হেলিকপ্টার নামানোর মহড়া চলছে। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।
শহরের ফুসফুস হিসাবে পরিচিত বহরমপুরের ২৪৭ বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক ব্যারাক স্কোয়ার মাঠের সবুজ ধ্বংস হচ্ছে সরকারি উদ্যোগে। বরাবরের ওই অভিযোগ ফের উস্কে দিয়েছে শনিবার ও রবিবার রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দু’দিনের মুর্শিদাবাদ জেলা সফরের জন্য ব্যারাক স্কোয়ার মাঠের প্রায় পুরো এলাকা জুড়ে তিনটি হেলিপ্যাড তৈরি করায়। সবুজ ঢেকে দিয়ে ইট ও বালির অস্থায়ী তিনটি হেলিপ্যাড তৈরি করা হয়েছে। হেলিপ্যাডে রাষ্ট্রপতির কনভয় যাতায়াতের জন্য সবুজ ঘাসের আস্তরণ ঢেকে গুড়ো পাাথরের ঘেস দিয়ে তৈরি করা হয়েছে অস্থায়ী সড়কপথ। হেলিপ্যাডের চারপাশে হাজার খানেকের বেশি বাঁশ দিয়ে গড়া হয়েছে দু’ সারির ব্যারিকেড। বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে, এক কিলোমিটার দূরে স্টেডিয়াম মাঠের বিশাল এলাকা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকলেও সেখানে কেন হেলিপ্যাড তৈরি করা হয় না। প্রশ্ন উঠেছে, ভিভিআইপি-রা কপ্টারে করে অতীতে জেলা সফর করেছেন, ভবিষ্যতেও করবেন তবুও আজও কেন বহরমপুর শহরে স্থায়ী হেলিপ্যাড তৈরি করা হয়নি?
মুর্শিদাবাদ জেলার পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “হেলিপ্যাড করার জায়গা নির্বাচন করা পুলিশের বিষয় নয়। যেখানে হেলিপ্যাড করা হবে সেখানেই নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য পুলিশ মোতায়েন করা হবে। হেলিপ্যাডের বিষয়টি রয়েছে জেলাশাসকের এক্তিয়ারে।” মুর্শিদাবাদ জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর রাও বলেন, “রাষ্ট্রপতির বিষয়টি হায়েস্ট প্রোটোকলের বিষয়। সেই জন্য হেলিপ্যাডের ক্ষেত্রে ব্যারাক স্কোয়ার উত্তম স্থান। তাই সেখানে হেলিপ্যাড করা হয়েছে।” তাতে অবশ্য মাঠের কোনও ক্ষতি হবে না বলে দাবি করে জেলাশাসকের বক্তব্য, “রাষ্ট্রপতির জেলা সফর শেষ হয়ে গেলে ওই মাঠ ফের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে।” আগামী কাল শনিবার বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠান রয়েছে। সেই কারণে ব্যারাক স্কোয়ারে হেলিপ্যাড করা হয়েছে।
ওই অনুষ্ঠানে থাকবেন রাষ্ট্রপতি ছাড়াও কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি হিসাবে স্থানীয় সাংসদ অধীর চৌধুরী। জেলাশাসকের আশ্বাসে তিনি অবশ্য ভুলছেন না। অধীর চৌধুরী বলেন, “সবুজ ধ্বংস করে ব্যারাক স্কোয়ারে হেলিপ্যাড করার তীব্র প্রতিবাদ করছি। স্টেডিয়াম মাঠে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে বিশাল এলাকা। সেখানে হেলিপ্যাড করলে ঐতিহাসিক ব্যারাক স্কোয়ার মাঠের সবুজ ধ্বংস হত না।” শতাধিক লরি বোঝাই ইট, বালি, পাথরের গুড়ো, ঘেস দিয়ে তৈরি অস্থায়ী হেলিপ্যাডের এলাকা কোনও মতেই পূর্বের অবস্থায় ফেরানো সম্ভব নয়। এ কথা জানিয়ে সাংসদ বলেন, “প্রণববাবুও প্রকৃতি প্রেমী। তিনিও সবুজ ধ্বংস করে হেলিপ্যাড তৈরি করার বিষয় পছন্দ করবেন