শেষ বেলার প্রচার। রামপুরহাটে তৃণমূল প্রার্থী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মিছিল।
লড়াই এখানে পঞ্চমুখী!
বীরভূমের এগারোটি আসনের মধ্যে একমাত্র এই কেন্দ্রেই বাম-কংগ্রেসের বোঝাপড়া হয়নি। প্রার্থী রয়েছে কংগ্রেসের। এ দিকে, প্রার্থী তোলেনি ফরওয়ার্ড ব্লকও। আর তৃণমূল, বিজেপি-র প্রার্থী তো রয়েছেই। আর একজন হল আদিবাসী গাঁওতার জেলা নেতা রবীন সরেন।
এই কেন্দ্রে বিজেপি-র প্রার্থী দুধকুমার মণ্ডল। বাম আমলেও ময়ূরেশ্বর মতো অঞ্চলে বিজেপি-র ঝান্ডা অটুট রাখার পরে যাঁর কাঁধে এক সময় ছিল জেলা ‘দখলের’ ভার। এক সময় ‘অপ্রতিরোধ্য’ কেষ্ট-বাহিনীর সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিতে দেখা গিয়েছিল তাঁকেই। ‘রাজনৈতিক সন্ন্যাস’ থেকে ফিরে তিনিই এ বারের প্রার্থী। এই আসন থেকেই লড়ছেন জেলা কংগ্রেস সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মি। প্রার্থী না তোলায় এই আসনে প্রার্থী রয়েছে ফরওয়ার্ড ব্লকেরও। ফব প্রার্থী মহম্মদ হান্নান ১৯৯৬ সালে বিজেপিকে হারিয়ে প্রথমবার এমএলএ হয়েছিলেন। ২০০১ সালে হান্নান যাঁর কাছে হেরে গিয়েছিলেন সেই আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় এ বারও তৃণমূলের প্রার্থী। টানা তিন বার জিতেছেন। আর রয়েছেন গাঁওতা নেতা রবিন।
বাম-কংগ্রেসের তরফে রামপুরহাটে কার প্রার্থী থাকবে, সে প্রশ্নে কম জলঘোলা হয়নি। ভোটের আগে হাঁসন কেন্দ্র নিয়ে জটিলতা কাটলেও জট থেকেই যায় রামপুরহাটে। সিপিএম নেতৃত্ব অবশ্য স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছে, রামপুরহাটে তারা ফরওয়ার্ড ব্লককে নয় কংগ্রেস প্রার্থী জিম্মিকে সমর্থন করবে। সিপিএমের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদা বারবরই বলে এসেছেন, ‘‘তৃণমূলকে হারানোর লক্ষ্যেই আমরা কংগ্রেসকে সমর্থন করার ব্যাপারে সহমত হয়েছি।’’ সেই মতো প্রচার চলেছে। ফব বাদে অন্য শরিকেরাও পাশে দাঁড়িয়েছে কংগ্রেসের। গোটা ঘটনায় তৃণমূলেরই লাভ দেখছেন জেলার রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। জোটের ‘দ্বন্দ্বে’র ফায়দা তুলতে সক্রিয় হয়েছেন শাসকদলের নেতারাও।
গত বিধানসভা এবং লোকসভা ভোটের অঙ্ক বলছে ২০১১ সালে তৃণমূল ভোট পেয়েছিল ৪৫.৮০ শতাংশ। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ফব পেয়েছিল ৩৯.৫৫ শতাংশ ভোট। বিজেপি-র ভোট ছিল ১০.৮৭ শতাংশ। লোকসভায় চতুমুর্খী লড়াইয়ে তৃণমূলের ভোট শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৩৪.০৫ শতাংশে। প্রায় দশ শতাংশ ভোট কমে বামেদেরও। সে সময় উত্থান হয় বিজেপি-র। গত বিধানসভার তুলনায় প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি ভোট পায় তারা। ভোট কমে কংগ্রেসেরও। তবে সব থেকে চিন্তায় রাখছে ভোটের আগের বাম-কংগ্রেসের সমঝোতা। কেননা, নিখাদ পাটিগণিতই বলছে— লোকসভায় একক ভাবে তৃণমূল পেয়েছে ৩৪.০৫ শতাংশ ভোট। সেই হিসেবে বাম-কংগ্রেসের মিলিত ভোট দাঁড়াচ্ছে তার চেয়ে বেশি ৩৭.১১ শতাংশ ভোট।
মিছিল করলেন বিজেপি প্রার্থী দুধকুমার মণ্ডলও।—নিজস্ব চিত্র
অনেকের মত, বিজেপি-র প্রভাব আগের চেয়ে ঢে়ড় কমেছে। সেই ভোট বিরোধীদের ইভিএমে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যদিও তেমনটা মানছেন না এলাকার প্রার্থী দুধকুমার মণ্ডল। জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী তিনি। তা ছাড়া গত বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের গাঁটছড়া ছিল। তাতে এসেছিল ৪৫ শতাংশ ভোট। এ বার কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়া হয়েছে বামেদের। তবে ফব আলাদা প্রার্থী থাকায় তৃণমূলের সুবিধে হতে পারে বলে অনেকের মত।
তবে কাঁটা রয়েছে তৃণমূলের জন্যেও। বিরোধীরা প্রথমেই তুলছেন অনুন্নয়নের অভিযোগ। কেমন? তাঁদের অভিযোগ, তৃণমূল সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই রামপুরহাট এলাকায় তৃণমূল নেতাদের একাংশের পাথর শিল্পাঞ্চল, বালির ঘাট থেকে তোলাবাজি শুরু হয়েছে। রয়েছে গোষ্ঠী কোন্দলও। পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল কর্মাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে গম চুরির মতো অভিযোগও উঠেছে। রয়েছে উন্নয়ন মূলক প্রকল্প থেকে তোলাবাজির অভিযোগও। জেলা সিপিএমের এক নেতার অভিযোগ, ‘‘পুরসভা থেকে পঞ্চায়েত সমিতি হোক আর তারাপীঠ-রামপুরহাট উন্নয়ন পর্ষদের কাজ হোক, দেদার টাকা লুঠ করেছেন তৃণমূল নেতারা।’’ প্রচারেও উঠে আসছে সে সব বিষয়। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছেন, আদিবাসী অধ্যুষিত বড়পাহাড়ি, তুম্বনি, ঠাকুরপুড়া-সহ কুসুম্বা ও মাসড়া এলাকায় পানীয় জলের কষ্ট নিয়েও। জুনিদপুর, নওয়াপাড়া এলাকায় ২০০০ সালের বন্যার পরে আর বাঁধ সংস্কার হয়নি বলেও অভিযোগ। ওই বাম নেতার কথায়, ‘‘এ সবের পরেও রয়েছে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী নিয়োগ, রামপুরহাট হাসপাতাল, রামপুরহাট কলেজে কর্মী নিয়োগ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ।’’
এলাকার তৃণমূল প্রার্থী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিটি বিষয়কেই বিরোধীদের অপপ্রচার বলে গুরুত্ব দিতে চাননি। তিনি বরং বলছেন, ‘‘গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধানসভা এলাকায় যে ভাবে উন্নয়ন যজ্ঞ চলেছে তাতে ভর করেই জিতে যাব।’’ তিনি প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীদের সংগঠন নিয়েও। রামপুরহাট বিধানসভা কেন্দ্রে রামপুরহাট ১ পঞ্চায়েত সমিতির ৯টি পঞ্চায়েত ও মহম্মদবাজার পঞ্চায়েত সমিতির ছ’টি পঞ্চায়েত এবং রামপুরহাট পুরসভা এলাকা পড়ছে। গত লোকসভা ও পুরসভার ভোটে ১৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়া তৃণমূল বাকি ওয়ার্ডগুলিতে বিজেপি-র কাছে হেরেছিল। ২০১৫ সালে পুরসভা নির্বাচনে আবার তৃণমূল ১৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১০টি ওয়ার্ডে জিতে প্রথম বার একক ভাবে বোর্ড গঠন করে। বিজেপি চারটি এবং কংগ্রেস ও সিপিএম দু’টি করে ওয়ার্ডে জেতে। তার আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনেও তৃণমূল প্রথম বার রামপুরহাট ১ পঞ্চায়েত সমিতি দখল করে। জেলা পরিষদের দু’টি আসনের মধ্যে এলাকা থেকে একটি আসন তৃণমূল দখল করে নেয়। রামপুরহাট ১ পঞ্চায়েত সমিতির ন’টি পঞ্চায়েতের মধ্যে আয়াস, কুসুম্বা, বনহাট, কাষ্টগড়া, বরশাল এই পাঁচটি অঞ্চলের দখলও নেয় তৃণমূল। বাম-কংগ্রেস নেতাদের অবশ্য দাবি, ‘‘বেশির ভাগ এলাকাই তো গায়ের জোরে দখল করা!’’ ভোট প্রচারে সাড়া মিলছে বলেও তাঁদের দাবি।
তৃণমূলকে অবশ্য চিন্তায় রাখছে একদা জোটসঙ্গী আদিবাসী গাঁওতা। সংগঠনের জেলা নেতা এ বার প্রার্থী হয়েছেন। তৃণমূল প্রতিশ্রুতি মতো উন্নয়ন করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে তাঁদেরও। অনুন্নয়নের প্রশ্নে প্রচারও চলছে। সম্প্রতি রামপুরহাটে বড়সড় মিছিল করে শক্তি জানান দিয়েছে এই সংগঠন। সংগঠনের এক নেতার কথায়, ‘‘সম্প্রতি আদিবাসী গাঁওতার বিষ দাঁও উপড়ে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। ওই হুঁশিয়ারিই প্রমাণ করে আমরা কতটা প্রাসঙ্গিক।’’