কয়েক বছর আগেও গাড়ি ধোওয়া-মোছার কাজ করতেন। আস্তে আস্তে টাকা-পয়সা জমিয়ে ট্রাক কিনে নিজেই সেটা চালাতে শুরু করেন। এই পর্যন্ত উন্নতির গল্পটা বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু পরের বছরগুলিতে আব্দুল বারিক বিশ্বাসের উত্থানের কাহিনী অবশ্য গল্প-উপন্যাসকেও হার মানায়।
এ হেন মানুষটি কোটি কোটি টাকার সোনা পাচারের অভিযোগে ধরা পড়ায় বিস্মিত নন এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই। তবে গরু পাচারের ঘটনায় বারিকের নাম এর আগে বহু বার উঠে এলেও সোনা পাচারকারী হিসাবে বারিকের ভূমিকার কথা মানতে নারাজ কেউ কেউ। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “গরু পাচারে ওই ব্যক্তির নামে আগে অভিযোগ হয়েছে। কিন্তু প্রমাণ না থাকায় গ্রেফতার করা যায়নি। তবে কয়েক বার ওঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করি।”
বাদুড়িয়ার কাটিয়াহাট এলাকায় বারিকের ছোটখাট একটা বাড়ি ছিল। ক্রমে বসিরহাটেরই সংগ্রামপুরে আলিশান অট্টালিকা গড়েন বারিক। দোকান ঘর তৈরি করে ইমারতি দ্রব্যের শুরু করেন ব্যবসা। সরকারি দফতরে ঠিকাদারির কাজও মিলে যায়। বসিরহাট, বারাসত, কলকাতায় একাধিক বাড়ি-গাড়ি-জমি কিনতে থাকেন বারিক।
২০০৯ সাল নাগাদ গরু পাচার চক্রের সঙ্গে নাম জড়িয়ে পড়ে বছর পঁয়তাল্লিশের বারিকের। কিন্তু তত দিনে নম্র স্বভাবের ব্যক্তিটির এলাকায় প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়তে শুরু করেছে। লোকে বলত, দু’হাতে রোজগার করে চার হাতে খরচ করেন বারিক। এলাকার বহু ক্লাব বারিকের আশীর্বাদে ফুলেফেঁপে ওঠে। সভা-সমিতি-পুজো কোনও কিছুতেই আব্দার করলে কাউকে খালি হাতে ফেরান না ‘বারিকদা’। আপদে-বিপদে কত মানুষ তাঁর সাহায্য পেয়েছেন, ইয়ত্তা নেই।
এমন দরাজ দিল মানুষের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দহরম মহরম থাকবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। বাম-ঘেঁষা বলে পরিচিত হলেও তৃণমূল-কংগ্রেস-বিজেপি সব দলের সঙ্গেই কমবেশি খাতির রেখে চলতেন বিচক্ষণ মানুষটি। পুলিশ-প্রশাসনের বহু আধিকারিকেরও তাঁর বাড়িতে আনাগোনা ছিল বলে জানাচ্ছেন এলাকার মানুষ।
ইতিমধ্যে রাজ্যে ক্ষমতা বদল হয়। তৃণমূল জমানায় ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত সমিতিতে প্রার্থী হন বারিকের দাদা গোলাম বিশ্বাস। বিরোধী দলগুলি সে সময়ে গরু পাচারের টাকায় তৃণমূল প্রচার চালাচ্ছে বলে বারিকের বিরুদ্ধে তুমুল শোরগোল ফেলে। দাদার হয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়েই প্রচার করেছিলেন বারিক। ফলে গরু পাচারকারীদের সঙ্গে তৃণমূলের যোগসাজশ আছে, এই অভিযোগ তুলে আর এক দফা সমালোচনা করে বিরোধীরা। যদিও ভোটমেশিনে ভাগ্য গোলামের সহায় হয়। জয়ী হন তিনি। দাদা রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত হওয়ায় ভাইয়ের মান-ইজ্জত বেড়েছিল সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে প্রভাব-প্রতিপত্তিও বাড়ে।
বারিক ধরা পড়ার পরে ডান-বাম কোনও দলই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা মানতে নারাজ। কংগ্রেস নেতা অসিত মজুমদারের কথায়, “তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ বারিক ধরা পড়ায় এ বার গরু পাচার কমবে।” কংগ্রেসের সঙ্গে বারিকের যোগাযোগের কথা অস্বীকার করেছেন অসিতবাবু। অন্য দিকে, সিপিএম নেতা নিরঞ্জন সাহা বলেন, “বারিকের সঙ্গে আমাদের দলের কোনও দিনই যোগাযোগ ছিল না। ও তো তৃণমূলের হয়েই কাজ করত বলে শুনেছি।”
জেলা তৃণমূল পর্যবেক্ষক তথা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “গোলাম আমাদের দলের সদস্য ঠিকই, কিন্তু ওঁর দাদা দলের কেউ নন।” কিন্তু তা হলে নির্বাচনী প্রচারে কেন দেখা গিয়েছিল বারিককে? জ্যোতিপ্রিয়বাবুর ব্যাখ্যা, “কংগ্রেসই ওঁকে চক্রান্ত করে পাঠিয়েছিল।”