বিশাখাপত্তনম থেকে শিলিগুড়ি। দলের পার্টি কংগ্রেস শেষের পরে সোজা পুরভোটের প্রচারে এলেন রায়গঞ্জের সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম। পলিটব্যুরো সদস্য নির্বাচিত হওয়ার জন্য তাঁকে সংবর্ধনা জানালেন ৬ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী তথা মেয়র পদপ্রার্থী প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। শিলিগুড়ির ডাঙ্গিপাড়ায় বিশ্বরূপ বসাকের ছবি।
প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিলেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী তথা বামেদের মেয়র পদপ্রার্থী অশোক ভট্টাচার্য। ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে, ততই সেই ডাকের জোর বাড়াচ্ছেন বামেরা। সোমবার তাঁদের সঙ্গী হলেন সদ্য পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম। একই ভাবে প্রচারে ঝড় তুলতে চাইছেন বিজেপি নেতারাও। বিরোধীদের এই সমবেত প্রচারের মুখে তৃণমূল যে যথেষ্ট চাপে, সেটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে মন্ত্রী গৌতম দেবের কথায়। তিনি এক বার সন্ত্রাসের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। পরক্ষণেই আবার বলেছেন, আক্রান্ত তো তৃণমূল কর্মীরাই! শেষতক তাঁর অঙ্গীকার, শিলিগুড়িতে দায়িত্ব নিয়ে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট করাবেন তাঁরা।
কলকাতা পুরভোট মেটার পরে প্রচারে শেষ পর্বে এখন শিলিগুড়ি যেন ‘হট বেড’! সকাল থেকে মহল্লায়-মহল্লায় রাজ্যের শীর্ষ নেতাদের আনাগোনা। বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ থেকে অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়, কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া থেকে প্রদীপ ভট্টাচার্য, সিপিএমের সেলিম— সকলেই এ দিন শিলিগুড়ি প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন। কেউ ভোটের আগের দিন নির্বাচন কমিশন এবং কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে রাজ্যপালের কাছে যাওয়ার কথা বলে রাজ্য সরকারের উপর চাপ বাড়াতে চেয়েছেন।
সোমবার বিশাখাপত্তনম থেকে শিলিগুড়ি পৌঁছে অশোকবাবুদের সঙ্গে যোগ দিলেন সেলিম। শিলিগুড়ি পুরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে বামেদের মেয়র পদপ্রার্থী অশোকবাবু। সেই ওয়ার্ডেরই ডাঙ্গিপাড়ার কুরেশি মহল্লায় ভোট-প্রচারে সেলিমের বার্তা, ‘‘কাউকে ভয় পাবেন না। যাঁরা ভোটে জিতে লুটপাট করেন, ডেলো পাহাড়ে গিয়ে মিটিং করেন, তাঁদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই। অন্যায় দেখলে রুখে দাঁড়াবেন।’’ একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘‘শিলিগুড়ির ঐতিহ্য আলাদা। সেখানে ভয় দেখিয়ে ভোট করানোর চেষ্টা মানুষ বরদাস্ত করেনি, করবে না। কেউ ভয় দেখালে আমরা সকলে মিলে রুখে দাঁড়াব।’’
এই একই ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থী অরুপরতন ঘোষের হয়ে প্রচারে নামা নেতারা অবশ্য ‘সন্ত্রাস’-এর অভিযোগ শুনে আকাশ থেকে পড়েছেন। চাপের মুখে তাঁরা তুলে এনেছেন বাম আমলে ‘দমবন্ধ’ পরিবেশের কথা। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী তৃণমূলের দার্জিলিং জেলা সভাপতি গৌতম দেব বলেন, ‘‘ভোটে হারতে হবে টের পেয়েই বিরোধীরা সন্ত্রাসের আগাম আশঙ্কা বাসিন্দাদের জানিয়ে রাখলেন।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘শিলিগুড়িতে সন্ত্রাসের কোনও পরিবেশ নেই। এখানে উল্টো আমাদের কর্মীরাই আক্রান্ত হচ্ছেন।’’ একই সঙ্গে তাঁর দাবি, ‘‘আমরা দায়িত্ব নিয়ে শিলিগুড়িতে অবাধ এবং শান্তিপূর্ণ ভোট করাব।’’ তাঁর সঙ্গী হয়ে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, ভাইচুং ভুটিয়া, তমোনাশ ঘোষ, মহুয়া মৈত্রও সকাল থেকে রাত অবধি শহরের এ মাথা-ও মাথা প্রচার চালালেন। বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর উন্নয়নে সামিল হয়েই কলকাতার মতোই ‘শান্তিতে’ ভোট হবে শিলিগুড়ি-সহ উত্তরবঙ্গে।
শাসক দলের কলকাতায় শান্তিতে ভোট করানোকে ‘কলকাতা মডেল’ বলে কটাক্ষ করেছেন বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ কিংবা লকেট চট্টোপাধ্যায়। গত রবিবার তেকে ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে ঘুরে বিস্তর অভিযোগ পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন। তাঁরা জানান, তৃণমূল সন্ত্রাসের আশঙ্কা করে রাজ্যের ৯১টি পুরসভার ভোটের আগের দিন-ই নালিশ জানাতে রাজ্যপালের কাছে যাচ্ছেন তাঁরা। কলকাতা ভোটে সন্ত্রাসের ব্যপক অভিযোগ ওঠার পরে, পরের পর্যায়ে আগামী শনিবার পুরভোটের আগে রাজ্য সরকারের উপর ‘চাপ’ তৈরি করতেই আগের দিন রাজ্যপালের কাছে প্রতিনিধি পাঠানো হচ্ছে বলে বিজেপি সূত্রের খবর। তবে কী ভাবে সন্ত্রাসের প্রতিরোধ হবে তা শুনিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা। শিলিগুড়িতেই শাসক দল ভোটের আগে হাড়-হিম করা সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘শুনলাম শিলিগুড়িতেও ব্যবসায়ীদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে শাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সরকারি কর্মীদের দেখে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তৃণমূল বলছে পুরসভা দখল করতে হবে।’’ এই আশঙ্কার দলের কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে মানসবাবুর বার্তা, ‘‘শিলিগুড়িতেও একজন পুলিশ কমিশনার আছেন, সংযোজিত এলাকা দেখার জন্য জলপাইগুড়ি পুলিশ সুপার আছেন। তবে কাউকে বিশ্বাস করবেন না। পুলিশে কোনও আস্থা রাখবেন না। যা করার আপনাদেরই করতে হবে। নিজেদের উপর ভরসা রাখুন।’’ যেমন, বিজেপির নেত্রী অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়ের গলাতেও। শহরের রামকৃষ্ণ নগরের রোড শোয়ের মাঝে তিনি বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী আসুক বা না আসুক। দলের কর্মীদের বলেছি নিজের উপরে ভরসা রাখুন। মানুষই সন্ত্রাসের প্রতিরোধ করবে।’’ বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ বলেন, ‘‘কমিশনের কাছে গিয়ে কোনও ফল মিলবে না জানি, তবু যেহেতু আইন এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোয় প্রথমে কমিশনে অভিযোগ করার কথা বলা হয়েছে, তাই কমিশনেও যাব। পরে রাজ্যপালের দ্বারস্থ হব।’’
কলকাতা ভোট মেটার এক দিন পরে, কর্মী-সমর্থকদের অভয় দিতে ‘কলকাতা মডেলে’র বিরুদ্ধে এ ভাবেই ‘প্রতিরোধে’র ডাক দিলেন বিরোধীরা।