মিড-ডে মিলেও মন্দ কপাল

লাগবে হয়তো ন’হাজার টাকা। কিন্তু মিলছে দু’হাজার। তাই ধারদেনা ছাড়া গতি নেই। এ ভাবেই দিনের পর দিন স্কুলে স্কুলে মিড ডে মিল চালাচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। আর কত দিন চালাতে পারবেন, তা নিয়ে নিজেরাই ঘোরতর সংশয়ে। ঘুরে দেখল আনন্দবাজারযে দিন ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল হয়েছে, তার দু’দিন পর থেকে রাতে ঠিক মতো ঘুমোতে পারছেন না উত্তর দিনাজপুর জেলার ডালখোলার ভূষামণি-১ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক গুলজার হোসেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৬ ০২:৩৭
Share:

এই খাবারও আর জুটবে কিনা, অনেক স্কুলেই সংশয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকারা। ওদলাবাড়ির একটি স্কুলে ছবিটি তুলেছেন সব্যসাচী ঘোষ।

ঘুম নেই

Advertisement

যে দিন ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল হয়েছে, তার দু’দিন পর থেকে রাতে ঠিক মতো ঘুমোতে পারছেন না উত্তর দিনাজপুর জেলার ডালখোলার ভূষামণি-১ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক গুলজার হোসেন। কারণ, তাঁর স্কুলে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ১০৯ জন পড়ুয়া রয়েছে। তাঁর হাতে নগদ টাকা নেই। ব্যাঙ্ক থেকে ১০০ টাকার নোট মিলছে না। ব্যাঙ্কে গিয়ে দু’হাজার টাকার একটি নোট পেয়েছেন। পাড়ার যে মুদি দোকান থেকে তেল-মশলা, ডিম, সয়াবিন কেনেন, সেখানে সেটি ভাঙানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই দু’দিন ধরে রাঁধুনিদের হেঁসেলের ভরসায় চলছে মিড ডে মিল। রাঁধুনিরাই নানা জায়গা থেকে ডাল, সয়াবিন ও সব্জি এনে মিড ডে মিল রান্না স্বাভাবিক রেখেছেন। প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘‘এ ভাবে কত দিন চলবে, সেটাই বুঝতে পারছি না!’’ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন শিক্ষক নেতারাও। অজয় রায়চৌধুরী রায়গঞ্জের কসবা মহেশো স্কুলের শিক্ষক। বললেন, ‘‘মিড ডে মিলের রান্নার সামগ্রী ও জ্বালানি বাকিতে কিনতে বাধ্য হচ্ছি আমরা।’’ আর এক শিক্ষক কৃষ্ণেন্দু রায়চৌধুরীর দাবি, বেশ কিছু স্কুল মিড ডে মিলের টাকা তুললেও ব্যাঙ্ক থেকে ২০০০ টাকার নোট দেওয়া হচ্ছে। বাজারে ১০০ টাকার নোটের অভাব থাকায় সেই নোট ভাঙানোই যাচ্ছে না। ফলে বহু শিক্ষক নিজের টাকায় বাজার করছেন।

Advertisement

কী হবে কাল

স্কুল বাদ দিয়ে কাঁহাতক লাইনে দাঁড়ানো যায়! বিড়বিড় করছিলেন মালদহের চাঁচলের গোয়ালপাড়া প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহম্মদ ইব্রাহিম।

গ্রামীণ ব্যাঙ্কে স্কুলের অ্যাকাউন্ট রয়েছে। প্রথম দিন চার ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে প্রধান শিক্ষক পেয়েছেন পাঁচশো টাকা, পরদিন পাঁচ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে হাজার টাকা। তার পর থেকে টাকা তোলাও বন্ধ। টানা কয়েক দিন ধরে সব্জির দোকান বাকি দেওয়ার পরে, ‘না’ বলে দিয়েছে। তার পরেই সব্জি ছেড়ে শুধু আলুতে ফিরতে হয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষকে। শুক্রবার দেখা গেল পড়ুয়াদের থালায় ভাত এবং ছোট ছোট দু’টুকরো আলু এবং হলুদ-লঙ্কা গুঁড়োর ঝোল। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘‘পড়ুয়াদের পাতে শুধু আলুর ঝোল দিতে মন চায় না। কিন্তু কী করব, টাকা কোথায়। কোনও ভাবে সামলে নিচ্ছি। না হলে তো এই রান্না করাও সম্ভব হতো না।’’ চাঁচলের মোহনপুর প্রাথমিক স্কুল কর্তৃপক্ষ এর মধ্যে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদকে জানিয়েছেন, এমন পরিস্থিতিতে বেশি দিন রান্না চালানো সম্ভব নয়। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রভাস দাস বলেন, ‘‘আজ না হয় আলুর ঝোল জুটছে। কাল কী হবে, তা বলতে পারব না।’’

হাতে চেক

চেক বই নিয়ে বাজারে ঘুরতে হচ্ছে মালদহের গাজোলের শ্যামসুখী বালিকা শিক্ষা নিকেতনের প্রধান শিক্ষিকা প্রতিভা পোদ্দারকে। কী করবেন? ব্যাঙ্কে টাকা তোলার লাইনে দাঁড়ালে গোটা দিন কাবার হয়ে যাবে। শুধু মিড ডে মিলের পিছনে থাকলে হবে না, স্কুলও চালাতে হবে। তাই চেক বই নিয়েই বাজারে বের হয়েছিলেন তিনি। সব্জি বিক্রেতাদের অনেকেই চেকের মাধ্যমে প্রথমে টাকা নিতে অস্বীকার করেন। শেষে প্রধান শিক্ষিকাকে প্রায় ক্লাস করানোর মতো সকলকে চেকের সুবিধে-অসুবিধে বোঝাতে হয়। শেষে তিনি চেক দিয়েই মুদি এবং সব্জি দোকানের টাকা মেটাতে শুরু করেছেন। প্রধান শিক্ষিকার কথায়, ‘‘কাজটা খুব একটা সহজ ছিল না। কিন্তু মিড ডে মিল না হলে তো স্কুলও চলবে না। হাতে টাকা নেই। তাই চেক বই।’’

