খুদের হাতে। নিজস্ব চিত্র
অভাবের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে পায়ের তলার মাটিটা সদ্য কিছুটা শক্ত হয়েছে। তার পরেই এসেছে মহামারি। ছত্তীসগঢ়ে আটকে রয়েছেন বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের কাদাকুলির যুবক সুজয় সেন। বুধবার ছিল তাঁর চব্বিশ বছরের জন্মদিন। বাড়িতে আসতে পারেননি। সুখ-দুঃখের ভাগ নিয়ে তাঁর বাবা মানবেন্দ্রবাবুই চলে গিয়েছিলেন মড়ার অঞ্চলের কামারবাঁধ গ্রামে। দুঃস্থ পরিবারের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মিষ্টি খাইয়েছেন। উপহার দিয়েছেন খাতা, কলম, পেনসিল বাক্স, জ্যামিতি বাক্স প্রভৃতি।
মানবেন্দ্রবাবু সকালে খবরের কাগজ ফেরি করেন। তার পরে টুকিটাকি যা কাজ পান, সব মিলিয়ে মাসে আয় হয় মেরেকেটে পাঁচ হাজার টাকা। অভাবের সংসারে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে সুজয় বিষ্ণুপুর রামানন্দ কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। দু’বছরে বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ এডুকেশনাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে যোগ ব্যায়ামে ‘ডিপ্লোমা’ করেছেন। পাশ করে বেরিয়েই, ২০১৯ সালে ছত্তীসগঢ়ের রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠে অস্থায়ী শিক্ষকের চাকরিতে যোগ দেন। আপাতত সেখানেই রয়েছেন তিনি। কলকাতায় থাকাকালীন জন্মদিনে বাড়ি আসতেন। মানবেন্দ্রবাবু বলেন, ‘‘এ বার জন্মদিনে আসতে পারছে না। ফোনে তা নিয়ে কথা হচ্ছিল। তখনই বলে, বাচ্চাদের পড়ার জিনিস উপহার দেওয়ার কথা।’’ একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যে পুরো আয়োজন করে ফেলেন তিনি। হাজার পাঁচেক টাকা খরচ হয়েছে। দিয়েছেন সুজয়।
যোগ ব্যায়ামে সুজয়ের আগ্রহ ছিল ছোটবেলা থেকেই। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কারও জিতেছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘সে বার লোকের থেকে টাকা নিয়ে ব্যায়ামের পোশাক কিনতে হয়েছিল। অনেকের সাহায্য নিয়ে আজ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি। সে কথা ভুলতে পারব না।’’ অভাবকে সঙ্গী করে ছেলে-মেয়েকে বড় করেছেন মানবেন্দ্রবাবু। তিনি বলেন, ‘‘লকডাউন নতুন করে আমাদের ভাবতে শিখিয়েছে। মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। এখন মনে হয়, আমার ক্ষমতা যতই কম হোক, এই পরিস্থিতিতে কিছু কর্তব্য রয়েছে।’’
এ দিন মানবেন্দ্রবাবু নিজের হাতে চল্লিশ জন শিশুকে দিয়েছেন উপহার। পেশায় দিনমজুর কামারবাঁধের মুকুন্দ রায় ও ঝুমা বিশু বলেন, ‘‘দু’বেলা ঠিক করে খাওয়া জোটে না। বাচ্চাদের পড়াশোনার জিনিস কী করে কিনে দেব? খাতা-পেন পেয়ে ওরা খুব খুশি।’’ আর সুজয়ের মা চম্পা সেন বলছেন, ‘‘ছেলের জন্মদিনে বরাবর মন্দিরে পুজো দিতাম। বাড়ির পাশের ছোট ছেলেমেয়েদের একটু পায়েস খাওয়াতাম। তার বেশি কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। এ বার ওর মাথা থেকেই ছোটদের পড়ার জিনিস দেওয়ার ব্যাপারটা বেরোয়। অভাব যে ওকে এই শিক্ষা দিয়েছে, তাতেই আমি খুব খুশি।’’