আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় দমকল। শুক্রবার সকালে রামপুরহাটে তোলা নিজস্ব চিত্র।
রাস্তার একটা বড় অংশ বেদখল হয়ে রয়েছে। যেখানে সেখানে যাত্রী তুলছে-নামাচ্ছে যানবাহনও। তার উপর আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ওই জাতীয় সড়কেই চলছে টোটো। সেই বেপরোয়া টোটোর ধাক্কাতেই সাইকেল থেকে রাস্তায় পড়ে গিয়ে দশ চাকার ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যু হল এক স্কুলপড়ুয়ার।
শুক্রবার সকালে রানিগঞ্জ–মোরগ্রাম ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে রামপুরহাট বাসস্ট্যান্ডের অদূরের ওই ঘটনায় উত্তেজনা ছড়াল এলাকায়। দুর্ঘটনায় রামপুরহাট থানার কুমড্ডা গ্রামের আলিমউদ্দিন শেখের (১২) মৃত্যুর পরেই চালক ও খালাসি চম্পট দিলে ক্ষুব্ধ জনতা ট্রাকটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার জেরে সমস্ত রকমের যানবাহন আটকা পড়ে। পরে দমকলের একটি ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে এসে ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ক্রেন দিয়ে পুড়ে যাওয়া ট্রাকটিকে সরানো হয়। প্রায় তিন ঘণ্টা পরে জাতীয় সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। যদিও ঘটনার পরে প্রশ্নের মুখে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা। জাতীয় সড়ককে দখলমুক্ত করার পাশাপাশি বেআইনি টোটোর বিরুদ্ধে কেন অভিযান হচ্ছে না, তা নিয়ে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। এ দিকে পুলিশ জানিয়েছে, ওই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। পুলিশের তরফ থেকেও কোনও মামলা রুজু করা হয়নি। কেউ গ্রেফতার বা আটক হয়নি।
স্থানীয় সূত্রের খবর, আদতে ওই জাতীয় সড়কে রামপুরহাট বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় ফুটপাথে হাঁটার ‘রাস্তা’ নেই। ঘটনাস্থলের এক দিকে রাস্তা দখল করেছে ইমারতি দ্রব্য। একপাশে চা, স্টেশনারি, মুরগি থেকে ফল, তেলেভাজা, লটারির অস্থায়ী দোকান। অদূরেই নিকাশি নালা সংস্কারের পরে ফুটপাথের উপর পড়ে কংক্রিটের ভগ্ন স্ল্যাবের একাংশ। অন্য দিকে, পথ দখল করেই লম্বা ট্রেকার স্ট্যান্ড। যত্রতত্র রাস্তার একাংশ দখল করেছে যন্ত্র চালিত ভ্যান, টোটোও। তার উপরে রয়েছে স্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে আসা বাসের রাস্তার উপর দাঁড়িয়েই যাত্রী তোলানামা। এ সবের পরিণামে জাতীয় সড়কে হাসপাতাল পাড়া থেকে বগটুই মোড় পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন যানজট লেগেই থাকে।
মৃত আলিউদ্দিন শেখ।
তারই মাঝখান দিয়ে এ দিন সকাল ৯টা নাগাদ খুড়তুতো ভাইকে পিছনে বসিয়ে সাইকেলে চালিয়ে গ্রাম থেকে রামপুরহাট হাসপাতাল পাড়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছিল আলিমুদ্দিন। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু বাসস্ট্যান্ড পেরিয়ে এগোতেই ঘটে বিপত্তি। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, রাস্তার ডান দিক ধরে ভুল দিকে এগোচ্ছিল রামপুরহাট হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া আলিম। তখনই সামনে দিক থেকে আসা একটি টোটো তার সাইকেলের হ্যান্ডেলে ধাক্কা মারে। সাইকেল থেকে রাস্তায় ছিটকে পড়ে ওই বালক। তখনই পিছন থেকে দ্রুতগতিতে আসা একটি ট্রাকের তলায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় আলিমউদ্দিনের। রাস্তার ডান দিকে পড়ায় রক্ষা পায় তার খুড়তুতো ভাই নুর মহম্মদ। পরে নুর বলে, ‘‘সামনে থেকে একটি টোটো আমাদের সাইকেলের হ্যান্ডেলে ধাক্কা মারলে সাইকেল ঘুরে যায়। আমি ঝাঁপ দিয়ে রাস্তার অন্য দিকে নেমে পড়ি। দাদা সাইকেল থেকে রাস্তায় পড়ে যায়। পড়ে যেতেই ওর মাথার উপর দিয়ে ট্রাকের চাকা চলে যায়। তার পরে কী হয়েছে, আমি জানি না।’’
এ দিকে, এক বালকের পিষ্ট হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়িতেই বাসস্ট্যন্ড সংলগ্ন এলাকার চার দিক থেকে লরির দিকে ধেয়ে আসে উত্তেজিত জনতা। প্রাণের ভয়ে ট্রাক থেকে নেমে দৌড়ে পালিয়ে যান চালক ও খালাসি। উত্তেজিত জনতা প্রথমে ইট দিয়ে লরির কাচ ভেঙে ফেলে। তার পরেই ট্রাক থেকেই শাবল বের করে ট্যাঙ্কার ফুটো করে দিয়ে পেট্রোল ছড়িয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। জাতীয় সড়কের উপর ট্রাকে আগুন জ্বলছে দেখে ঘটনাস্থলে ভিড় জমতে শুরু করে। ইতিমধ্যে পুলিশের গাড়ি এসে মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়না-তদন্তের জন্য হাসপাতালে নিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে ৫০ মিটার দূরে রাস্তার দু’দিকে সরকারি, বেসরকারি বাস, ট্রাক-সহ নানা যানবাহন সার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। পরে ক্রেন এসে ট্রাক সরিয়ে নিয়ে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
মৃত ছাত্রের মা-বাবা এ দিন কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। আলিমের এক আত্মীয় বলেন, ‘‘ক’দিন আগেই মহরমের লাঠি খেলায় ও গ্রামে সুনাম কুড়িয়েছিল। এমন ফুটফুটে একটা ছেলে যে এ ভাবে মারা যাবে, তা ভাবতেও পারছি না!’’ এ দিন যে আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছিল ওই বালক, সেই আসিফ ইকবাল জানান, আলিম এলাকায় শান্ত ছেলে বলে পরিচিত ছিল। পড়াশোনাতেও মেধাবী। এমন ছাত্রের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তাদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন আসিফ।
অন্য দিকে, এসডিও (রামপুরহাট) সুপ্রিয় দাস বলেন, ‘‘জাতীয় সড়কে টোটো চলাচল নিষিদ্ধ। ওই ঘটনায় টোটো জড়িত থাকলে, তার চালকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ পাশাপাশি আজ, শনিবার থেকেই জাতীয় সড়কে টোটো চলাচল নিষিদ্ধ করতে পুলিশ-প্রশাসন নজরদারি চালাবে বলে সুপ্রিয়বাবু আশ্বাস দিয়েছেন। টোটোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর আশ্বাস দিয়েছেন জেলা পরিবহণ আধিকারিক আশিস কুণ্ডুও।