বিসর্জনের পরে ঠাকরুণ বাঁধ। — দয়াল সেনগুপ্ত।
শালুক, কচুরিপানার মতো জলজ উদ্ভিদে প্রায় ঢেকে যাওয়া নির্জন এক জলাশয়। যেখানে বছরভর নিশ্চিন্তে থাকে জলপিপি, ডাহুক, পানডুবি, বকেরা। বছর দুই আগে দুবরাজপুর শহরের বাইরে থাকা জলাশয়ের ওই ঘাটটি পুরসভা বাঁধিয়ে না দিলে ঠাওর করাই মুশকিল ছিল, এটা আদতে ‘ঠাকরুণ বাঁধ’!
ঢাক, বাজি আর মানুষের কলরবে সেই ঠাকরুণ বাঁধের নির্জনতা ভাঙে একদিনই—দশমী। কারণ ওই দিন সন্ধ্যা থকে রাত, শহরের প্রায় প্রতিটি নবপত্রিকাই বিসর্জন করা হয় ওই পুকুরে। বহু বছর ধরে যে এমনটাই রীতি। এ বারও ব্যতিক্রম হয়নি। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা থেকে শুরু। শেষ দোলা বিসর্জন হতে হতে রাত সাড়ে এগারোটা ছুঁয়ে যায় ঘড়ির কাঁটা।
কবে থেকে, কেন এই রীতি চালু হল, সেটা খুব স্পষ্ট নয় শহরবাসীর কাছে। তেমন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাও নেই অধিকাংশ বারোয়ারী পুজোর কিংবা শতাব্দী প্রাচীন পারিবারিক পুজোর উদ্যোক্তাদের। একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার অবশ্য চেষ্টা করেছেন অশীতিপর বৃদ্ধ পরেশ আচার্য। তিনি দুবরাজপুরের আচার্যদের শতাব্দী প্রাচীন দুর্গাপুজোর প্রবীণ পুরোহিত তথা এক শরিকও বটে। তাঁর ব্যাখ্যা, বর্তমানের পুরশহর অতীতে গ্রাম ছিল। বহু বছর আগে দুবরাজপুরে হাতে গোনা কয়েক’টি পারিবারিক পুজো হত। দশমীর রাতে নবপত্রিকা বিসর্জনের জন্যে গ্রামের বাইরে (বর্তমানে শহরের) একটি পুকুর নির্বাচনের পিছনে একটা ধারনা কাজ করছে। সেটা হল, মা যখন বাপের বাড়ি আসেন তাঁকে বরণ করে নেওয়া হয় বা নবপত্রিকাকে স্নান করানোর জন্য গ্রামের বা দুর্গা মণ্ডপের আশপাশে থাকা পুকুরগুলিই বাছা হয়। কিন্তু মা যখন বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি যাবেন, তখন সকলে মিলে মায়ের সঙ্গে পায়ে পায়ে কিছুটি পথ এগিয়ে যাওয়ার জন্যে গ্রামের বাইরে ওই পুকুর ঠিক করা হয়েছিল। ‘‘যেহেতু হিমালয় পর্বত উত্তর দিকে অবস্থিত, সে কথা মাথায় রেখেও ওই পুকুর নির্বাচন করা হয়ে থাকতে পারে’’— যুক্তি তাঁর।
দুবরাজপুরের একটি সর্বজনীন পুজোয় দীর্ঘ দিন ধরে পুজো করে আসা পুরোহিত জগন্নাথ ভট্টাচার্য, শতাব্দী প্রাচীন চামুণ্ডা মন্দিরের বর্তমান সেবাইত গণেশ কবিরাজ বা সিংহ বাহিনী পুজোর দেখভালের দায়িত্বে সুশীল চট্টোপাধ্যায় বা একটি সর্বজনীন ক্লাবের সম্পাদক সোমেশ আচার্যরা পরেশবাবুর সঙ্গে একমত।
দশমীর সকাল থেকেই পুকুরে যাওয়ার পায়ে চলা পথটি পরিস্কার করে আলোর ব্যবস্থা করা হয়। যাতে রাতের অন্ধকারে পুকুরে দোলা নিয়ে যেতে অসুবিধা না হয়। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে থাকে পুলিশি ব্যবস্থা। পাশে থাকে দুবরাজপুর পুরসভা, প্রশাসন। দশমীর সন্ধ্যায় দোলা বিসর্জন দেখতে ভিড় জমে।
পুরপ্রধান পীযূষ পাণ্ডে বলছেন, ‘‘আগে নিজে যখন নায়ক পাড়ার পুজোর দোলা নিয়ে রাতের অন্ধকারে দোলা বিসর্জনে যেতাম তখন খুবই অসুবিধে হত।’’ সেই অসুবিধের কথা মাথায় রেখে পুরপ্রধান হয়েই তিনি আলোর ব্যবস্থা থেকে ঘাট বাঁধানোর ব্যবস্থা করেছেন বলে দাবি করেছেন।
এমন একটি পুকুর নির্জন কেন?
শহরবাসী বলছেন, বহুকাল আগে নির্বাচিত সেই ঠাকরুণ বাঁধ এখনও লোকালয়ের বাইরেই রয়েছে। এ জন্য অবশ্য ছোট একটা কারণও রয়েছে। অনেককাল আগে ইংরেজদের তৈরি অণ্ডাল-সাঁইথিয়া রেললাইন চলে গিয়েছে ওই পুকুরের পাশ দিয়েই। দুবরাজপুর স্টেশনের বেশ কিছুটা আগে থাকা পুকুর সংলগ্ন অংশটি অবস্থানগত দিক থেকে বসবাসের উপযুক্ত না হওয়ায় নগরায়নের বাইরে থেকে গিয়েছে। ফলে অবিকৃত থেকে গিয়েছে ওই জলাশয়। চাষ আবাদের কারণে কিছু মানুষ ওই দিকে যাতায়াত করলেও, রেললাইন পেরিয়ে বা ধার ঘেঁষে ওই পথে সচরাচর যাতায়াত নেই মানুষের। ব্যতিক্রম কেবল দশমীর রাত!