দুর্গাপুজোর আগে দোকানে দোকানে তল্লাশি চালিয়ে নিষিদ্ধ শব্দবাজি উদ্ধার থেকে শব্দবাজি প্রস্তুতকারীকে গ্রেফতার— সবই করেছিল বিষ্ণুপুর পুলিশ। কিন্তু শব্দবাজির রমরমা যে রোখা যায়নি, বিষ্ণুপুর শহরের রাজ দরবারে অষ্টমীর সন্ধিপুজোর ঐতিহাসিক তোপ দাগা দেখতে এসে তা চাক্ষুষ করেছেন বাঁকুড়ার পুলিশ কর্তারা। মল্লরাজাদের তোপের আওয়াজকে ছাপিয়ে গিয়েছিল নিষিদ্ধ শব্দবাজির আওয়াজ! এমনই তার মহিমা!
অভিযান যতই চলুক, শব্দবাজি রুখতে ফাঁক ফোঁকর যে রয়ে গিয়েছে, তা ওই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল পুলিশ কর্তাদের। দুর্গাপুজো শেষ, কিন্তু দোরগোড়ায় যে কালীপুজো। অতএব, শব্দবাজি নতুন করে ফের পুলিশের পরীক্ষা নিতে স্বমহিমায় হাজির। আলোর উৎসব দীপাবলিতে শব্দবাজি রুখতে তাই তৎপরতা বাড়িয়েছে পুলিশ। মঙ্গলবারও বড়জোড়ার মালিয়াড়া এলাকা থেকে গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় নামের এক ব্যক্তি শব্দবাজি বিক্রির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। ধৃতের দোকান থেকে প্রায় ১০ হাজার টাকা মূল্যের শব্দবাজি উদ্ধারও হয়েছে বলে পুলিশের দাবি।
দুর্গাপুজোর আগে বিষ্ণুপুরের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে দু’বস্তা নিষিদ্ধ শব্দবাজি আটক করেছিল বিষ্ণুপুর থানা। ওই থানা এলাকার অযোধ্যায় এক ব্যক্তিকে বেআইনি শব্দবাজি বানানোর অভিযোগে গ্রেফতারও করা হয়। বাজির দোকানগুলিতে প্রকাশ্যে রোশনাই, আতসবাজি সাজানো থাকলেও দুর্গাপুজোয় পুলিশের ভয়ে শব্দবাজি সে ভাবে বিক্রি করেননি ব্যবসায়ীরা। কালীপুজোর আগেও দোকানগুলিতে শব্দবাজি প্রকাশ্যে রাখা হচ্ছে না।
তা বলে কি শব্দবাজি পাওয়া যাবে না? বিষ্ণুপুরের বাজির দোকানগুলিতে গিয়ে চকোলেট বোমের খোঁজ করতেই ব্যবসায়ীরা ‘নেই’ বলে সাফ জানিয়ে দিলেন। কোথায় মিলতে পারে তারও হদিস বললেন না। বিক্রি না হলে মানুষের হাতে শব্দবাজি আসছে কি করে? শহরের কালীতলার মোড় এলাকার এক যুবকের কথায়, “পুলিশের কড়াকড়িতে অচেনা কাউকে শব্দবাজি বিক্রি করতে ভরসা পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। হয় ব্যবসায়ীদের চেনা হতে হবে, না হলে তাঁদের পরিচিত কারও মাধ্যমে যেতে হবে।’’
বাঁকুড়া শহরেও একই কায়দায় গোপনে বিক্রি হচ্ছে শব্দবাজি। পুজোর আগে বাঁকুড়া সদর থানার পুলিশও দোকানে দোকানে তল্লাশি চালিয়ে বেশ কয়েক বস্তা শব্দবাজি উদ্ধার করে। পুলিশের কড়াকড়িতে বাঁকুড়ার খোলা বাজারেও শব্দবাজি প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে না। শহরের চকবাজার, সুভাষ রোড এলাকার বাজি ব্যবসায়ীদের কাছে শব্দবাজির খোঁজ করতে গেলে ক্রেতাদের ‘নেই’ বলে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বোম কিনতে এলাকার ছেলেরা বিভিন্ন ‘দাদা’দের পরিচিতি কাজে লাগাচ্ছে। শহরের পাঠকপাড়ার এক দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রের কথায়, “মহালয়ার আগের রাতে শব্দবাজি কিনতে গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসতে হয়েছিল। মহালয়ার দিন পাড়ার এক দাদাকে সমস্যার কথা জানালে সে তার এক পরিচিত ব্যবসায়ীর দোকানে যেতে বলে।’’ দোকানে গিয়ে দাদার নাম বললেই যে বিক্রেতারা শব্দবাজি হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন, তা অবশ্য নয়।
ওই কিশোর জানায়, দোকানে পৌঁছে পাড়ার ওই দাদার মোবাইলে ফোন করে দোকানদারের সঙ্গে কথা বলানোর পরে শব্দবাজি হাতে পাওয়া গিয়েছে। ফলে, এ বার কালীপুজোয় শব্দবাজির দাপটে কান ফাটার আশঙ্কা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে চকলেট বোমা। বিভিন্ন কোম্পানির ছাপমারা প্রতি প্যাকেটে ১২ পিস বোমা থাকছে। প্যাকেট পিছু বাজারে দর যাচ্ছে ২০-২৫ টাকা। এই পরিস্থিতিতে কালীপুজোর পরীক্ষায় পুলিশ পাশমার্ক তুলতে পারবে কি না সেদিকেই তাকিয়ে জেলার মানুষ।
তবে পুলিশ যে শব্দবাজি রুখতে লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তার প্রমাণ মিলেছে পাত্রসায়র ও বড়জোড়া থানায়। নিষিদ্ধ শব্দবাজি বানানোর অভিযোগে ওই দু’টি থানা এলাকাতেই এক জন করে ব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছেন। উদ্ধার হয়েছে লক্ষাধিক টাকার শব্দবাজি ও মাল মশলা। বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপু্রে সাদা পোশাকে বাজির দোকানগুলিতে তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছেন পুলিশকর্মীরা। বিষ্ণুপুরের এসডিপিও লাল্টু হালদারের কথায়, “আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। কালীপুজোয় শব্দের তাণ্ডব রুখতে পুলিশ সক্রিয়।’’ জেলা পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরার কথায়, “শব্দবাজি ধরতে লাগাতার অভিযান চলছে। প্রতিটি থানাকেই পদক্ষেপ করতে বলা হয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের সচেতনতা ও সহায়তাও দরকার।”