পণ না-দিয়ে মেয়ে পার করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। তাই বিষক্রিয়ায় মেজ মেয়ের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জামাইয়ের সঙ্গে বছর চোদ্দোর সেজ মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিলেন সুশান্ত মাল। এক প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্য-সহ গ্রামের বেশ কিছু বাসিন্দাও সেই বিয়েতে উৎসাহ দেয়। কিন্তু রুখে দাঁড়ায় স্কুলপড়ুয়া মেয়ে। মেয়ের পাশে দাঁড়ান মা-ও। শেষ পর্যন্ত পিছু হঠেন বাবা। নাবালিকার বিয়ে আটকানো গেল সাগরদিঘির মাঠখাগড়া গ্রামে।
মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি ও রঘুনাথগঞ্জ ১ ব্লকের সীমানায় মাঠখাগড়া গ্রাম। শ’তিনেক পরিবারের বেশিরভাগই দিনমজুর, কৃষিজীবী। সেই রকমই পরিবার সুশান্ত মালের। চার মেয়ের বড়জনের বিয়ে দিয়েছেন গ্রামেই। মেজ মেয়ে মালুর বিয়ে দেন তিন মাস আগে।
বাসন্তীপুজো উপলক্ষে দিন ছ’য়েক আগে মালু বাপের বাড়িতে আসেন। বৃহস্পতিবার সকালে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে জঙ্গিপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। শুক্রবার সকালে হাসপাতালেই মারা যান মালু (১৮)। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে। পরিবারের দাবি, কীটনাশক খেয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন ওই কিশোরী।
আত্মহত্যার কারণ খোঁজার খুব একটা চেষ্টা করেনি বাড়ির লোকেরা। বরং জামাই বিকাশ মালের সঙ্গে সেজ মেয়ে জুলুর বিয়ের রফা করে আরও একটা ‘দায়’ থেকে মুক্তির চেষ্টা করেন বাবা সুশান্ত মাল।
সুশান্তবাবু নিজেই এ দিন বলেন, “ক’দিন আগেই মেজমেয়ের বিয়েতে জামাইকে দান-সামগ্রী দিয়েছি। বেয়াই বাড়ির লোকজন বলেছে, জামাইয়ের সঙ্গে সেজ মেয়ের বিয়ে দিলে আর কিছু দিতে-থুতে হবে না। তাই এই বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম।”
সে কথা কানে যেতেই রুখে দাঁড়ায় বন্যেশ্বর হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী জুলু। সে বলে, “বাবা নিরক্ষর। দিদিরাও পড়াশোনা করেনি। কিন্তু আমি স্কুলের পড়া চালাতে চাই। অন্তত উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ে তারপরে ভাবব বিয়ের কথা। সে জামাইবাবুকেই হোক বা অন্য কাউকে।” মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন মা পটুদেবী। তিনি বলেন, “ঠিকই তো বলছে মেয়ে। ১৪ বছর বয়সে বিয়ের খারাপ দিকটা আমি নিজের জীবনে ভাল মতোই বুঝেছি। মেয়ে স্কুলে পড়ছে, পড়বে। ওর বাবাকে সেটা বলে দিয়েছি।”
স্ত্রী ও মেয়ের বিদ্রোহের মুখে পড়ে শেষ পর্যন্ত পিছু হঠেন সুশান্তবাবু। কিন্তু সদ্য কন্যা হারানোর শোকের আবহেও কেন আবার বিয়ের কথা ভাবছিলেন তিনি?
সুশান্তবাবু বলেন, “গ্রামের পাঁচজন বলল, শ্বশুরবাড়ির লোকজনও প্রস্তাব দিল। তাই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। এখন মেয়ে আপত্তি করছে। স্ত্রী-ও রাজি নয়। আমিও তাই ও’কথা বাদ দিয়েছি।” মালুর স্বামী বিকাশ মাল পাশের গ্রাম জিনদিঘিতে একটি মিষ্টির দোকানে কাজ করেন। তিনি বলেন, “দুই বাড়ির লোকজন, গ্রামের পাঁচজন বিয়ে ঠিক করেছিল শ্যালিকার সঙ্গে। তবে ও যখন চাইছে না, তখন জোর করার প্রশ্নই ওঠে না।”
কিন্তু গ্রামের ‘পাঁচজনই’ বা কেন নাবালিকার বিয়েতে উৎসাহ দিলেন? জুলুর বিয়ের উদ্যোক্তা ‘গ্রামের পাঁচ জন’-এর মধ্যে রয়েছেন পঞ্চায়েতেরই প্রাক্তন সদস্য, কংগ্রেসের তরুণ রবিদাস। তাঁর যুক্তি, “খুবই গরিব ওরা। দ্বিতীয়বার বিয়ের খরচের হাত থেকে মেয়ের বাবাকে বাঁচাতেই এই প্রস্তাব দিয়েছিলাম আমরা।”
পঞ্চায়েতের এই ভূমিকায় ক্ষুব্ধ মুর্শিদাবাদের জেলা উপস্বাস্থ্য অধিকারিক তাপস রায়। তিনি বলেন, “কম বয়সে বিয়ে মুর্শিদাবাদে একটা ব্যাধি। পঞ্চায়েতের কর্তারাও অনেক ক্ষেত্রে তা প্রতিরোধ না করে হয় নীরব থাকছেন, নয় পরোক্ষে ইন্ধন দিচ্ছেন। অথচ পঞ্চায়েতেরই উচিত কম বয়সে বিয়ের বিরুদ্ধে গ্রামের মানুষকে সচেতন করা।”
পঞ্চায়েত তার কাজ না করলেও মেয়েই আটকেছে বিয়ে। নিশ্চিন্তে এখন স্কুলের ব্যাগ গোছাচ্ছে জুলু।