বিতর্কিত: জোড় বাংলা মন্দিরের সামনে পুরসভার নির্মীয়মাণ বাতিস্তম্ভ। শনিবার বিষ্ণুপুরে। নিজস্ব চিত্র
কয়েকবছর ধরে অন্ধকারে ডুবে রয়েছে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের ঐতিহ্যবাহী মন্দিরগুলি। তবে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ জানিয়েছে, রাসমঞ্চ, জোড়বাংলা ও শ্যামরাই মন্দিরে তারা বিজ্ঞানসম্মত ভাবে আলো বসাতে চলেছে। তার আগেই জোড়বাংলা মন্দিরের কাছে পুরসভা ‘হাইমাস্ট’ আলো বসাতে উদ্যোগী হওয়ায় তাদের সঙ্গে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের বিরোধ শুরু হয়েছে।
বিষ্ণুপুরের শিল্পসুষমা মণ্ডিত মন্দিরগুলি দেখতে প্রায় বছরভর পর্যটকদের আনাগোনা এই শহরে রয়েছে। কিন্তু আলোর ব্যবস্থা না থাকায় সন্ধ্যা নামলেই মন্দিরগুলি অন্ধকারে ডুবে যায়। তা নিয়ে পর্যটকদের হতাশার সঙ্গে বাসিন্দাদের আক্ষেপও জড়িয়ে ছিল। বছরখানেক ধরে কিছু মন্দিরে আলোর ব্যবস্থা করা হলেও, পরে সে সব বিকল হয়ে যায়। কিন্তু তার পরেও কেন আলোর ব্যবস্থা করা হয়নি, তা নিয়ে ক্ষোভ ছিল।
বিষ্ণুপুর পুরসভা সূত্রের খবর, পর্যটকদের আক্ষেপ ঘোচাতে রাসমঞ্চের সামনে উচ্চ বাতিস্তম্ভ বসানোর কাজ শুরু হয় প্রায় মাস দুয়েক আগে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের সংরক্ষিত সৌধের কাছে কোনও নির্মাণ করতে গেলে তাদের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে পুরসভা তা নেয়নি বলে অভিযোগ তুলে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ ‘হাইমাস্ট’ বসানোর কাজ আটকে দেয়। ৯ জানুয়ারি বিষ্ণুপুর উপমণ্ডল থেকে নির্মাণ কাজ বন্ধের চিঠি পাঠানো হয় বিষ্ণুপুর পুরসভায়।
ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের বিষ্ণুপুর উপমণ্ডলের কনজারভেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট রোহিত কুমার বলেন, ‘‘মানুষের স্বার্থে এলাকায় আলোর ব্যবস্থা করা যায়। তবে সে ক্ষেত্রে আমাদের দফতরে আগাম অনুমতি নিতে হয়। পুরসভা তা করেনি। তাই চিঠি দিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছিল। সে সময়ে সাময়িক ভাবে কাজ বন্ধ রাখা হলেও সপ্তাহখানেক পরে ফের কাজ শুরু করা হয়েছে।’’
তিনি জানান, ১৭ জানুয়ারি ফের নির্মাণ কাজ বন্ধের চিঠি পাঠানো হয় পুরপ্রধান, মহকুমাশাসক, পুলিশ আধিকারিকের দফতরে। তবে নির্মাণ বন্ধ করা হয়নি। এর পরে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ ২০ ফেব্রুয়ারি বাঁকুড়ার জেলাশাসককে সেই চিঠির অনুলিপি পাঠায়। দফতরের একটি সূত্রের দাবি, এরপরেও কাজ বন্ধ না করা হলে, আইনি পদক্ষেপ করা হবে। মহকুমাশাসক (বিষ্ণুপুর) মানস মণ্ডল বলেন, “বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি।’’
রোহিতবাবু বলেন, “রাসমঞ্চ, শ্যামরাই ও জোড়বাংলা— তিনটি মন্দিরেই আলোর ব্যবস্থা করার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তার আগেই পুরাতত্ত্ব বিভাগের অনুমতি ছাড়া, অবৈধ ভাবে মন্দির চত্বরে উচ্চ বাতি স্তম্ভ নির্মাণ শুরু করেছে পুর দফতর। তা ছাড়া, শ্যামরাই মন্দিরের রাস্তায় পুরসভা পথবাতি বসালেও এখন তা অকেজো হয়ে রয়েছে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। রক্ষণাবেক্ষণ না করে মন্দিরের দৃশ্যদূষণ করা যায় না।’’
পুরপ্রধান শ্যাম মুখোপাধ্যায় বলেন, “পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ পর্যটকদের কাছে রাজস্ব আদায় করছে, অথচ মন্দির অন্ধকারে থাকছে! অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যাচ্ছেন পর্যটকেরা। তাই আমরা পুরসভা থেকে আলোর ব্যবস্থা করছি। এতে বাধা দেওয়ার কিছু নেই।’’ তাঁর দাবি, ‘‘৬০ ফুট উপরে আলো জ্বলবে। তাতে মন্দিরের ক্ষতি হওয়ার কথা নেই।” যদিও রোহিতবাবুর দাবি, ‘‘মন্দিরের সামনে উঁচু বাতিস্তম্ভ বসালে সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে। আলোর তীব্রতায় মন্দিরের ক্ষতি হবে। তাই আমরাই বিজ্ঞানসম্মত ভাবে আলোর ব্যবস্থা করছি।’’
কলকাতা থেকে বিষ্ণুপুর বেড়াতে এসেছেন চন্দ্রিমা সেনগুপ্ত , রুমা বন্দ্যোপাধ্যায়, শকুন্তলা সেনগুপ্তেরা। তাঁদের দাবি, “মন্দিরের গায়ে জোরাল আলো দেওয়া যায় না। এতে শুধু দৃশ্যদূষণ নয়, প্রাচীন স্থাপত্য টিকিয়ে রাখাও অসম্ভব হয়ে পড়বে।’’ আবার স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে কাঞ্চন পাত্র, দশরথ দে জানান, মন্দিরে আলো দিলে রাত পর্যন্ত পর্যটকেরা আসবেন। কেনাকাটাও চলবে। তবে গাইড অসিত দাসের মতে, “মন্দির চত্বর আলকিত হোক, কিন্তু তাতে যেন মন্দির না নষ্ট না হয়।’’