না। শনিবার আমার সঙ্গে রাষ্ট্রপতির দেখা হবে। তখন ব্যারাক স্কোয়ারের সবুজ ধ্বংস করে হেলিপ্যাড তৈরির বিষয়টি তাঁর গোচরে আনব। প্রশাসনের ভূমিকা মনে করিয়ে দিচ্ছে, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দর প্রবাদটি।” ব্যারাক স্কোয়ার মাঠে সবুজ ধ্বংস করে হেলিপ্যাড তৈরির ব্যাপারে কৃষ্ণনাথ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কল্যাণাক্ষ ঘোষের প্রশাসনের প্রতি কটাক্ষ, “সূর্যের চেয়ে বালির তাপ বেশি।”
ব্যারাক স্কোয়ার মাঠে রাষ্ট্রপতির হেলিপ্যাড নির্মাণ নিয়ে সিপিএমের মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য ও তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ জেলা মুখপাত্র আশিস রায় চৌধুরী দু’জনেরই সতর্ক প্রতিক্রিয়া, “ঐতিহাসিক ব্যারাক স্কোয়ার মাঠটি বহরমপুর তথা মুর্শিদাবাদ জেলার গর্ব। সেটিকে রক্ষা করার দায়িত্ব সবার। সেখানে মেলা, সভা ও হেলিপ্যাড করা সঠিক কাজ নয়। স্টেডিয়ামে বিশাল এলাকা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সেখানে স্থায়ী হেলিপ্যাড তৈরি করে সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা যায়। ব্যারাক স্কোয়ার মাঠের বদলে স্টেডিয়াম মাঠে মেলাও করা যায়।” পলাশির যুদ্ধের ৮ বছর পর ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যারাক স্কোয়ার মাঠের চার পাশে সেনা নিবাস গড়ার কাজ শুরু করে। শেষ হয় ২ বছর পর ১৭৬৭ সালে। মাঠের চারপাশে ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসক ও সেনাকর্তাদের বাসভবন। ওই মাঠে যাতে জল না জমে তার জন্য আন্ডার গ্রাউন্ড নিকাশিনালাও করা হয় ২৪৭ বছর আগে। সবুজায়নের জন্য সেই সময় রেগুন থেকে রেনট্রি নিয়ে এসে মাঠের চারপাশে লাগানো হয়।
বর্গাকৃতি ওই মাঠটির প্রতিটি দিকের দৈর্ঘ্য ৪৪০ গজ। বছর দুয়েক আগে বহরমপুর পুরসভার পক্ষ থেকে সেই ঐতিহাসিক মাঠের চারপাশে লোহার বেড়া দিয়ে ফুলগাছ লাগিয়ে, ত্রিফলা আলো দিয়ে, বসার জন্য সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চ দিয়ে সৌন্দর্যায়ন করা হয়েছে। মাঠের চারপাশে বসানো সাউন্ড সিস্টেম থেকে সকাল সন্ধা ভেসে আসে সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা। রাতেও যাতে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার মতো সারা মাঠ আলোয় ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য চার প্রান্তে বসানো হয়েছে হাইমাস্ট আলোর সুউচ্চ বাতিস্তম্ভ। সকাল-সন্ধ্যা ব্যারাক স্কোয়ার মাঠ ভরে যায় সব বয়সের মানুষের ভিড়ে। প্রশ্ন উঠেছে, কিন্তু কত দিন? স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, সাইনবোর্ড টাঙিয়ে ওই মাঠে আমজনতার যানবাহন প্রবেশ যাঁরা নিষিদ্ধ করেছেন সেই সব প্রশাসনই সব ধরণের ভিভিআইপি-দের জন্য হেলিপ্যাড, বইমেলা, কন্যাশ্রী মেলা, কুটির শিল্পমেলা, সরকারি বস্ত্রমেলা ও মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক জনসভার মতো বছরভর নানা অনুষ্ঠান করে মাঠের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছেন।