চিতাবাঘটিকে ধরছেন বনকর্মীরা। সোমবার রায়গঞ্জে।— নিজস্ব চিত্র
খাস রায়গঞ্জ শহরে ১১ ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালাল চিতাবাঘ। জখম করল মোট ১২ জনকে। দুপুরে একবার কুকুর ধরা জাল দিয়ে ধরতে গেলে, তা ছিড়ে, আশপাশের কয়েক জনকে আঁচড়ে-কামড়ে পালায় সে। বিকেলে ঘুমপাড়ানি গুলি ছুড়ে তাকে পাকড়াও করেন বনকর্মীরা। কিন্তু ঘন জনবসতির রায়গঞ্জ শহরে এই পূর্ণবয়স্ক চিতাবাঘটি কোথা থেকে এল, সেটিই এখন সকলের কাছে বড় প্রশ্ন। বনকর্তারাও জবাব হাতড়াচ্ছেন। কেউ বলছেন, সম্ভবত বিহারের বনাঞ্চল থেকে চলে এসেছিল চিতাবাঘটি। কারও আবার সন্দেহ, পাচার করার সময়ে সেটি কোনও ভাবে পালিয়ে এসে শহরে ঢুকে পড়ে।
রায়গঞ্জে চিতাবাঘ ঢুকে পড়ার ঘটনা চট করে মনে করতে পারলেন না বাসিন্দাদের কেউই। সকাল সাতটা থেকে গোটা শহরকে স্রেফ দৌড়ের উপরে রাখল চিতাবাঘটি। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে কলোনি এলাকার বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, ওই সময়ে চিতাবাঘটিকে প্রথম দেখা যায়। রাস্তার সব কুকুর ততক্ষণে লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। আতঙ্কিত হয়ে বাসিন্দারা ছোটাছুটি করতে থাকেন। এর মধ্যে কেউ ঢিল মারলে চিতাবাঘটি আরও ঘনবসতি এলাকায় ঢুকে পড়ে। তখন লাঠি হাতে তাকে তাড়া করে জনতা। সেই তাড়ায় প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে গ্যাস গুদাম এলাকায় চলে যায় জন্তুটি। এর পরে চিতাবাঘটিকে দেখা যায় কলেজপাড়ার বাঁশঝাড়ের কাছে। কিছু ক্ষণের মধ্যে তাড়া খেয়ে সেখান থেকেও উধাও হয়ে যায় সে। খানিক পরে তার দেখা মেলে সংশোধনাগারের কাছে।
এই লুকোচুরির মধ্যেই পুলিশ, বন দফতর ও পশুপ্রেমী সংগঠন পিপল ফর অ্যানিম্যালের সদস্য মাঠে নেমে পড়েন। এক বার তো হাতের মধ্যেও পেয়েও যান চিতাবাঘটিকে। বেলা তখন ১২টা। তার মাথায় হেলমেটও পরিয়ে দেন তাঁরা। কিন্তু হেলমেট ভেঙে, জাল ছিঁড়ে পালিয়ে যায় জন্তুটি।
শেষে বিকেলের দিকে চিতাবাঘটি ইন্দিরা কলোনির বাসিন্দা বিপ্লব দাসের শোওয়ার ঘরে সটান ঢুকে পড়ে। তখন ঘরে কেউ ছিল না। কয়েক জন দ্রুত ঘরের শেকল বাইরে থেকে তুলে দেন। বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ সুকনা থেকে শিলিগুড়ির মহানন্দা বন্যপ্রাণ বিভাগের কর্মীরা পৌঁছন। প্রথমে দু’টি মুরগি জানালা দিয়ে ঢুকিয়ে দেন বনকর্মীরা। চিতাবাঘটি সেই দুটিকে খাওয়ার সময় তাকে ঘুমপাড়ানি গুলি ছুড়ে অজ্ঞান করা হয়। তার পর সেটিকে কুলিক পক্ষীনিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। চিতাবাঘটির পিছনে যে ভাবে শহরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা ছুটোছুটি করেছেন, তার ছবি তুলতে গিয়েছেন বারবার, তাতে ক্ষুব্ধ শহরের স্বেচ্ছাসেবী ও পশুপ্রেমীরা। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘এর ফলে চিতাবাঘটি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। না হলে আগেই সেটিকে ধরা যেত।’’
কিন্তু পূর্ণবয়স্ক চিতাবাঘটি কী ভাবে জনবসতির মধ্যে এল, তা নিয়ে রহস্য এখনও কাটেনি। বিহারের ঠাকুরগঞ্জ বা বারসই বনাঞ্চল রায়গঞ্জ থেকে ৫০ কিলোমিটার। এই পথটা চিতাবাঘের কাছে খুব বেশি দূরত্ব নয় বলেই জানাচ্ছেন বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞরা। সেখান থেকে তাড়া খেয়ে দলছুট হয়ে হয়তো পালিয়ে এসেছে এই জন্তুটি। তাতেও প্রশ্ন থেকে যায়, এর আগে তো ওই সব জায়গা থেকে কোনও চিতাবাঘ রায়গঞ্জে আসেনি। তা হলে এটি হঠাৎ এল কেন?
উত্তর দিনাজপুরের ডিএফও দ্বীপর্ণ দত্ত-ও স্বীকার করলেন, ‘‘চিতাবাঘটি যে কোথা থেকে এল, সেটাই আশ্চর্যের ব্যাপার।’’ দ্বীপর্ণবাবুর আরও আশঙ্কা, ‘‘হতে পারে কোনও জায়গা থেকে হয়তো চিতাবাঘটিকে গাড়িতে চাপিয়ে পাচার করা হচ্ছিল। কোনও ভাবে সে ছাড়া পেয়ে জাতীয় সড়কে নেমে শহরে ঢুকে পড়ে। এটা নিয়ে আরও তদন্ত হওয়া দরকার।’’