে আঠা-সহ বিকালের দিকে স্প্রে করলে শোষক পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
আর একটা কাজ করা যায়। চারা লাগানোর ১৫ দিন পর থেকে ১০,০০০ পিপিএম নিম তেল ১০ দিন অন্তর তিন থেকে চার বার আঠা-সহ বিকেলের দিকে স্প্রে করতে পারেন।
কৃমি নিয়ন্ত্রণের জন্য শেষ চাষের আগে প্রতি একরে কমপক্ষে ১৫০ কেজি বা ৩০ সেমি ব্যাসার্ধের প্রতিটি টবে ১০০ গ্রাম করে নিমখোল প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের সময় বা প্রুনিংয়ের পর প্রতি একরে কমপক্ষে ৬ কেজি বা ৩০ সেমি ব্যাসার্ধের প্রতিটা টবে এক চা চামচ করে কার্বোফিউরন থ্রিজি প্রয়োগ করতে হবে।
এরপরেও কাজ না দিলে রাসায়নিক ওষুধ দিতে হবে। শোষক পোকার জন্য ইমিডাক্লোপ্রিড ১৭.৮% এসএল (এক লিটার জলে ০.২ মিলি) বা প্রোফেনোফস ৫০% এসএল (এক লিটার জলে এক মিলি), শুঁয়োপোকার জন্য ম্যালাথিয়ন ৫০ %ইসি (এক লিটার জলে দুই মিলি), কুঁড়ি ছিদ্রকারী পোকা নিয়ন্ত্রণে অ্যাসিফেট ৭৫% ডব্লিউপি (এক লিটারে ০.২ মিলি), ফিপ্রোনিল ৫%ইসি (এক লিটারে এক মিলি) দিতে পারেন। লাল মাকড় নিয়ন্ত্রণে ফেনাজাকুইন ১০%ইসি (এক লিটার জলে ২.৫ মিলি) বা প্রোপারজাইট ৫৭%ইসি (এক লিটার জলে ২ মিলি) প্রয়োগ করতে হবে।
রোগের মধ্যে শিকড় ও গোড়া পচা, সাদা চিতি, গ্রে মোল্ড, লিফ-গল, ঢলে পড়া, বাদামি ও সাদা মরচে, পাতায় দাগ প্রভৃতিতে আক্রান্ত হতে পারে চন্দ্রমল্লিকা গাছ। এক্ষেত্রেও প্রথমে জৈব উপায়ের উপরেই ভরসা করতে হবে। বিশ্বস্ত নার্শারি থেকে গুণমানের চারা সংগ্রহ করলে রোগ অনেকটাই এড়ানো যায়। সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত গাছ পেতে হলে প্রতি একর জমির জন্য ১০০ কেজি পচানো গোবর সারের সঙ্গে ভেজা অবস্থায় এক কেজি করে উপকারী ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া (ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি ও সিউডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স) মিশিয়ে এক সপ্তাহ ছায়াযুক্ত স্থানে রেখে জমিতে ছড়াতে হবে। ৩০ সেমি ব্যাসার্ধের টব হলে উক্ত মিশ্রণ ৫০ গ্রাম করে এক মাস অন্তর দু’বার প্রয়োগ করতে হবে।
চারা রোপণের ১৫ দিন পর থেকে ১০ দিন অন্তর একটি করে অন্তর্বাহী ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। ঢলে পড়া গাছগুলিকে শিকড়-সহ তুলে দূরে কোথাও মাটিতে পুঁতে দিতে হবে বা পুড়িয়ে দিতে হবে।
এরপরেও রোগ এড়াতে না পারলে রাসায়নিক রোগনাশকের সাহায্য নিতে হবে। গোড়া পচা রোগ ছত্রাকঘটিত হলে বেনোমিল ৫০ % ডব্লিউপি বা কার্বেন্ডাজিম ৫০ % ডব্লিউপি (প্রতি লিটার জলে এক গ্রাম) দিতে হবে। পাতায় দাগ হলেও এই এক ওষুধ। গোড়াপচা রোগ ব্যাকটেরিয়া ঘটিত কারণে হলে প্রতি একরে ৬ কেজি ব্লিচিং পাউডার বা ভ্যালিডামাইসিন ৩ % এল (এক লিটার জলে ২ মিলি) দিতে হবে। কুঁড়ি পচাতে ক্যাপটান ও হেক্সাকোনাজলের মিশ্রণ (এক গ্রাম প্রতি লিটার) বা ম্যানকোজেব ৭৫% ডব্লিউপি (তিন গ্রাম প্রতি লিটার) বা ট্রাইডেমর্ফ ৮০ % ইসি (এক লিটারে ০.৫ গ্রাম) দিতে হবে। পাতা ধ্বসাতেও এক। মরচে রোগে ট্রাইডেমর্ফ ৮০ % ইসি (এক লিটারে ০.৫ মিলি) দিতে পারেন কিংবা প্রোপিকোনাজল ২৫ % ইসি (এক লিটারে এক মিলি) দিলেই হবে। সাদা চিতি রোগেও ট্রাইডেমর্ফ ৮০ % ইসি (এক লিটারে ০.৫ মিলি) বা প্রোপিকোনাজল ২৫ % ইসি (এক লিটারে এক মিলি) দিতে পারেন। এক লিটার জলে তিন গ্রাম সালফার ৮০% ডব্লিউপি দিলেও উপকার পাওয়া যায়।
তবে, জৈব উপায়ে রোগপোকা নিয়ন্ত্রণ হয়ে গেলে রাসায়নিক থেকে দূরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।
লেখক খানাকুল এক ব্লকের সহ-কৃষি অধিকর্তা।