ভোটে স্বস্তি

কোচবিহারের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশকে অবশ্য কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে উপ-নির্বাচন। ভোটের জন্য কিছু স্কুল গত ১৬ নভেম্বর থেকে বন্ধ। বাকিগুলিও শুক্রবার থেকে ছুটি। সোমবারের আগে স্কুল খোলার কথা নয়। ফলে এই ক’দিনের জন্য নিশ্চিন্ত। ভাবতে হচ্ছে না মিড ডে মিল নিয়ে। তবে যে স্কুলগুলিতে ভোটকেন্দ্র নেই, সেগুলি খোলা। সমস্যা তৈরি হয়েছে সেখানেই। কোচবিহার শহর লাগোয়া একটি প্রাথমিক স্কুলের কর্তৃপক্ষ পাড়ার মুদির দোকানে বাকির খাতা শুরু করেছেন। প্রধান শিক্ষকা নিজে মুদির দোকানে গিয়ে ‘জিম্মাদার’ হয়েছেন। তার পরেই ব্যবসায়ী বাকিতে জিনিস দিতে রাজি হয়েছেন। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সুলতা ঘোষ বলেন, “মাঝে মধ্যে বাকিতে চালাতে হচ্ছে।”

ভরসা সয়াবিন

ইসলামপুরে সব্জি নয়, শুধু ডিম-সয়াবিন। নগদ ছাড়া সব্জি বাজারে লেনদেন হয় না। তাই ভরসা সয়াবিন। প্রাথমিক স্কুল হোক কিংবা শিশু শিক্ষা কেন্দ্র, অনেক স্কুলেই প্রধান শিক্ষককে মিড ডে মিলের খাওয়ানোর দায়িত্ব সামলাতে হয়। কোনও প্রধান শিক্ষক সব্জি বাজারের পাইকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাকিতে সব্জি নিচ্ছেন স্কুলের জন্য। ইসলামপুরের কোদালদহ প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জীবেশ ঘোষ বলেন, ‘‘দোকানিদের বাকিতে সব্জি দেওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। স্কুলের জন্য ব্যাঙ্কেও লাইন দেওয়া যাচ্ছে না। বাড়িতে খুচরো যা ছিল, তা দিয়েই সামান্য করে সব্জি কিনছি। তবে বেশির ভাগ মুদি দোকান থেকে সয়াবিন, ডাল নিয়ে কোনও রকমে চালাচ্ছি।’’ ইসলামপুরের কদমগাছি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক শুভ বৈদ্য বলেন, ‘‘সব্জির পাইকারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁর কাছ থেকেই বাকিতে সব্জি নিয়ে যাচ্ছি।’’ তবে গোয়ালপোখরের এক প্রাথমিক স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মাসুদ আলমের কথায়, ‘‘সব্জি দোকানে বাকি পাওয়া কঠিন। তাই সয়াবিন, ডালই ভরসা। সব কিছু ঠিক না হওয়া পর্যন্ত এই ভাবেই চালাতে হবে।’’

ধারে কর্জে

শিলিগুড়ির হাই স্কুলগুলিতে পরীক্ষা চলছে। তাই তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিড ডে মিল বন্ধ। প্রাথমিক স্কুলগুলিতেই সমস্যা। মাল্লাগুড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মিড ডে মিলে তাই ডাল, আলু সেদ্ধ খাওয়ানো হচ্ছে। কখনও সয়াবিনের তরকারি ভাত বা খিচুড়ি আলুভাজা। প্রধান শিক্ষিকা মনোশ্রী মিত্র বলেন, ‘‘ব্যাঙ্কে যে হারে লম্বা লাইন পড়ছে, তাই যাওয়া হয়নি। স্কুল ফেলে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না।’’ তাই বাকি ছাড়া পথ নেই। কিন্তু অনেক সময়েই সব্জি বাকিতে পাওয়া মুশকিল। ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে হাকিমপাড়ার উদয়ন সমিতি স্কুলেও একই ভাবে বাকিতে ডিম এনে মিড ডে মিলের রান্না হচ্ছে। তখনও শিক্ষকেরা নিজেদের কাছ থেকে টাকা দিয়ে সব্জি বাজার করছেন। সরকারি ভাবে স্কুলগুলিতে চাল পৌঁছে দেওয়া হয়। রান্নার লোকের টাকাও তাদের অ্যাকাউন্টে সরাসরি দেওয়া হয়। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা মৈত্রেয়ী সিংহ বলেন, ‘‘স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষিকারা দুই হাজারের মতো টাকা দিয়েছি। তা দিয়ে সব্জি বাজার করা হয়েছে। বাকিতে ডিম আনা হচ্ছে। স্কুলের টাকা তুলে শিক্ষকদের টাকা পরে মিটিয়ে দেওয়া হবে।’’ বাঘা যতীন পার্কে ডাবগ্রাম-২ জিএসএফপি প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক নির্মলেন্দু দাস জানান, তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে ব্যাঙ্ক থেকে স্কুলের মিড ডে মিলের সাত হাজার টাকা তুলতে পেরেছেন। তা দিয়েই মিড ডে মিল চলছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement